বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ একসূত্রে গাঁথা


শারফিন শাহ
 
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বুলগেরীয় গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নািসদের হাতে নিহত হন উইলিয়াম টমসন নামে এক ব্যক্তি। তিনি ছিলেন কবি। মৃত্যুর পর তার পকেটে নোট বইয়ে কিছু কবিতা পাওয়া যায়। একটি কবিতায় তিনি লিখেছিলেন—We who know the most of living can give it too- ‘অর্থাত্ আমরা যারা জীবনকে নানাভাবে সাজাতে জানি তারাই জীবনকে দান করে যেতে সক্ষম।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তেমনই একজন মানুষ, যিনি নিজের জীবনকে নানাভাবে সাজিয়েছিলেন এবং হাসিমুখে জীবনটা বাঙালি জাতিকে দানও করে গেছেন। আমাদের চারপাশে তাকালে দেখব কেউ অর্থের পেছনে ছুটে হয়রান, কেউ সাফল্যের পেছনে ছুটে হয়রান, কেউ বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ির পেছনে ছুটে হয়রান, কেউ শ্রেষ্ঠত্বের পেছনে ছুটে হয়রান। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এসবের  কোনোটার পেছনে ছোটেননি। তিনি ছুটেছেন বাঙালির অধিকার আদায়ের পেছনে, বাঙালি জাতির ভবিষ্যত নির্মাণের পেছনে। তার সকল চিন্তা ও কর্মের মূলে ছিল বাংলার মানুষের মুক্তির উপায় উদ্ভাবন। তাই তিনি বাঙালি জাতির জনক, বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।

টুঙ্গিপাড়ার এক পরিবারে জন্ম নেয়া শেখ মুজিব স্কুল জীবন থেকেই ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী। তিনি যখন গোপালগঞ্জ স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়েন তখন গোপালগঞ্জে এক জনসভার আয়োজন করা হয়েছিল। সভায় বক্তা ছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। কিন্তু গোপালগঞ্জের এস. ডি. ও সভা করতে দেবেন না। প্রতিবাদ জানালেন কিশোর মুজিব। তিনি বললেন—‘জনগণ সোহরাওয়ার্দী, ফজলুল হকের কথা শুনতে চায়, আপনি বাধা দেবার কে?’ অত:পর যা হবার তাই হলো। কিশোর মুজিবের সাত দিনের জেল হলো। সেই থেকেই তার পরিচিতি বেড়ে গেল। সারা গোপালগঞ্জে তখন একটাই নাম— মুজিব আর মুজিব। এই ব্যাপক পরিচিতির সুবাদেই তার রাজনীতির পথ প্রশস্ত হতে থাকে। তিনি ১৯৪০ সালে ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম স্টুডেন্টস ফেডারেশন’ এবং ‘অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। একই সময়ে তিনি গোপালগঞ্জ মুসলিম লীগের মহকুমা শাখার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪২ সালে এনট্র্যান্স  পাশ  করার  পর  কলকাতা  ইসলামিয়া  কলেজে আইন  পড়ার  জন্য  ভর্তি  হন। কলকাতা  বিশ্ববিদ্যালয়ের  অধিভুক্ত  এই  কলেজটি  তখন বেশ  নামকরা  ছিল। এই  কলেজে তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আরো ব্যাপকতা লাভ করে। 

১৯৪৭ সালে তিনি গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন এবং এ বছরই মুসলিম লীগ ত্যাগ করেন। এ সময় তিনি বার্নার্ড শ, কার্ল মার্ক্স, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামের লেখার সাথে পরিচিত হন। তাদের লেখা পড়ে তিনি নিজেকে আরো শানিত করতে সক্ষম হন। বুঝতে পারেন নিজ জাতির অধিকার আদায়ের প্রয়োজনীয়তা। দেশভাগের কারণে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। এখানে এসে তিনি আবিষ্কার করেন পূর্ব পাকিস্তানের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক আধিপত্যের বেড়াজাল। এই আধিপত্যের বেড়াজাল ছিন্ন করতে তিনি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সেই সংগ্রামের প্রথম ধাপ ভাষা আন্দোলন। তিনি বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানের দাবি জানালেন। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি,  ২৩  তারিখে  পাকিস্তানের  প্রধানমন্ত্রী  খাজা  নাজিমউদ্দিন  গণ-পরিষদের  অধিবেশনে  বলেন, ‘উর্দূই  হবে পাকিস্তানের  একমাত্র  রাষ্ট্রভাষা।’ বঙ্গবন্ধু এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানালেন। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে পড়ছেন। কিন্তু ক্লাস বাদ দিয়ে ভাষার অধিকার আদায়ে লাগাতার করে যাচ্ছেন মিটিং-মিছিল-সমাবেশ। তাই তাকে গ্রেফতার করা হলো। কিন্তু তিনি ভেঙে পড়লেন না। জেলখানাতে বসেই ভাষা আন্দোলন চালিয়ে যান। বায়ান্ন সালের রক্ষস্নাত সময়কে ধরে বাঙালি তার ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করল। এই ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই বাঙালি তার মুক্তির পথ খুঁজে পেল। তাই শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি—সবকিছুর অধিকার আদায়ে সোচ্চার হলো পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি মানুষ। বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে লাহোরে ঘোষণা করলেন বাঙালির মুক্তির রূপরেখা—ছয় দফা দাবি। এই দাবিতেই ছিল বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠার মূলমন্ত্রসমূহ। এই ছয় দফা দাবি ১৯৬৯ সালে ১১ দফা দাবির আকারে পেশ করা হয়। এ বছরেরই ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রায় দশ লাখ জনতার সামনে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তিনি প্রতিটি বাঙালির পরম প্রিয় ও শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠেন। আর একাত্তরের সাতই মার্চের ভাষণ তো আরেক সাহসের অগ্নিধারা। এই ভাষণের পথ ধরে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন স্বাধীনতার। বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে। যার ফল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে একটি ‘বাংলাদেশ’ অর্জন।

বাংলা, বাঙালি, বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু একসূত্রে গাঁথা। এরা কেউ কারো থেকে আলাদা নয়। বঙ্গবন্ধু আধুনিক জাতিরাষ্ট্র গঠনের ধ্যান-ধারণায় প্রভাবিত হয়ে বাঙালির মুক্তির জন্য স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তিনি বাঙালিকে, বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন। কিন্ত সেই ভালোবাসাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল। দেশ স্বাধীন হবার পর তিনি যখন দেশকে সবদিক থেকে উন্নত করার কাজে ব্যস্ত ঠিক তখনি একদল বিশ্বাসঘাতক তাকে হত্যা করে সপরিবারে। দিল্লীর প্রার্থনা সভায় মহাত্মা গান্ধী যখন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তখন বার্নার্ড শ নিজস্ব ভঙ্গিতে মন্তব্য করেছিলেন— It is too dangerous to be too good. বঙ্গবন্ধু নিজের জীবন দিয়ে তার প্রমাণ দিয়ে গেলেন।

SUMMARY

160-1.jpg