গণমাধ্যমে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট


ড. অরুণ কুমার গোস্বামী :
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকদের নির্মম বুলেটে যারা নিহত হয়েছিলেন তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য খুব ভোরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪-৫ জন ছাত্র কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডে নেমে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কস্থ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ করে পুলিশের একটি জিপ পথ আগলে তাদের সামনে এসে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ে। জিপ থেকে লাফিয়ে নেমে সশস্ত্র পুলিশ বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে থাকা ছাত্রদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অন্য সবাই দৌড়ে পালাতে পারলেও ফুলের ব্যাগ কাঁধে থাকা ছাত্রটিকে পুলিশ বেধড়ক পেটাতে শুরু করে। ফলে সে রাস্তায় পড়ে যায়। তার কাঁধে থাকা ফুলের ব্যাগটিকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে পুলিশ বলতে থাকে ‘তোর বাপকে এখনো ভুলতে পারিসনি’! এ ধরনের দৃশ্য এখন অর্থাৎ ২০১৭ সালে কল্পনাও করা যায় না। অথচ এমনটিই ঘটেছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে, ৩২ নম্বর সড়কস্থ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনার্থে আসা ছাত্রদের ওপর। আর এ ঘটনাটি বাংলাদেশের কোনো সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালো রাতে সংঘটিত মানবসভ্যতার কলঙ্কতম হত্যাকা-ের সংবাদ সে সময়ের বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন ছাড়া দেশের অন্যকোনো সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়নি। কিছু সংখ্যক মানুষ সেদিন আনন্দে আত্মহারা হলেও হাজার হাজার মানুষ তখন সব হারানোর বেদনায় ছিল নির্বাক। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে দেশের বাইরে এবং অভ্যন্তরের বিভিন্ন এলাকায় মানুষ সোচ্চার হয়েছিল। এ ধরনের প্রতিবাদের একটি ঘাঁটি ছিল নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর থানার ভবানীপুর নামের ছিটমহল স্টাইলের পাহাড়ি উপত্যকায়। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধাদের হেডকোয়ার্টার স্থাপন করা হয়েছিল এখানে। একই সাথে এটিও আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, এই প্রবন্ধের সূচনায় উল্লেখিত ঘটনায় পুলিশের মুখ থেকে বঙ্গবন্ধুকে ভুলে যাওয়া সম্পর্কে যে ইঙ্গিতমূলক উক্তি শোনা গিয়েছিল এটি ছিল আসলে বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী সব সরকারের নীতির মূল লক্ষ্য! এই উদ্দেশেই সামরিক সরকার ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চিরতরে থামিয়ে দিতে চেয়েছিল। এই উদ্দেশেই ১৫ আগস্ট কৃত্রিম জন্মদিন পালন করা হয়! এই উদ্দেশেই ১৯৭৫ সালের পর থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় বেতার, টেলিভিশন ও অন্যান্য সংবাদ মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্পর্কিত প্রচারণা নিষিদ্ধ থাকার পাশাপাশি এ বিষয়ে মিথ্যা তথ্য পরিবেশিত হতে দেখা যেত। বলা বাহুল্য, শত অপচেষ্টা সত্ত্বেও এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়নি এবং বাংলাদেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে। বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত।
