১৫ আগস্ট: একদিনেই সংবাদপত্র বদলে গিয়েছিল যেভাবে


জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর রাতারাতি বদলে গিয়েছিল বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলোর ভ‚মিকা।

লেখক গবেষক শাহরিয়ার কবিরের ভাষায়, সামরিক আইনের মধ্যে ক্ষমতা দখলকারীদের বিরাগভাজন হওয়ার কোনো ঝুঁকি সেই সময়ের সংবাদপত্রগুলো নেয়নি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর একদল কমর্কতার্ ও সৈনিকের হাতে সপরিবারে জীবন দিতে হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে।

এরপর ক্ষমতায় বসেন খোন্দকার মুশতাক আহমদ, জারি করা হয় সামরিক আইন। ১০ দিনের মাথায় জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করেন মুশতাক। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বন্ধ করে দেয়া হয় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের পথ। 

১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে সংবিধানের চতুথর্ সংশোধন এনে বাকশাল প্রতিষ্ঠার পর ইত্তেফাকসহ মোট চারটি দৈনিক পত্রিকা তখন প্রকাশ হচ্ছিল।

এসব পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় আগে যেখানে প্রতিদিনই বঙ্গবন্ধু বা তার ঘনিষ্ঠ নেতাদের সংবাদ দেখা যেত, ১৫ আগস্টের পর তা বদলে যায়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবরটি কোনো পত্রিকায় প্রধান শিরোনামে আসেনি; কোনো কোনো খবরে নতুন সরকারের গুণগান করতেও দেখা যায়। চাপা পড়ে সেনা অভ্যুত্থান ও অবৈধ ক্ষমতা দখলের খবর।

সেই রাতের আগে

ধানমÐির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয় ১৫ আগস্ট ভোরের দিকে। তার আগেই মধ্যরাতে সংবাদপত্র ছাপার জন্য প্রেসে চলে যায়। ফলে ১৫ আগস্ট শুক্রবারের পত্রিকায় সেই খবর আসেনি। ১৬ আগস্ট পত্রিকার শিরোনামে আসে সেনাবাহিনী ও মুশতাক সরকারের দায়িত্ব নেয়ার খবর।

সেই রাতের আগে পত্রিকাগুলোর প্রথম পৃষ্ঠা ছিল অন্যরকম। এহতেশাম হায়দার চৌধুরী সম্পাদিত দৈনিক বাংলার ১৪ আগস্টের প্রধান শিরোনাম ছিল ছয় কলামজুড়ে ‘অথৈর্নতিক মুক্তির জন্যই দ্বিতীয় বিপ্লব’। বাকশাল জেলা সম্পাদক প্রশিক্ষণ কোসের্ কোরবান আলীর বক্তব্য ধরে ছাপা হয় ওই সংবাদ।

ওবায়দুল হক সম্পাদিত সবাির্ধক প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক বাংলাদেশ অবজারভার সেদিন আওয়ামী নেতা মনসুর আলীকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। শিরোনাম ছিল, ‘প্রকৌশলীদের প্রতি মনসুরের আহŸান: উন্নয়ন তরান্বিত করতে দক্ষতা ব্যবহার করুন’। এ ছাড়া বঙ্গভবনে বাকশালের এক অনুষ্ঠানে তোফায়েল আহমেদ এবং তৎকালীন বাকশাল সেক্রেটারি শেখ মণি, জিল্লুর রহমান ও আব্দুর রাজ্জাকের বক্তব্য নিয়ে আলাদা প্রতিবেদন ছাপা হয়।

১৫ আগস্ট অবজারভারের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত ছয়টি প্রতিবেদনের শিরোনামে সরাসরি বঙ্গবন্ধু শব্দটি উল্লেখ ছিল। একটির শিরোনাম ছিল- ‘বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রশংসায় কোরিয়ান দূত’।

প্রধান প্রতিবেদনটি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবতের্ন বঙ্গবন্ধুর যোগ দেয়ার কমর্সূচি নিয়ে। এ বিষয়ে একটি বিশেষ ক্রোড়পত্রও ছেপেছিল পত্রিকাটি। কিন্তু বঙ্গবন্দু হত্যা এবং ক্ষমতার পটপরিবতের্ন সেদিন সেই সমাবতর্ন আর হয়নি।

