বঙ্গবন্ধু পরিবারের হত্যাকাণ্ডকে কোন পত্রিকা-ই লিড নিউজ করেনি

মো. নুর হোসেন ইমন

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তার শাহাদৎ বরণের পরের দিন ১৬ আগস্ট ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রধান ৪টি পত্রিকার কোনটিই লিড নিউজ করেনি।

তৎকালীন দৈনিক বাংলা, দৈনিক ইত্তেফাক, দি বাংলাদেশ অবজারভার, দি বাংলাদেশ টাইমসসহ অন্যান্য পত্রিকাগুলো ১৫ আগস্ট মোশতাকের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের ঘটনাকে গুরুত্ব দিয়ে ফলাও করে খবর ছাপায়। তৎকালীন শীর্ষস্থানীয় এই চারটি খবরের কাগজ দুটো বাংলা, দুটো ইংরেজি তাদের কেউই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডকে লিড নিউজ করে সংবাদ পরিবেশন করেনি। একটিরও প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধু হত্যা এবং সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণের আসল কাহিনী তুলে ধরেনি। নিহতের সংখ্যা কত তাও প্রকাশ করা হয়নি। পত্রিকাগুলোর সংবাদ প্রকাশের সারমর্ম ছিল-বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে হত্যা করার বিষয়টি বেমালুম চেপে যাওয়া, জনগণ এই ক্ষমতা দখলে খুশি এমন একটা আভাস দেয়া।

সেদিন গণমাধ্যম যে ভূমিকা পালন করেছে তা সত্যিই লজ্জাস্কর। একটি দেশের স্বপ্নদ্রষ্টাকে সপরিবারে নৃসংশভাবে হত্যা করা হলো কিন্তু তা না ছাপিয়ে বরং ছাপা হলো ‘খন্দকার মোশতাক নয়া রাষ্ট্রপতি’। ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের ১৫ তারিখের পরে দেশের সংবাদপত্রগুলো উল্টোমুখে চলা শুরু করে। দেশিয় পত্রপত্রিকাগুলো বঙ্গবন্ধুর কথা বলার সময় বারবার বিদেশি পত্রিকার বরাত দিলেও একই সময় সেসব দেশের অনেক ইংরেজি ভাষার পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর প্রশংসা করে যেসব সংবাদ প্রকাশিত হয় তা উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকে। ১৫ আগস্টের ঘটনার পরদিন ১৬ আগস্ট বাংলাদেশের প্রধান পত্রিকাগুলোর আচরণ দেখলে অবাক হতে হয়। নিচে পত্রিকাগুলোর সেদিনের আচরণের অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো।

4

বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ইংরেজি পত্রিকা 'দ্য বাংলাদেশ অবজারভার’ এর সেদিনের প্রধান শিরোনাম ছিল -Armed Forces take over : Martial law proclaimed curfew imposed : Mushtaque becomes president - Mujib killed : Situation remains calm. ইত্যাদি। ওই দিন এই পত্রিকা থেকে মোশতাককে সহযোগিতা করতে আহ্বান করা হয়। ওই দিন এই পত্রিকার সম্পাদকীয় (Historical Necessity)  ছিল চোখে পড়ার মত।

বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত আরেকটি প্রধান ইংরেজি পত্রিকা ‘বাংলাদেশ টাইমস’ এর সেদিনের শিরোনামগুলো ছিল- Marital law proclaimed in the country : Mujib killed - Mushtaque Assomes presidency.

The Armed Forces of Bangladesh took over power in the 'greater nation al interest ' under president Khondkar Mushtaque Ahmed,topping the former president sheikh Mujibur Rahman early on friday morning. The former president Sheikh Mujibur Rahman was killed at his residence during the takeover.

বাংলাদেশ টাইমস বঙ্গনন্ধু যে খুন হয়েছে তা স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছে। তবে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি বরাবরের মত চেপে গেছে। ওই পত্রিকায় ওই দিন On the threshold of a new era নামক বিশেষ সম্পাদকীয় প্রকাশ করা হয়। ওই সম্পাদকীয়তেও পুরো বিষয়টাকে হালকেভাবে উপস্থাপন করা হয়। ওই সম্পাদকীয় এর অংশ বিশেষ নিচে দেওয়া হল-The valiant armed forces of the county under the leadership of president Khondkar Mushraque Ahmed have taken over the reins of the Government in a smooth and orderly way at a time when a change had become absolutely necessary; but the situation was such that no change could be effected in a constitutional manner.