খ্যাতনামা সাংবাদিক এ এল খতিব তার ‘কারা মুজিবের হত্যাকারী’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর সে সময়ে কোন দেশ কী ভূমিকা পালন করেছিল এবং আন্তর্জাতিক কোন গণমাধ্যম কী সংবাদ পরিবেশন করেছিল তার কিছু নমুনা উল্লেখ করেছেন। এই গ্রন্থে সে সময়ের বাংলাদেশ বেতার থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যা এবং খন্দকার মোশতাকের ক্ষমতা দখল সম্পর্কে বলা হয়েছে। তবে ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট হত্যাকা- সম্পর্কে বাংলাদেশি সংবাদপত্র কর্তৃক প্রচারিত বিষয়গুলো এখানে তেমন কিছু নেই। উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার কর্মসূচি নির্ধারিত হয়েছিল। তাই স্বাভাবিকভাবেই ১৫ আগস্টের সংবাদপত্রগুলোতে ভোররাতের হত্যাকা- সম্পর্কে কিছু খবর না থাকাটাই স্বাভাবিক। মোশতাক কর্তৃক রাষ্ট্রপতির পদে আরোহণের কথা বলা হচ্ছিল বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে। সম্প্রতি দেশের একটি অনলাইন সংবাদ মাধ্যমে ১৯৭৫ সালে তৎকালীন বাংলাদেশে বিদ্যমান সংবাদপত্রগুলোতে ১৫ আগস্টের হত্যাকা- সম্পর্কে ১৬ আগস্টের বাংলাদেশি সংবাদপত্রগুলোতে যে সংবাদ পরিবেশিত হয়েছিল তার পেপার কিপিংস প্রচার করেছে। উল্লেখ্য, এখনকার মতো এত বিপুল সংখ্যক সংবাদপত্র তখন প্রচারিত হত না। সে সময়ে বাংলাদেশে হাতে গোনা কয়েকটি সংবাদপত্র এবং একটি টেলিভিশন কেন্দ্র এবং বাংলাদেশ বেতার এগুলোই ছিল। সেসময়কার উল্লেখযোগ্য সংবাদপত্র হচ্ছেÑ দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক বাংলা, এবং ইংরেজি দৈনিক বাংলাদেশ টাইমস এবং বাংলাদেশ অবজারভার প্রভৃতি।
’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা, বঙ্গবন্ধুর ভাই মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসের, বঙ্গবন্ধুর পুত্র মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল ও লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল, কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল, শেখ কামাল ও শেখ জামালের নব পরিণীতা স্ত্রী সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব কর্নেল জামিল, পুলিশের দু’জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ১৮ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। এরপরে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িটি সরকারি দখলে থাকে।
বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা তখন দেশের বাইরে ছিলেন। ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের ৬ বছর পর ১৯৮১ সালের ১২ জুন বাড়িটা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার হাতে হস্তান্তর করা হয়েছিল।
সেসময় টেলিগ্রাম অফিসে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল কোনো বার্তা বাইরে না প্রেরণ করার জন্য। ( খতিব ১৯৯১, পৃঃ ১৫) ১৯৭৫-এর ১৬ আগস্ট সাংবাদিকরা বঙ্গভবনে তাহের উদ্দিন ঠাকুরের প্রেস ব্রিফিংয়ের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। দু’জন মেজর সেখানে অপেক্ষা করছিল। তাহের ক্র্যাচে ভর দিয়ে হাঁটাহাঁটি করছিল, হুদা নিজের মনে একা একা উপর-নিচ করে বেড়াচ্ছিল। স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হচ্ছিল যে সে নিজের চিন্তায় নিবিষ্ট। যখন কেউ তার সাথে কথা বলছিলেন, সে অন্যমনস্কভাবে সব কথার উত্তর দিচ্ছিল। সাংবাদিকদের সাথে যখন ফারুক কথা বলছিল তখন তার কণ্ঠে স্পষ্টভাবে আনন্দ প্রকাশ পাচ্ছিল! উপস্থিত সাংবাদিকদের মধ্যে এসময় কেউ কেউ চিন্তা করছিলেন যে এ ধরনের আনন্দিত একজন কিভাবে প্রেসিডেন্টকে হত্যা করতে পারে?