সে সময় দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক ছিলেন নুরুল ইসলাম পাটোয়ারী। ১৫ আগস্ট ইত্তেফাকেও প্রধান শিরোনাম হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবতের্ন বঙ্গবন্ধুর যাওয়ার কমর্সূচি। ওই প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধুর ছবিও ছিল। প্রকাশ করা হয়েছিল বিশেষ ক্রোড়পত্র।

সেদিন দৈনিক বাংলার প্রধান শিরোনাম ছিল ‘গ্রাম পযাের্য় চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে’। বাকশাল জেলা সম্পাদক প্রশিক্ষণ কোসের্ তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামানের বক্তব্য নিয়ে ওই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর

১৬ আগস্ট দৈনিক বাংলার প্রধান প্রতিবেদনে সবগুলো কলামজুড়ে শিরোনাম ছিল, ‘খোন্দকার মুশতাক নয়া রাষ্ট্রপতি’। শোল্ডারে লেখা ছিল ‘শেখ মুজিব নিহত: সামরিক আইন ও সান্ধ্য আইন জারি: সশস্ত্র বাহিনীসমূহের আনুগত্য প্রকাশ’।

বঙ্গবন্ধু হতাকাÐ বা নৃসংশতার কোনো বণর্না সেদিন দৈনিক বাংলার কোথাও ছিল না। প্রধান প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘শুক্রবার সকালে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী ‘বৃহত্তর জাতীয় স্বাথের্’ সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের পতন ঘটিয়ে প্রেসিডেন্ট খোন্দকার মুশতাক আহমদের নেতৃত্বে ক্ষমতা গ্রহণ করে। সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণের সময় সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান তার বাসভবনে নিহত হন বলে ষোষণা করা হয়।’

আরেকটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল- ‘দুনীির্তর সঙ্গে আপস নেই’। সেখানে বলা হয়, ‘রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মুশতাক আহমদ নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্যে দেশবাসী সব শ্রেণির মানুষের প্রতি নিষ্ঠার সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম করার আহŸান জানিয়েছেন।’

দৈনিক বাংলা সেদিন প্রথম পৃষ্ঠায় ‘ঐতিহাসিক পদক্ষেপ’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। সেখানে লেখা হয়, ‘জাতীয় জীবনে একটি ঐতিহাসিক ক্রান্তির সূচনা হয়েছে। জাতীয় জীবনে সূচিত এই ঐতিহাসিক পদক্ষেপকে স্বতঃস্ফ‚তর্ সমথর্ন দিয়েছেন জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধারা। দেশে কোথাও কোনো অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটেনি। সবর্ত্র বিরাজিত স্বাভাবিক অবস্থা।’

স্বাধীনতার আগে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সম্পাদিত যে ইত্তেফাককে আওয়ামী লীগের মুখপত্র মনে করা হতো, বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর সেই ইত্তেফাকের প্রধান শিরোনাম ছিল- ‘দুনীির্ত স্বজনপ্রীতি উচ্ছেদ: খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনীর শাসনক্ষমতা গ্রহণ’।

সেখানে কেবল ‘বঙ্গবন্ধুর নিহত’ হয়েছেন বলা হয়, তাকে যে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে, সেই ঘটনা ছিল অনুপস্থিত।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘রাষ্ট্রপতি খন্দকার মুশতাক আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী জাতির বৃহত্তর স্বাথের্ গতকাল প্রত্যুষে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতাচ্যুত করিয়া দেশের শাসনভার গ্রহণ করিয়াছেন।... শাসনভার গ্রহণকালে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান স্বীয় বাসভবনে নিহত হইয়াছেন।’

‘ঐতিহাসিক নবযাত্রা’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয় সেদিনের ইত্তেফাকে। সেখানে মুশতাকের ক্ষমতা গ্রহণকে দেশ ও জাতির ‘ঐতিহাসিক প্রয়োজন পূরণ’ হিসেবে দেখানো হয়। প্রথম পৃষ্ঠায় কয়েকটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল- ‘জাতির বৃহত্তর স্বাথের্ শাসনভার গ্রহণ’।