1 ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ এর প্রধান শিরোনাম ছিল “খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে সশস্ত্রবাহিনীর শাসন ক্ষমতা গ্রহণ”। এর সাথে সাথে সেদিন ইত্তেফাক এর একটি দীর্ঘ সম্পাদকীয় ছিল “ঐতিহাসিক নবযাত্রা” নামে।

এছাড়া প্রথম পৃষ্ঠার খবর ছিল, “উপ-রাষ্ট্রপতি, ১০ জন মন্ত্রী ও ৬ জন প্রতিমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ।” ১৬ আগস্ট দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠার শিরোনামগুলো ছিল এরকম- 'দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি উচ্ছেদ। সুবিচার ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ঘোষণা। খন্দকার মোস্তাকের নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনীর শাসন ক্ষমতা গ্রহণ।'

অন্য কোন পত্রিকা যে কথা বলেনি সেটি ইত্তেফাক বলে দিল- “সশস্ত্র বাহিনী জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষমতা গ্রহণ করেছে।” লন্ডনস্থ হাইকমিশন ভবনে বিক্ষোভ করে বঙ্গবন্ধুর ছবি নামিয়ে ছিঁড়ে ফেলার খবর রয়েছে এদিনের সংবাদপত্রে।সেদিনের শনিবারে দৈনিক ইত্তেফাকের বিশেষ  সম্পাদকীয় ছিল- 'ঐতিহাসিক নবযাত্রা'। এর শুরুতে বলা হয়, দেশ ও জাতির এক ঐতিহাসিক প্রয়োজন পূরণে গতকাল প্রত্যুষে প্রবীণ জননায়ক খোন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী সরকারের সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণ করিয়াছেন। পূর্ববর্তী সরকার ক্ষমতাচ্যুত হইয়াছেন।

সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় জীবনে এই পরিবর্তনের এক বিষাদময় গুরুত্ব রহিয়াছে। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত ও অসংখ্য মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা একদিন যে স্বাধীনতা অর্জন করিয়াছিলাম সেখানে আমাদের আশা ও স্বপ্ন ছিল অপরিমেয়। কিন্তু গত সাড়ে তিন বছরেরও ঊর্ধ্বকালে দেশবাসী বাস্তবক্ষেত্রে যাহা লাভ করিয়াছে তাহাকে এক কথায় গভীর হতাশা ও বঞ্চনা ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। ...গণমানুষের ভাগ্য উন্নয়নের পরিবর্তে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির আশ্রয় গ্রহণ করিয়া এবং একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে স্থায়ীভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাখিবার দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষায় মাতিয়া উঠিয়া স্বাধীনতার সুফল হইতে জনগণকে নির্মমভাবে বঞ্চিত করা হইয়াছে।’ সম্পাদকীয়তে এসব প্রেক্ষাপট তুলে ধরে সামরিক হস্তক্ষেপ অনিবার্য হয়ে ওঠার কথা উল্লেখ করা হয়।এই দৈনিকটি মোস্তাকের ক্ষমতা গ্রহণের ঘটনাকে দেশ ও জাতির এক ঐতিহাসিক প্রয়োজন পূরণের নিদর্শন হিসেবে চিহ্নিত করে। বঙ্গবন্ধুর শাসনকালকে বলা হয়- তার আমলে দেশবাসী হতাশা আর বঞ্চনা ছাড়া কিছুই পায়নি। সেদিন পত্রিকাটি নতুন সরকারের সাফল্য কামনা করেছে।

১৬ আগস্টের ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুসহ তাঁর পরিবার ও নিরাপত্তাকর্মীদের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কোনো তথ্য ছিল না। অন্যান্য খবরের মধ্যে ছিল মোশতাক সরকারের প্রতি পাকিস্তানের স্বীকৃতি, নয়া সরকারের জন্য জুমার নামাজ শেষে বিশেষ মোনাজাত, যুক্তরাষ্ট্রের স্বাভাবিক কূটনৈতিক কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ, বিদেশি দূতাবাসের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখার আশ্বাস, গাজী গোলাম মোস্তফাকে অপসারণ করে বি এ সিদ্দিকীকে রেডক্রসের চেয়ারম্যান নিয়োগ, লন্ডন হাইকমিশন ভবনে বিক্ষোভ ও সেখানে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি নামিয়ে ফেলাসহ কয়েকটি খবর।

