১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশকে পুনরায় পাকিস্তানের মডেলে রূপান্তরের নীল নকশার বাস্তবায়ন ঘটানো হয়। তাকে হত্যার ফলে '৭৫ সাল থেকে এ দেশ নামে বাংলাদেশ কামে পাকিস্তান হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের শেষলগ্নে সিআইএ এবং আইএসআই নিশ্চিত হয়ে যায় লাখ লাখ শহীদের রক্তে স্নাত হয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের উত্থান তারা রোধ করতে ব্যর্থ। পেন্টাগনে ও ইসলামাবাদের শীর্ষ গোয়েন্দারা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিয়ে মধ্য প্রাচ্যের সামরিক বাহিনীতে প্রশিক্ষক হিসেবে ও ডেপুটেশনে কর্তব্যরত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ অনুগত বাঙালি অফিসারদের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের নির্দেশ দেয়। পাকিস্তানের গোপন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিয়ে খুনি ডালিম, ফারুক, রশীদ গং-রা আইএসআই এবং সিআইএ'র KILLING SQUAD-এর সদস্য হয়ে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে। এসেই তাদের মধ্যমণি হিসেবে পেয়ে যায় মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর বিরোধী পাকিস্তান গোয়েন্দা বাহিনীর সাবেক অফিসার জেড-ফোর্সের কমান্ডার মেজর জিয়াকে। যুদ্ধকালীন জেনারেল ওসমানীকে অপসারণের লক্ষ্যে তার command & strategy out dated
বলে তার বিরুদ্ধে অসন্তোষ ও ক্ষোভ গড়ে তোলেন। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধবিষয়ক প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন স্যারের প্রতিভা ও ক্ষিপ্রতায় এবং সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের দৃঢ় ভূমিকায় 'জেড ফোর্স' অধিনায়ক সফল হতে পারেননি। '৭৫-এর ১৫ আগস্ট তিনি যখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান সেনাপতি, তখন আইএসআই এবং সিআইএ-এর সামনে ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের খোলা দরজা।
১৫ আগস্টের ভোর পৌনে ছ'টার দিকে স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পী প্রণোদিৎ বড়ুয়া আমার আজিমপুরের সরকারি কলোনির ৩৭/সি নং বাসার দরজা ভেঙে ফেলার মতো করে ধাক্কা দিয়ে আমার নাম ধরে জোরে জোরে চিৎকার করে ডেকে তুললেন। রেডিওতে ততক্ষণে মেজর ডালিমের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে : 'আমি মেজর ডালিম বলছি, আমি মেজর ডালিম বলছি, বাংলার মীর জাফর শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। বাংলার মীর জাফর শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। মীর জাফর মুজিব সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে। ঢাকাসহ সারা দেশে কারফিউ জারি করা হয়েছে...।' আমি তখন বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা অফিসারের বাসায় টেলিফোন করে কি করা যায় তা নিয়ে কথা বলছিলাম। রক্ষীবাহিনীর টেলিফোন এঙ্চেঞ্চ সারাক্ষণ engaged পাচ্ছিলাম। ততক্ষণে প্রণোদিৎ দা'র দেওয়া বঙ্গবন্ধুর বাড়ির শেখ কামালের বেড রুমের সেই unclassified ফোনে আমি ফোন করলাম। (খুব দুঃখিত যে, সেই ফোন নম্বরটি এত বছর পরে আর স্মরণ করতে পারছি না এবং প্রণোদিৎ দা'ও আজ বেঁচে নেই। সেই ফোনটি ছিল সুলতানা কামাল খুকুর, যার হদিস টিএন্ডটি'র চেয়ারম্যান ব্যতীত অন্য কোনো অফিসার জানত না)। প্রণোদিৎ দা রিসিভারে কান পেতে রাখলেন ৩২ নম্বর থেকে কি উত্তর আসে শোনার জন্য। তিনবার রিং হতেই শেখ কামালের বেড রুমের টেলিফোনের রিসিভার ধরে অপর প্রান্তে 'হ্যালো' বলতেই আমি বললাম, 'আমি শেখ কামালের বন্ধু বলছি। কামাল কেমন আছে?' টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে চোস্ত উর্দুতে উত্তর দিল : 'বহুত আচ্ছা, আপ কৌন?' আমি বললাম : 'আমি ওর বন্ধু। ওদের বাড়ির দিক থেকে গোলাগুলির আওয়াজ আসছে কেন?' সেই লোকটি পুনরায় চোস্ত উর্দুতে উত্তর দিল : 'ও কুছ নেহি। বাজি ফুট রাহা হ্যায়। উও লোগ খুছিছে খুছি মানা রাহে হ্যায়? আপ কৌন? আপ কাঁহাছে রোল রাহে হ্যায়? আপ কা ফোন নম্বর কেতনা?'