ইত্তেফাক সেদিন ‘জনসাধারণের স্বস্তির নিঃশ্বাস’ শিরোনামের আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে; সেখানে লেখা হয়, ‘গতকাল ছিল গতানুগতিক জীবনধারার একটি ব্যতিক্রম। চলার পথে শক্তি সঞ্চয়ের দিন। তাই আমাদের জাতীয় জীবনে একটি ঐতিহাসিক দিন।... মনের ভাব প্রকাশের জন্য রাস্তায় নামিয়া পড়ার অদম্য ইচ্ছা থাকিলেও শান্তিপ্রিয় জনগণ নয়া সরকারের নিদের্শ লঙ্ঘন করে নাই।’ 

বাংলাদেশ অবজারভারের প্রধান শিরোনাম সেদিন ছিল, ‘রাষ্ট্রপতি হয়েছেন মুশতাক’। শোল্ডারে লেখা ছিল- ‘ক্ষমতায় সশস্ত্র বাহিনী: সামরিক আইন জারি: কারফিউ জারি’। আর মূল শিরোনামের নিচে কিকারে ছোট করে লেখা ছিল ‘মুজিব নিহত: পরিস্থিতি শান্ত’।

সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সরিয়ে শুক্রবার ভোরে ‘বৃহত্তর জাতীয় স্বাথের্’ রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী।... এটা ঘোষণা করা হয় যে, ক্ষমতা গ্রহণের সময় সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান তার বাসভবনে নিহত হন।... এখন পযর্ন্ত পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে।’

এ ছাড়া প্রথম পৃষ্ঠায় একটি সম্পাদকীয় ছাপা হয় ‘হিসটোরিকাল নেসিসিটি’ শিরোনামে। সেখানে বলা হয়, ‘এটা ছিল বৃহত্তর জাতীয় স্বাথের্ এবং ইতিহাসের আবশ্যকতার প্রেক্ষিতে’... রাষ্ট্রপতি মুশতাক রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সত্য আকাক্সক্ষা পূরণের পবিত্র দায়িত্ব থেকে...।’

অবজারভারের আরেকটি শিরোনাম ছিলÑ ‘ক্ষমতা গ্রহণে জনগণের অভিবাদন’।

আর আব্দুল গণি হাজারি সম্পাদিত বাংলাদেশ টাইমসের আট কলামের প্রধান শিরোনাম ছিল, ‘মুসতাক অ্যাসিউমস প্রেসিডেন্সি’।

এই শিরোনামের শোল্ডারে লেখা ছিল, ‘মাশার্ল ল প্রক্লেইমড ইন দ্য কান্ট্রি: মুজিব কিলড’। প্রধান খবরে সঙ্গে মোশতাকের শপথের ছবি ছাপা হয়েছিল।

মূল শিরোনামের নিচে পত্রিকাটির প্রথম কলামে ‘আওয়ার কমেন্টস’ নাম দিয়ে একটি সম্পাদকীয় ছাপা হয়; যার শিরোনাম ছিল- ‘অন দ্য থ্রেশলড অব দ্য নিউ এরা’।

পত্রিকাটির প্রথম পাতার অন্যান্য শিরোনাম ছিল, ‘পিপল থ্যাঙ্ক আমর্ড ফোসের্স’, ‘মুজিবস পিকচার রিমুভড’, ‘ইউএস রেডি ফর নরমাল টাই’, ‘ভাইস প্রেসিডেন্ট, টেন মিনিস্টার, সিক্স স্টেট মিনিস্টার সোয়নর্ ইন’, ‘ভ্যালুজ হ্যাভ টু বি রিহ্যাবিলিটেটেড’, ‘হেল্প মেক বাংলাদেশ এ প্রসপরাস কান্ট্রি’।

মুশতাক প্রশাসনের স্তুতি

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাÐের পর আগস্টের বাকি দুই সপ্তাহ ধরে সংবাদপত্রে চলে মুশতাক সরকারের প্রতি ’সমথর্নসূচক‘ প্রতিবেদন প্রচার। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচরদের ‘হয়রানির’ খবর সেখানে আসেনি।

মুশতাক সরকারকে কয়েকটি দেশের স্বীকৃতির খবর প্রকাশিত হয় ১৭ আগস্টের দৈনিক বাংলায়।