2 তৎকালীন বাংলাদেশের প্রভাবশালী জাতীয় বাংলা দৈনিক ছিল 'দৈনিক বাংলা'। ১৬ আগস্ট দৈনিক বাংলার শিরোনাম ছিল “শেখ মুজিব নিহত : সামরিক আইন ও সান্ধ্য আইন জারি, সশস্ত্রবাহিনীসমূহের আনুগত্য প্রকাশ”। এর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির বেতার ভাষণ ছাপা হয়। বিভিন্ন স্তরের জনসাধারণের অভিনন্দন বলতে- বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সহসভাপতি, বাংলাদেশ গণকর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ, জাতীয় হকার্স লীগের সভাপতির কথা লেখা হয়। কিছু এমপি এ ঘটনায় আনন্দিত হয়ে সরকারকে অভিনন্দন জানান।

নতুন গঠিত মোশতাক সরকারের সাথে যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। নতুন সরকারের জন্য বিশেষ মোনাজাত করা হয়। রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দেন জোটনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করা হবে। 'দুর্নীতির সঙ্গে আপস নয়' এ কথাও বলেন তিনি। সরকার থেকে বলা হয় বিদেশি মিশনসমূহের স্বার্থ মর্যাদার সঙ্গে রক্ষা করা হবে। সেসময় সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ, বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খোন্দকার ও নৌবাহিনীর প্রধান কমোডর ছিলেন মোশাররফ হোসেন। তারাও সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত জনসাধারণকে ঘরের ভেতর থাকার জন্য অনুরোধ জানানো হয়। নয়া সরকারের সঙ্গে দেশের সব দেশপ্রেমিক ও শান্তিপ্রিয় নাগরিককে সহযোগিতা করার অনুরোধ জানানো হয়। বক্স করে প্রচার করা হয় এই বাক্যগুলো- 'দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সর্বতোভাবে সরকারের সাথে সহযোগিতা করুন।' দৈনিক বাংলা'র সম্পাদকীয় ছিল- 'ঐতিহাসিক পদক্ষেপ'। লেখা হয়- 'জাতীয় জীবনে একটি ঐতিহাসিক ক্রান্তির সূচনা হয়েছে। জাতীয় জীবনে সূচিত এই ঐতিহাসিক পদক্ষেপকে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন দিয়েছেন জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধারা।' দেশের সর্বত্রই স্বাভাবিক অবস্থা দাবি করা হয়। প্রশংসা করা হয় সশস্ত্রবাহিনীর। বলা হয় তারা পবিত্র দায়িত্ব পালন করেছে। জাতির সামনে তারা খুলে দিয়েছেন সম্ভাবনার স্বর্ণতোরণ, উন্মোচন করেছেন সমৃদ্ধির নব দিগন্ত।

প্রধান পত্রিকাগুলো ছাড়াও অন্যান্য পত্রিকা ও রেডিও স্টেশনগুলোও একই নীতি অবলম্বন করে। ১৫ আগস্ট প্রচারিত মোশতাকের বেতার ভাষণে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা প্রকাশ করা হয়; যা ছিল মিথ্যা। ওই দিনের পত্রিকাগুলোতে অস্থায়ী প্রধান বিচারপতির কাছে মোশতাকের শপথ নেওয়ার ছবি ছাপানো হয়। "দুর্নীতির সঙ্গে আপস নেই’ মর্মে মোশতাকের বেতার ভাষণও বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হয়।

ওই ভাষণের প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘প্রিয় দেশবাসী ভাই ও বোনেরা। এক ঐতিহাসিক প্রয়োজনে এবং বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সঠিক ও সত্যিকারের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপদানের পূত-পবিত্র দায়িত্ব সামগ্রিক ও সমষ্টিগতভাবে সম্পাদনের জন্য পরম করুণমায় আল্লাহ তায়ালা ও বাংলাদেশের গণমানুষের দোয়ার ওপর ভরসা করে রাষ্ট্রপতি হিসেবে সরকারের দায়িত্ব আমার ওপর অর্পিত হয়েছে। বাংলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের বজ্রকঠিন দায়িত্ব সম্পাদনের পথ সুগম করার জন্য বাংলাদেশের সেনাবাহিনী সত্যিকারের বীরের মতো অকুতোভয়চিত্তে এগিয়ে এসেছেন।’