১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট ভোরে পাঠকদের হাতে আসা ওই সময়কার বাংলাদেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক ইত্তেফাকের ৬ কলামের শিরোনাম ছিলÑ ‘খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনীর শাসন ক্ষমতা গ্রহণ।’ এই প্রতিবেদনের সূচনাতেও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের খবর ছাপিয়ে খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণই প্রাধান্য পেয়েছিল। সংবাদপত্রটির প্রতিবেদনের শুরুটা হয়েছিল এভাবেÑ ‘রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী বৃহত্তর স্বার্থে গতকাল প্রত্যুষে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতাচ্যুত করিয়া দেশের শাসনভার গ্রহণ করিয়াছেন।’ এরপর লেখা হয়েছিল, ‘শাসনভার গ্রহণকালে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান স্বীয় বাসভবনে নিহত হইয়াছেন।’ ছয় কলামের এই সংবাদটির পাশেই দৈনিক ইত্তেফাক দুই কলামে ‘ঐতিহাসিক নবযাত্রা’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। ওই সময় পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন নুরুল ইসলাম পাটোয়ারী; বার্তা সম্পাদক ছিলেন আসাফউদ্দৌলা রেজা। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সম্পাদিত দৈনিক ইত্তেফাককে স্বাধীনতার আগে আওয়ামী লীগের মুখপত্র হিসেবেই মনে করতেন পাঠকরা। ১৬ আগস্টের ইত্তেফাকে প্রথম পাতায় আরও কয়েকটি শিরোনাম ছিলÑ ‘উপরাষ্ট্রপতি, ১০ জন মন্ত্রী ও ৬ জন প্রতিমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ’, ‘অচল নোটের ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত ফেরত’, ‘জাতির বৃহত্তর স্বার্থে শাসনভার গ্রহণ’, ‘যুক্তরাষ্ট্র স্বাভাবিক কূটনৈতিক কাজকর্ম চালাইয়া যাইবে’, ‘জনসাধারণের স্বস্তির নিঃশ্বাস’, ‘বিভিন্ন মহলের অভিনন্দন’, ‘বিদেশি দূতাবাসের মর্যাদা অক্ষুণœ থাকিবে’, ‘বি এ সিদ্দিকী রেড ক্রসের চেয়ারম্যান’ ইত্যাদি। এহতেশাম হায়দার চৌধুরী সম্পাদিত ১৬ আগস্টের দৈনিক বাংলার আট কলামের শিরোনাম ছিল ‘খোন্দকার মুশতাক নয়া রাষ্ট্রপতি।’
প্রধান এই শিরোনামের শোল্ডারে লেখা হয়েছেÑ ‘শেখ মুজিব নিহত : সামরিক আইন ও সান্ধ্য আইন জারি : সশস্ত্র বাহিনীর আনুগত্য প্রকাশ’ প্রথম পৃষ্ঠাতেই ‘ঐতিহাসিক পদক্ষেপ’ নামে একটি সম্পাদকীয় ছাপা হয়। শীর্ষ দৈনিকটির প্রথম পাতার অন্যান্য সংবাদের শিরোনাম ছিল, ‘দুর্নীতির সঙ্গে আপস নেই’, জোটনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করা হবে : রাষ্ট্রপতি’, ‘দশজন মন্ত্রী ও ছয়জন প্রতিমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ’, ‘নয়া সরকারের সাথে যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাবে’, ‘অচল শতকী নোটের ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত মূল্য ফেরত দেয়া হবে’, ‘পাকিস্তানের স্বীকৃতি দানের সিদ্ধান্ত’। ইত্তেফাকের মতোই দৈনিক বাংলাতেও প্রধান সংবাদের সঙ্গে মোশতাকের শপথের ছবি ছাপা হয়েছিল।