৩২ নম্বরের বাড়িতে ১৫ আগস্ট সকাল পৌনে ৭টার দিকে পাক সেনাদের মতো চোস্ত উর্দু কণ্ঠস্বর শুনে আমার নিশ্চিত বিশ্বাস হলো যে, বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যারাই হামলা করুক তাদের মধ্যে পাক সেনারাও রয়েছে। রিসিভারে আমার সঙ্গে কান লাগিয়ে ওদের কথা শুনে প্রণোদিৎ দা'ও বলে উঠলেন, 'মুসা, এ তো দেখছি পাকিস্তানি সেনার কণ্ঠস্বর।' ততক্ষণে আমি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছি এবং ইংরেজিতে তাকে বললাম, 'হোয়াই ইউ আর স্পিকিং ইন উর্দু? আর ইউ পাকিস্তানি আর্মি?' বজ পাতের মতো চীৎকার করে উত্তর দিলো, 'আই অ্যাম ইউর ফাদার, হোয়াট ইজ ইউর অ্যাড্রেস, বাস্টার্ড?'
বিবিসি সেদিন মার্ক টালির বরাতে সংবাদ প্রচার করল, 'ঢাকার ঘরে ঘরে মুজিববাহিনী ও মুক্তিবাহিনী প্রস্তুত হচ্ছে এবং তারা যে কোনো সময় সাঁড়াশি আক্রমণ চালিয়ে ঢাকা দখল করে ফেলবে এবং শেখ মুজিব হত্যার প্রতিশোধ নেবে মর্মে প্রতিজ্ঞা নিয়েছে বলে জানা যায়।' বিবিসি-তে এই সংবাদ প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গভবনে খুনি মোশতাক ও তার সহযোগী খুনি ডালিম-ফারুকদের হৃৎকম্পন শুরু হয়ে যায়। তারা বিডিআর থেকে অতিরিক্ত ফোর্স আনে বঙ্গভবন গার্ড দেওয়ার জন্য। বিবিসির এই সংবাদে ঢাকার মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বেড়ে যায় এবং খুনি ডালিম-ফারুকদের বিরুদ্ধে ঢাকাসহ আশপাশের জেলাগুলোয় প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সবাই যে যার সাধ্যমতো চেষ্টা করতে থাকে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর খুনিচক্র ডালিম-ফারুক-রশীদ এবং তাদের দোসর এইচ. টি. ইমাম-আবদুর রহিম, মাহবুব আলম চাষীরা তড়িগড়ি করে খোন্দকার মোশতাককে প্রেসিডেন্ট হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে দেশবাসী ও বিশ্ববাসীর সামনে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নেয়। সেনাবাহিনী, রক্ষীবাহিনী ও দেশবাসীর সামনে তারা দেখাতে চায়, বঙ্গবন্ধু জীবিত নেই বলে কোনো ক্ষমতার বা প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের শূন্যতা সৃষ্টি হয়নি। ১৫ আগস্ট বিকেলে বঙ্গভবনে খুনি খোন্দকার মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠানের তোড়জোড় শুরু করেন তিনজন- মন্ত্রিপরিষদ সচিব এইচ. টি. ইমাম, রাষ্ট্রপতির সচিব আবদুর রহিম এবং স্বঘোষিত মুখ্য সচিব মাহবুব-উল-আলম চাষী (সিআইএ'র চর বলে প্রমাণিত হওয়ায় পাকিস্তান আমলে চাকুরিচ্যুত) খুনি মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠানের ভাব-গাম্ভীর্য বৃদ্ধির জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিব এইচ. টি. ইমাম এবং রাষ্ট্রপতির সচিব আবদুর রহিম খুনি ডালিম-ফারুকদের সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠকে বসেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব এইচ. টি. ইমাম বঙ্গভবনে বসে রেড টেলিফোন থেকে সব মন্ত্রী ও সচিবদের ফোন করে খুনি রশিদ-ফারুক-ডালিমদের নাম করে ধমকাতে লাগলেন। যাতে তারা সবাই খুনি মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে শপথ নেন এবং সচিবরা উপস্থিত হয়ে অনুষ্ঠানের