দীর্ঘকাল দেশের ভাগ্য উন্নয়নের কোনও চেষ্টা না করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা এবং সেই ক্ষমতাকে স্থায়ীভাবে আঁকড়ে রাখার ষড়যন্ত্রের জাল রচনা করা হয়েছিল।’ বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্র, সামাজিক, অর্থনৈতিক নীতি সম্পর্কে সেদিন মোস্তাক নেতিবাচক মতামত তুলে ধরেন।

সরকারি বার্তা সংস্থা বাসস-এর বরাত দিয়ে অন্যান্য পত্রিকাগুলোতে একই খবরে বলা হয়, সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য সামরিক আইন ঘোষণা ও সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। দুপুরের পর অবশ্য মুসল্লিদের জুমার নামাজ আদায়ের সুবিধার্থে দেড় ঘণ্টার জন্য সান্ধ্য আইন তুলে নেওয়া হয়।

3

ওই খবরে অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি সৈয়দ এ বি মাহমুদ হোসেনের কাছ থেকে খন্দকার মোশতাকের শপথ নেওয়ার তথ্য, মোহাম্মদ উল্লাহকে ভাইস প্রেসিডেন্ট নিয়োগ, ১০ মন্ত্রী ও ছয় প্রতিমন্ত্রী নিয়োগের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়। আরও উল্লেখ করা হয়, সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ, নৌবাহিনী প্রধান কমোডর মোশাররফ হোসেন খান এবং বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার পৃথক পৃথক বেতার ভাষণে মোশতাক আহমদের নেতৃত্বাধীন নয়া সরকারের প্রতি আনুগত্য ও দৃঢ় আস্থা প্রকাশ করেছেন।

এ ছাড়া বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান, রক্ষীবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত পরিচালক সাবিউদ্দিন আহমেদ এবং আইজিপি এ এইচ নুরুল ইসলাম বেতার মারফত মোশতাক সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন মর্মে খবর প্রকাশ করা হয়।মনে করা হয়, স্থানীয় পত্রিকাগুলো সামরিক সরকারের চাপে হত্যাকাণ্ডের খবরটি গুরুত্বহীনভাবে ছাপে।

আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোতে কিভাবে ছাপানো হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু সংবাদ।

১৬ আগস্ট বাংলাদেশের পত্রিকাগুলোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পত্রিকাগুলোতেও বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার খবর বেরোয়, তবে তাঁর পরিবারের সদস্যসহ অন্যদের হত্যার বিষয়টি চেপে যাওয়া হয়। নিউইয়র্ক টাইমস ১৫ আগস্টেই বাংলাদেশে সেনা অভ্যুত্থান ও বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর ছাপায়। কিন্তু তারাও অন্য ২০ জনকে হত্যার বিষয়ে কোনো সংবাদ ছাপেনি।নিউইয়র্ক টাইমস ১৫ আগস্ট এ বিষয়ে দুটি প্রতিবেদন ছাপে। প্রথমটি সংক্ষিপ্ত, ভেতরের পাতায় ছাপানো এ খবরের শিরোনাম ছিল, 'বাংলাদেশে অভ্যুত্থানে মুজিব ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার খবর।' নয়াদিল্লি থেকে পাঠানো ৩৪৩ শব্দের এ প্রতিবেদনে পশ্চিমা কূটনীতিকদের বরাত দিয়ে বলা হয়, 'সশস্ত্র বাহিনী আজ ভোরে এক অভ্যুত্থান করে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে...।' এতে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কোনো খবর নেই। দ্বিতীয় প্রতিবেদনটি প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপানো হয়। শব্দসংখ্যা এক হাজার ৬২। এর শিরোনাম, 'বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থানে মুজিব উৎখাত ও নিহত; দীর্ঘদিনের সহযোগী ও মন্ত্রিসভার সদস্য মোস্তাক আহমেদ নতুন প্রেসিডেন্ট; মুজিব নিহত, ঢাকা রেডিওর খবর।' এতে হত্যাকাণ্ডের বিশালতার ব্যাপারে কোনো খবর বা ইঙ্গিত ছিল না।