দ্য বাংলাদেশ টাইমসের আট কলামের প্রধান শিরোনাম ছিল, ‘মুশতাক অ্যাসিউমস প্রেসিডেন্সি’। এই শিরোনামের শোল্ডারে লেখা ছিল, ‘মার্শাল ল প্রকেইমড ইন দ্য কান্ট্রি : মুজিব কিলড্’। মূল শিরোনামের নিচে পত্রিকাটির প্রথম কলামে ‘আওয়ার কমেন্টস’ হেড লাইন দিয়ে সম্পাদকীয় ছাপা হয়েছিল; যার শিরোনাম ছিল, ‘অন দ্য থ্রেশলড অব দ্য নিউ এরা’। আব্দুল গনি হাজারি ছিলেন বাংলাদেশ টাইমসের সম্পাদক। ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্টের বাংলাদেশ টাইমসের প্রথম পাতার অন্যান্য শিরোনাম ছিল, ‘পিপল থ্যাংক আর্মড ফোর্সেস’, ‘মুজিবস পিকচার রিমুভড’, ‘ইউএস রেডি ফর নরমাল টাই’, ‘ভাইস প্রেসিডেন্ট, টেন মিনিস্টার, সিক্স স্টেট মিনিস্টার সোয়ার্ন ইন’, ‘ভ্যালুজ হ্যাভ টু বি রিহ্যাবিলিটেটেড’, ‘হেল্প মেক বাংলাদেশ এ প্রসপারাস কান্ট্রি’। প্রধান খবরের সঙ্গে মোশতাকের শপথের ছবি ছাপা হয়েছিল। ওবায়দুল হক সম্পাদিত সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক বাংলাদেশ অবজারভারের ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্টের প্রধান শিরোনাম ছিল, ‘মুশতাক বিকামস প্রেসিডেন্ট’।
শিরোনামের শোল্ডার ছিল, ‘আর্মড ফোর্সেস টেক ওভার : মার্শাল ল প্রোকেইমড : কারফিউ ইমপোজড’, কিকারে লেখা ছিল, ‘মুজিব কিলড : সিচ্যুয়েশন রিমেইনস কাম’। আট কলামের প্রধান শিরোনামের সঙ্গে মোশতাকের শপথের ছবি ছিল। প্রধান সংবাদের নিচে ‘হিস্টরিক্যাল নেসেসিটি’ শিরোনামে সম্পাদকীয়। তার পাশের দুটি সংবাদের শিরোনাম, ‘স্পেশাল প্রেয়ার্স’, ‘মুশতাক কলস ফর কো-অপারেশন।’ পত্রিকাটির প্রথম পাতায় অন্য শিরোনামগুলো ছিল, ‘পিপল হেইল টেক-ওভার’, ‘পাকিস্তান অ্যাকর্ডস রিকগনিশন’, ‘ইনভায়োবিলিটি অব ফরেন মিশনস অ্যাশিউরড’, ‘জাস্টিস মাস্ট বি এসটাব্লিস্ড : প্রেসিডেন্ট’ ওয়ার্ক হার্ড টু ইমপ্রুভ কনডিশন কুইকলি’, ‘ইউএস রেডি টু কনডাক্ট নরমাল ডিপ্লোম্যাটিক বিজনেস’,‘কারফিউ রিল্যাক্সড ফর জুম্মা প্রেয়ার্স’।
তবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের সংবাদ ভারতের কাছে গভীর শোকের কারণ হয়েছিল। ১৬ আগস্ট ভারতের একজন সরকারি মুখপাত্র বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের জন্য গভীর শোক প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের সময়ে আমরা তাঁর বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের জন্য তাঁকে সর্বোচ্চ সম্মানের স্থানে রাখবো।’ ‘ক্যু’ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার, কিন্তু প্রতিবেশী রাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উন্নয়নে ভারত অসংক্রমিত থাকতে পারে না।’ যুগোস্লাভিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘বাঙালি জনগণের মহান নেতা যুগোস্লাভিয়ার অবিভাজ্য সহানুভূতি গ্রহণ করুন। তাঁর মৃত্যুতে পৃথিবী একজন বিখ্যাত রাষ্ট্রপ্রধান ও শান্তির যোদ্ধাকে হারাল।’ বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ে সেসময়ের মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আব্দুল রাজ্জাক শোকাভিভূত হন। কুয়েতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ সালাহ মুজিবের মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করেন।
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস বঙ্গবন্ধু’র আলোকিত ধর্মনিরপেক্ষ নীতি বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করেছিল। কিন্তু ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধর্মহীনতা হিসেবে অপপ্রচার চালাতে থাকে। এস আর ঘৌরি করাচি থেকে লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় পাঠানো বার্তায় লিখেছিলেন, ‘মুজিবের বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র’ হিসেবে গড়ে তোলা ছিল পাকিস্তানি জনগণের কাছে মহা হতাশাপূর্ণ।’
