মো. নুর হোসেন ইমন
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ধ্বংস করে স্বাধীনতাকে ধূলিস্বাৎ করতে চেয়েচিল একটি মহল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর বাংলাদেশের পত্রিকাগুলোর চরিত্র পাল্টে যায়।
কিন্তু ১৫ আগস্টের পূর্বে বিভিন্ন গণমাধ্যমে কি ধরণের সংবাদ প্রকাশ করেছিল সেগুলো প্রকাশ করা হচ্ছে। তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব আজ।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যেদিন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয় সেদিনকার পত্রিকার শিরোনামগুলো ছিল-
'১৫ আগস্টের পত্রিকায় ছিল, বঙ্গবন্ধু আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করবেন'। সেদিনের পত্রিকায় বিদেশিদের মুখে বাংলাদেশের অগ্রগতিতে মুগ্ধ হওয়ার খবর ছাপানো হয়েছিল। ১৫ আগস্ট, রাষ্ট্রপতি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা। ওই দিন দৈনিক বাংলার প্রথম পৃষ্ঠায় বাম পাশে দুই কলামে প্রধান খবরে বলা হয়, ‘বঙ্গবন্ধু আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করবেন।’ এ খবরের পাশাপাশি আরেকটি খবর ছিল ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণের সাড়া’। পত্রিকার শেষ পাতায় বঙ্গবন্ধুর হাস্যোজ্জ্বল ছবি দিয়ে বক্স ফিচার ছিল ‘বঙ্গবন্ধুকে আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বাগত জানাবে’। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ছিল শুক্রবার। সকালে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার খবর ফলাও করে পত্রিকাগুলোতে ছাপা হয়। দৈনিক বাংলা ও ইত্তেফাক-এ প্রকাশিত হয় আট পৃষ্ঠার বিশেষ ক্রোড়পত্র। কিন্তু ভোর হতেই পত্রিকার সব খবর মিথ্যা হয়ে যায়। কারণ সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর আশা হয়নি। ঘাতকের নির্মম বুলেটে ভোর হতেই তিনি তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ সেদিন প্রাণ হারান।
সেদিনের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ খবর ছিল চক্রান্তকারীদের বন্দরনগরী থেকে ৪৯ লাখ টাকার গম আত্মসাতের খবর। ওয়াগন ভেঙে ব্যাপকহারে খাদ্য পাচার হয়। (৬ ও ৭ আগস্ট) ৭৮টি জাহাজ থেকে ৪ কোটি টাকার খাদ্যশস্য লাপাত্তা করা হয়। (১০ আগস্ট) বিভিন্ন পত্রিকায় চরমপন্থি গ্রেফতার ও নিহতের সংবাদও বের হয়। (১৩ ও ১৪ আগস্ট) তবে ১ আগস্ট থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত সরকারের কর্মকাণ্ডসহ বাকশালের সংবাদ ছিল প্রধান অংশ জুড়ে। বঙ্গবন্ধু যে দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন সেই কর্মযজ্ঞে বঙ্গবন্ধুসহ প্রধান ব্যক্তিত্বদের কর্মচাঞ্চল্য ছিল দেখার মতো।
তখনকার পত্রিকার সংবাদ ও সরকারের কর্মকাণ্ড ছিল মূলত বাকশাল কেন্দ্রিক। ১৫ আগস্ট দৈনিক বাংলার প্রথম পাতায় বাকশাল নিয়ে ১০টি খবর প্রকাশিত হয়। প্রধান শিরোনাম ছিল ‘গ্রামপর্যায়ে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে’। শিল্পমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান বাকশাল জেলা সম্পাদকদের প্রশিক্ষণ কোর্সে এ কথা বলেন। ওই অনুষ্ঠানে প্রত্যেক মন্ত্রীর বক্তব্য আলাদা শিরোনামে এক বা দুই কলামে প্রকাশ হয়।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী আব্দুল মান্নান বলেন, ‘অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য চাই পরিকল্পিত জনসংখ্যা’। শ্রম ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলী বলেন, ‘প্রথম পরিকল্পনাকালে ৪১ লাখ নতুন চাকরি হবে’। শিক্ষামন্ত্রী মোজাফফর আহমদ চৌধুরী বলেন, ‘দ্বিতীয় বিপ্লব সফল করতে সততার সাথে কাজ করুন’। আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর বলেন, ‘ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টাই সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পথ’। বাকশালের সাধারণ সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মনি জেলা সম্পাদকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘ক্ষমতার অপব্যবহার করবেন না’। এ ছাড়া প্রথম পৃষ্ঠায় আরেকটি খবরের শিরোনাম ছিল, বঙ্গবন্ধু কাল জেলা গভর্নর ও সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হবেন। অপর খবরটি ছিল জেলা সম্পাদক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে গুরুত্বপূর্ণ রদবদল।
১৪ আগস্টের পত্রিকায়ও বাকশাল জেলা সম্পাদকদের প্রশিক্ষণ কোর্সে তথ্যমন্ত্রী কোরবান আলীর ‘অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যই দ্বিতীয় বিপ্লব’ শীর্ষক বক্তব্য শীর্ষ খবর হিসেবে ছাপা হয়। এ ছাড়া জিল্লুর রহমান, আব্দুর রাজ্জাক, শেখ ফজলুল হক মনি, অধ্যাপক ইউসুফ আলীসহ কয়েকজন বাকশাল নেতার বক্তব্য পৃথক শিরোনামে প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছিল। ১৩ আগস্টও দৈনিক বাংলার খবরে প্রাধান্য পায় বাকশালের খবর।
মোটকথা ১৯৭৫ সালের ১ থেকে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত সংবাদপত্রের খবর ছিল বাকশালকে কেন্দ্র করে। ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠন করা হয়। কিন্তু আগস্টে বাকশালের সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত করতে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়।৫ আগস্ট দৈনিক বাংলার প্রথম পাতায় ববাকশালের জেলা সম্পাদকদের প্রশিক্ষণের খবর ছাপা হয়। ওই দিন বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাকের বরাত দিয়ে পত্রিকাটির শীর্ষ খবরে বলা হয় ‘আটটি দেশের সঙ্গে শুল্ক রহিতের চুক্তি হবে। দৈনিক ইত্তেফাকের ৪ আগস্ট সংখ্যার শীর্ষ খবর ছিল ‘জেলা বাকশাল সম্পাদক ও যুগ্ম সম্পাদকদের নাম ঘোষণা’। ওই দিন দৈনিক বাংলার শীর্ষ খবর ছিল ‘জাতীয় দলের জেলা সম্পাদকদের নাম ঘোষণা’। ওই খবরের উপ-শিরোনামে বলা হয়, প্রতিটি কমিটিতে একজন সাধারণ সম্পাদক ও পাঁচজন যুগ্ম সম্পাদক নিয়োগ।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পূর্ববর্তী সময়ে পত্রিকাগুলো বঙ্গবন্ধু ঘোষিত দ্বিতীয় বিপ্লব,বাকশাল ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে পত্রিকার খবরগুলো আবর্তিত হচ্ছিল।কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডর পর পত্রিকার দৃশ্যপট পাল্টে যায়। দেশের রাষ্ট্রপতিকে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ হত্যা করা হলেও কোন পত্রিকা সেই খবর ছাপেনি।বঙ্গবন্ধুর হত্যার খবর পত্রিকাগুলো কিভাবে প্রচার করেছিল তা নিয়ে থাকছে আমাদের পরবর্তী প্রতিবেদন।