পরদিন ১৬ আগস্ট নিউইয়র্ক টাইমস বাংলাদেশ নিয়ে ছয়টি প্রতিবেদন ছাপে। প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপানো হয় একটি। এর শিরোনাম, 'বাংলাদেশে শাসনব্যবস্থা সংহত করার উদ্যোগ অভুত্থানের নেতাদের; অধিকাংশ যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন; অনির্দিষ্টকালের জন্য সামরিক আইন ও কার্ফ্যু জারি...।' এতে নতুন সরকার অত্যন্ত দ্রুত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে এসেছে বলে উল্লেখ করা হয়। দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় ছাপানো সংবাদটির শিরোনাম, 'বাংলাদেশের নতুন প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ।' এ পৃষ্ঠায় 'এক নজরে বাংলাদেশ' শিরোনামে আরেকটি প্রতিবেদনে বাংলাদেশ-সম্পর্কিত সাধারণ তথ্যাবলি উল্লেখ করা হয়। তৃতীয় পৃষ্ঠায় ছাপানো হয় দুটি প্রতিবেদন। একটি শিরোনাম "ঢাকার সরকারের প্রস্তাবের অপেক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র"। অন্যটির শিরোনাম "বাঙালিদের মুক্ত করতে মুজিবের নেতৃত্বে দীর্ঘ লড়াই"। ১৮ নম্বর পৃষ্ঠায় "বাংলাদেশে অভ্যুত্থান" শিরোনামে শিশু রাষ্ট্রটির ট্র্যাজেডি বিষয়ে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়।

5

ওয়াশিংটন পোস্টসহ বিশ্বের অন্য বিখ্যাত পত্রিকাগুলোর সংবাদ পরিবেশন ছিল এ রকমই।ওয়াশিংটন পোস্ট তাদের ১৬ আগস্টের সংখ্যায় ১৫ আগস্টের ডেটলাইনে লেখে, 'ইসলাম ও পশ্চিমাদের সমর্থক একটি সেনা সমর্থিত সরকার ভোরে এক রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের পর আজ বাংলাদেশের ক্ষমতা গ্রহণ করেছে।' প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, 'উৎখাতের সময় বামপন্থী রাষ্ট্রপতি মুজিবুর রহমানের প্রাণ গেছে...।'

১৫ আগস্টের ঘটনার পরদিন সোভিয়েত পত্রিকা ইজভেসতিয়া খবরটি ভেতরের পাতায় কোনো মন্তব্য ছাড়াই চাপে। এতেও হত্যাকাণ্ডের বিশালতার ব্যাপারে কোনো তথ্য ছিল না। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র প্রাভদাতেও এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু ছাপা হয়ননি।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করা কোন কতিপয় সামরিক অপিসারের বঙ্গবন্ধুর স্বৈরাচারে অতিষ্ট হয়ে করা বিপ্লব ছিল না।দেশ ও বিদেশের প্রভাবশালী চক্রের আশীর্বাদ এবং মদদে অনেক দিনের পরিকল্পনা ছাড়া এতটা নিপুণভাবে কার্যসিদ্দি করা,গণমাধ্যমকে এতো তাড়াতাড়ি নিজেদের সুরে কথা বলতে বাধ্য করা সম্ভব না।এসব করা এতটা সুক্ষভাবে সম্পাদন করা শুধুমাত্র কতিপয় জুনিয়ার অফিসারের পক্ষে অসম্ভব। বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত খুনিদের খুঁজে বের করে তাদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া এখন সময়ের দাবি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর এক শোক আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধুর খুনিদের খুঁজে বের করতে এক উচ্চ পর্যায়ের কমিশন গঠনের দাবী জানিয়েছিলেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জাতীয় নেতাদের হত্যাকারীদের খুঁজার জন্য কমিশন গঠন করা হয়েছে,কিন্তু দুঃখের বিষয় বঙ্গবন্ধু হত্যার ৪২ বছর পেরিয়ে গেলেও তার বিরুদ্ধে কারা ষড়যন্ত্র করেছে তাদের চিহ্নিত করা যায় নি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট যারা ধানমন্ডীর ৩২ নাম্বারের বাড়ীতে গিয়ে ঘান চালিয়েছিল শুধু তারা ষড়যন্ত্র করেনি।তাদের পিছনে ছিল জাতীয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ষড়যন্ত্র। এদের পিছনে অনেক শক্তি জড়িত ছিল।এসব জাতীয়,আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের খুঁজে বের করতে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিশন গঠন করে বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রকৃত কাহিনী জাতীর সামনে প্রকাশ পাওয়া আজ সময়ের দাবি।

SUMMARY

1599-1.jpg