‘জনগণের স্বতঃস্ফূতর্ অভিনন্দন’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনের ভাষা ছিল এ রকম-, ‘কায়েমি স্বাথর্বাদী মহলের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মুশতাক আহমদের নেতৃত্বাধীন নয়া সরকার এবং সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি দেশের সবর্স্তরের জনগণের স্বতঃস্ফূতর্ অভিনন্দন জ্ঞাপন অব্যাহত রয়েছে। তারা নয়া সরকারের প্রতি তাদের পূণর্ আস্থা ও আনুগত্য প্রকাশ করেছেন।’

অবশ্য সেদিন বঙ্গবন্ধুকে নিয়েও আলাদা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে দৈনিক বাংলা। ‘পূণর্ মযার্দায় সাবেক রাষ্ট্রপতির লাশ দাফন’ শিরোনামে মাত্র দুই লাইনের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ শনিবার বিমানযোগে ফরিদপুরের টুঙ্গিপাড়ায় তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পূণর্ মযার্দার সঙ্গে তাদের পারিবারিক গোরস্তানে দাফন করা হয়। একজন সরকারি মুখপাত্র একথা জানান বলে গতকাল বাসসের খবরে বলা হয়।’

ইত্তেফাকে ১৭ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের দাফনের খবর ছাপা হয় ৩৭ শব্দে।

‘পূণর্ মযার্দায় স্বগ্রামে পরলোকগত রাষ্ট্রপতির দাফন সম্পন্ন’ শিরোনামে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘পরলোকগত রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ গতকাল (শনিবার) বিমানে করিয়া তাহার নিজ গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় (ফরিদপুর) লইয়া যাওয়া হয় এবং উহাদের পারিবারিক গোরস্তানে পূণর্ মযার্দায় দাফন করা হয়।’

সেদিনের পত্রিকায় গুরুত্বের সঙ্গে বক্স করে ছাপা একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিলÑ ‘রাষ্ট্রপতি মোশতাকের প্রতি বাদশাহ খালেদ ও প্রেসিডেন্ট নিমেরীর অভিনন্দন: সৌদি আরব ও সুদানের স্বীকৃতি’।

অবজারভারও সেদিন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল নতুন সরকারের প্রতি সৌদি আরব ও সুদানের স্বীকৃতিকে। টুঙ্গিপাড়ায় মুজিবের দাফনের কথা বলা হয় ২৪ শব্দের এক সংবাদে।

মুশতাক সরকারের প্রতি ‘সমথর্নসূচক’ প্রতিবেদন ছাপার পাশাপাশি ‘লন্ডনে প্রায় দুইশ’ বাঙালি কতৃর্ক’ বঙ্গবন্ধুর ছবি পোড়ানোর খবর প্রাধান্য পায় সেদিনের অবজারভারে।

ভেতরের পৃষ্ঠার একটি শিরোনাম ছিল ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক’। আরেকটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল- ‘পরিবতর্ন (ক্ষমতা) বিদেশে প্রশংসিত’।

‘নয়া সরকারের প্রতি আকুণ্ঠ সমথর্ন অব্যাহত’, ‘বিভিন্ন স্থানে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা’, ‘যোগাযোগ ও পরিবহন স্বাভাবিক: কমর্চঞ্চল জীবনযাত্রা’, ‘ইয়েমেনের স্বীকৃতি: সাম্প্রতিক পরিবতর্ন বিদেশে অভিনন্দিত’, ‘সকল স্তরের মানুষের অভিনন্দন অব্যাহত’- এ ধরনের শিরোনাম দৈনিক বাংলায় ধারাবাহিকভাবে দেখা যায় আগস্টের শেষ দিনগুলোতে।

‘কোনো বিভ্রান্তির অবকাশ রাখা হয়নি’ শিরোনামে একটি নিবন্ধে বলা হয়, ‘স্ফটিক-স্বচ্ছ দপের্ণর আলোকেই মূল্যায়ন করতে হবে জাতির জীবনে সূচিত পরিবতর্নকে।... ঐতিহাসিক প্রয়োজনে জাতির দুগির্ত মোচনের সুনিদির্ষ্ট লক্ষ্য সামনে রেখেই ক্ষমতায় এসেছেন নতুন সরকার।’