মান-মর্যাদা শ্রীবৃদ্ধি করে। বঙ্গভবনের শপথ অনুষ্ঠানে আমি, আমার সহকর্মী রবীন্দ্রনাথ ত্রীবেদী, কুমার শংকর হাজরা, আলী তারেক, ফরিদ উদ্দিন আহমদসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলাম। সেখানে এইচ. টি. ইমাম হাসিমুখে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের গর্বের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন-‘They are the savier & heroes. These heroes saved the nation. The nation is grateful to these heroes. Whole nation is behind them like rock and Himalaya...’সেখানে আমি জানতে পারি আর্মি অফিসাররা আগের রাতে কেবিনেট সচিব এইচ. টি. ইমামকে ১৫ আগস্টের প্রত্যুষে বঙ্গভবনে চলে আসার খবর দিয়ে রেখেছিল এবং সে মোতাবেক সে সকাল ৭টার মধ্যে স্যুটেড-ব্যুটেড হয়ে খুনি মোশতাকের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে ছুটে এসেছিল। খুনি মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনার সময় তিনি তাকে শপথের আগে 'মহামান্য' বলে এই খুনির নাম উচ্চারণ করে বলেন, 'এখন আমি মহামান্য খোন্দকার মোশতাক আহমদকে মহামান্য রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণের অনুরোধ করছি।' সেখানে উপস্থিত দেশি-বিদেশি সবাই দেখলেন, তিনি, আবদুর রহিম এবং মাহবুব-উল-আলম চাষী মোশতাকের ডানহাত হিসেবে একসঙ্গে চলাচল করছেন এবং একসঙ্গে কাজ করছেন। ১৬ আগস্টের দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় যেসব ছবি বেরিয়েছে তাতেও দেখা যাবে খুনি মোশতাকের ডানদিকে এইচ. টি. ইমামই আছে।
১৮ আগস্ট সোমবার প্রথমবারের মতো ভারতীয় রাষ্ট্রদূত শ্রী সমর সেন বঙ্গভবনে আসেন প্রেসিডেন্ট মোশতাকের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করতে। ১৫ আগস্ট ক্যুর সময় তিনি কলকাতা ছিলেন। ১৭ আগস্ট বিকালে তিনি কলকাতা থেকে ঢাকা আসেন। পরদিন দুপুরে আসেন বঙ্গভবনে। ১৮ আগস্ট রাত ১১টায় বন্ধু হাজরার মুখ থেকে যখন জানতে পারলাম 'ইসলামী প্রজাতন্ত্র' অথবা 'পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন' এর কোনটাই হবে না- তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আনন্দাশ্রুতে বুক ভাসিয়ে আমরা বঙ্গভবন থেকে বের হলাম। চোখের ওপর ভেসে উঠল একাত্তরের রণাঙ্গনে, রণাঙ্গনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা শত-সহস্র বীর মুক্তিযোদ্ধার লাশ, আর বাঙালি ভাই-বোনের রক্তে ভেসে যাওয়া কালো পিচ্ছিল দুর্বা ঘাস, মাঠ-ঘাট। ঠোঁট থেকে বেরিয়ে এলো 'জয় বাংলা', 'জয় বঙ্গবন্ধু'।
৩০ আগস্ট প্রত্যুষে ক্যান্টনমেন্টের বিভিন্ন রাস্তায় পেয়ে জওয়ান ও অফিসাররা ওই লিফলেট তারা নিজেরা দিয়েছে বলে প্রচার চালায়। তার মূল কারণ, খুনিরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার অহঙ্কারে এমন উন্মত্ত হয়ে ওঠে যে, সৈনিকদের কাছে তাদের স্ব স্ব রেজিমেন্টের সিনিয়র কমান্ডিং অফিসার কর্নেল, ব্রিগেডিয়ার ও জেনারেলদের অবজ্ঞা ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে ডাস্টবিনের মল-মূত্রের বস্তুতে পরিণত করে! সেজন্য মান-সম্মানে আঘাত পড়ায় ভেতরে ভেতরে সেনা অফিসাররা আগুন হয়ে ছিল ও টগবগ করে ফুটছিল।