লন্ডনের টাইমস পত্রিকা প্রচার করেছিল, উন্নয়নশীল দেশের জন্য সামরিক স্বৈরশাসন হলো অমঙ্গলজনক, কিন্তু ওই মুহূর্তে একই পত্রিকা বলে, ‘সামরিক শাসন মঙ্গলজনক এবং এর দ্বারা দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করা সম্ভব।’ লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকার কূটনৈতিক সংবাদদাতা আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘মুজিব সরকার যে সব বাম ঘেঁষা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল নতুন সরকার তার পরিপন্থি কাজ করবে।’
১৯৭৫-এর ১৬ আগস্ট সুদানের রাষ্ট্রপতি জাফর মুহাম্মদ নিমেরি চারদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে রিয়াদ পৌঁছালেন। ওই দিন সৌদি আরব ও সুদান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল!
সৌদি বাদশাহ খালেদ মোশতাকের নিকট পাঠানো বার্তায় বলেন, ‘আমার প্রিয় ভাই, নতুন ইসলামিক প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশের নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করায় আপনাকে আমি আমার নিজের এবং সকল সৌদি আরবীয় জাতির পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমি খোদার কাছে প্রার্থনা করছি তিনি যেন আপনাকে আপনার পদক্ষেপ সফল করতে সাহায্য করেন এবং খোদা আপনাকে ইসলামের খেদমত করার এবং ঐক্যবদ্ধ মুসলিম বিশ্বের জন্য কাজ করার তওফিক দেন।’
অধিকাংশ পাকিস্তানি বঙ্গবন্ধু হত্যাকা- এবং তার ফলে বাংলাদেশের দুর্দশার ঘটনায় ‘তাদের ধর্ষকামমূলক আনন্দ লুকাতে পারেনি’। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনীর নিকট পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল তাদের মধ্যে কেউ কেউ বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর সেই অপমানের প্রতিশোধ হয়েছে বলে অনুমান করেন। কয়েকটি পাকিস্তানি সংবাদপত্র বঙ্গবন্ধুকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মোশতাককে বহনকারী গাড়িটি যখন জাতীয় প্রেসকাবের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল তখন কয়েকজন সাংবাদিক ভেতর থেকে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল। একজন কবি সাংবাদিকদের মাঝে উপস্থিত ছিলেন। তিনি উত্তেজিত কণ্ঠে সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘গতকালও আপনারা বঙ্গবন্ধুকে সালাম দিয়েছেন।’
বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর ক্ষমতা দখলের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মোহাম্মদ উল্লাহকে উপ-রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করা হয়। শেখ মুজিবের শাসনামলের প্রাক্তন দুই রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এবং মোহাম্মদ উল্লাহ তাদের দু’জনকেই মোশতাক তার সরকারে স্থান দেয়। মোশতাক মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সাথে গোপন চুক্তিতে পৌঁছাতে চেষ্টা করেছিল তার সহকর্মীদের সহযোগিতায়। ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিয়ে ১৫ আগস্ট হত্যাকা- ঘটিয়ে সে ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করতে সক্ষম হয়েছিল! যদিও তার এইসব জঘন্য কর্মকা-ের কারণে বাংলাদেশের ইতিহাসে সে বেঈমান হিসেবেই চিহ্নিত।

SUMMARY

1606-1.png