দীঘির্দন পর আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী চার নেতা ও বঙ্গবন্ধুর ‘শুভানুধ্যায়ীদের’ খবর আসে এ পত্রিকায়, তা ছিল তাদের গ্রেপ্তারের খবর।

‘অবৈধ সম্পত্তি করার দায়ে ২৬ জন আটক’ শিরোনামের ২৪ এপ্রিল প্রকাশিত দৈনিক বাংলার ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘...দুনীির্তর আশ্রয় গ্রহণ করে ও সমাজবিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত থেকে জানামতে নিজ আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীনভাবে বিপুল সম্পত্তি গড়ে তোলা এবং গোপন পন্থায় স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার প্রভৃতি উপায়ে সম্পত্তি কুক্ষিগত করার অভিযোগে সামরিক আইন বিধি বলে শনিবার (২৩ আগস্ট) নিম্নোক্ত ব্যক্তিদের আটক করা হয়েছে।’

আগস্টের শেষ দিনগুলোতে ইত্তেফাকের চিত্রও ছিল একই রকম। ২১ আগস্ট ‘রাজনৈতিক কমীের্দর সক্রিয় সহযোগিতা প্রয়োজন’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘...স্পষ্টতঃ সকল শ্রেণির রাজনৈতিক কমীর্র সহযোগিতাও নয়া সরকারের কাম্য। কাজেই এ ব্যাপারে কাহারও মনে কোন দ্বিধা দ্ব›দ্ব থাকা বাঞ্ছনীয় নহে।... রাষ্ট্রপতির এই বক্তব্যে সুস্পষ্টভাবে সৎ ও দেশপ্রেমিক নাগরিকদের সক্রিয় সহযোগিতা আহŸান সূচিত হইয়াছে।’

সেন্সরশিপ

একাত্তরের ঘাতক দালাল নিমূর্ল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির ১৯৭৫ সালে ছিলেন সাপ্তাহিক বিচিত্রার সহকারী সম্পাদক।

বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর সংবাদপত্রের পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর মাশার্ল ল জারি ছিল। মাশার্ল ল’য়ের সময় নিজস্ব মতামত বলতে কিছু থাকে না। মতামতের স্বাধীনতা, চলাফেরার স্বাধীনতা কিছু থাকে না। সে সময় সংবিধান রহিত ছিল। মানে মিডিয়ারও কোনো ধরনের স্বাধীনতা ছিল না। নিউজ আইএসপিআর থেকে সেন্সর করে পাঠানো হতো। তারা যা পাঠাত তাই ছাপতে হতো।’

শাহরিয়ার কবির বলেন, সে সময় সংবাদমাধ্যমের যে ভূমিকা দেখা যায়, তা মূলত সামরিক আইনের কারণে।

‘মিডিয়া মালিকরা ঝুঁকি নিতে পারতেন, কিন্তু ঝুঁকি নেননি। বঙ্গবন্ধু, নজরুলকে হত্যা করতে যাদের হাত কঁাপে না, তারা যে কাউকে হত্যা করতে পারে। তখনকার বেশিরভাগ পত্রিকাই তো মোশতাকপন্থি ছিল। সবাির্ধক প্রচারিত ইত্তেফাক তখন ছিল মইনুল হোসেনের। সে মোশতাকের ডান হাত ছিল। দৈনিক বাংলা ট্রাস্টের মালিকানায় ছিল। সেটাও ছিল এন্টি আওয়ামী লীগ।’

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাÐের খবর সেদিন যেভাবে চেপে যাওয়া হয়েছিল, সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা মিডিয়ার জন্য কালো অধ্যায়। গোটা জাতির জন্য কালো অধ্যায়। সামান্য যা প্রতিবাদ হয়েছে, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাথীর্রা করেছে। মিডিয়া করতে পারেনি। সাহিত্যে প্রতিবাদ হয়েছে, কিছু লেখক-কবি কবিতা লিখে প্রোটেস্ট (প্রতিবাদ) করেছে। সেগুলো মেইনস্ট্রিম (মূলধারা) পত্রিকায় আসেনি।

“বরং বঙ্গবন্ধুর সময় মিডিয়া অনেক স্বাধীন ছিল। তারা নানা ধরনের দুনীির্তর সংবাদ প্রকাশ করত।”

SUMMARY

1603-1.jpg