সেদিন ভোর সাড়ে ৫টার দিকে

 
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। নারকীয় হত্যাযজ্ঞের প্রধান লক্ষ্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলেও এ দিনের ঘটনায় প্রথম শহীদ হন শেখ কামাল। জন্ম দিনের মাসেই সেদিন পিতা-মাতা, ভাইসহ পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যের সঙ্গে ঘাতকের দল হত্যা করে তার নববিবাহিত বধুকেও। আজ সেই শোকাবহ আগস্টের পঞ্চম দিন। ১৯৪৯ সালের এই দিনেই তদানীন্তন গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন শেখ কামাল। 
বঙ্গবন্ধু ভবনের আবাসিক ব্যক্তিগত সহকারী এবং হত্যা মামলার বাদী মুহিতুল ইসলামের প্রত্যক্ষ সাক্ষ্যে ওই দিনের ঘটনার বর্ণনায় জানা যায়- সেদিন ভোর সাড়ে ৫টার দিকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির রক্ষীরা বিউগল বাজিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন শুরু করামাত্রই বাড়িটি লক্ষ্য করে দক্ষিণ দিক থেকে সরাসরি আক্রমণ শুরু হয়। একটু পরেই বঙ্গবন্ধু তার ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসেন। ঘুম থেকে ওঠে গৃহকর্মী আবদুল আর রমা। রমা দোতলায় শেখ জামাল ও তার স্ত্রীকেও ঘুম থেকে তোলেন। জামাকাপড় পরে শেখ জামাল তার স্ত্রীকে নিয়ে দোতলায় বেগম মুজিবের কক্ষে যান।
ওদিকে গোলাগুলির মধ্যে অভ্যর্থনা কক্ষে বঙ্গবন্ধুর সামনেই বিভিন্ন জায়গায় ফোন করতে থাকেন মহিতুল। পুলিশ কন্ট্রোল রুম ও গণভবন এক্সচেঞ্জে চেষ্টার এক পর্যায়ে রিসিভার নিয়ে বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেন, ‘আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব বলছি ...’। বঙ্গবন্ধু তার কথা শেষ করতে পারেননি। একঝাঁক গুলি জানালার কাচ ভেঙে অফিসের দেয়ালে লাগে। কাচের এক টুকরায় মহিতুলের ডান হাতের কনুই জখম হয়। ওই জানালা দিয়ে গুলি আসতেই থাকে। বঙ্গবন্ধু টেবিলের পাশে শুয়ে পড়েন এবং মহিতুলের হাত ধরে কাছে টেনে শুইয়ে দেন।
এর মধ্যেই গৃহকর্মী আবদুলকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে তার পাঞ্জাবি ও চশমা পাঠিয়ে দেন বেগম মুজিব। কিছুক্ষণ পর গুলিবর্ষণ থেমে গেলে বঙ্গবন্ধু উঠে দাঁড়িয়ে আবদুলের হাত থেকে পাঞ্জাবি আর চশমা নিয়ে পরেন। নিচতলার এই ঘর থেকে বারান্দায় বের হয়ে বঙ্গবন্ধু পাহারায় থাকা সেনা ও পুলিশ সদস্যদের বলেন, ‘এত গুলি হচ্ছে, তোমরা কী করছো?’ এ কথা বলেই বঙ্গবন্ধু উপরে চলে যান।

বঙ্গবন্ধু উপরে উঠতে না উঠতেই শেখ কামাল নিচে নেমে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আর্মি আর পুলিশ ভাইরা, আপনারা আমার সঙ্গে আসেন।’ এ সময় শেখ কামালের পেছনে গিয়ে দাঁড়ান মহিতুল ইসলাম ও পুলিশের ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট (ডিএসপি) নুরুল ইসলাম খান। ঠিক তখনই মেজর নূর, মেজর মহিউদ্দিন (ল্যান্সার) এবং ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা সৈন্যদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ঢোকে।
গেটের ভেতর ঢুকেই তারা ‘হ্যান্ডস আপ’ বলে চিৎকার করতে থাকে। মহিতুল ইসলামকে টেনে ঘরের মধ্যে নিয়ে যান নুরুল ইসলাম খান। কোন কথা না বলেই শেখ কামালের পায়ে গুলি করে বজলুল হুদা। নিজেকে বাঁচাতে লাফ দিয়ে ঘরের মধ্যে গিয়ে পড়েন শেখ কামাল। মহিতুলকে বলতে থাকেন, ‘আমি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল। আপনি ওদেরকে বলেন।’ মহিতুল ঘাতকদের বলেন, ‘উনি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল। এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে শেখ কামালকে লক্ষ্য করে বজলুল হুদা তার হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে ব্রাশফায়ার করে। সঙ্গে সঙ্গে মারা যান শেখ কামাল।
আদালতে দেয়া বঙ্গবন্ধুর বাড়ির অন্যতম পাহারাদার হাবিলদার কুদ্দুস সিকদারের সাক্ষ্য থেকে জানা যায় একই ধরনের তথ্য। সেদিন বাড়িতে প্রথম ঢোকে মেজর বজলুল হুদা এবং ক্যাপ্টেন নূর চৌধুরী। তাদের সঙ্গে ছিল আরো কয়েকজন। বাড়িতে ঢুকেই তারা শেখ কামালকে দেখতে পায়। সাথে সাথে বজলুল হুদা স্টেনগান দিয়ে তাকে গুলি করে। শেখ কামাল বারান্দা থেকে ছিটকে গিয়ে অভ্যর্থনা কক্ষের মধ্যে পড়ে যান। সেখানে তাকে আবার গুলি করে হত্যা করা হয়।

SUMMARY

1605-1.png