মীযানুল করীম
মোশতাক, ভারত ও একটি আত্মজীবনী - সংগৃহীত
ইতিহাসের অনেক কিছুই রয়ে যায় অনুদঘাটিত। সব দেশ ও জাতির ক্ষেত্রে এবং প্রতিটি যুগেই এ কথা প্রযোজ্য। আমাদের বাংলাদেশও নয় ব্যতিক্রম। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত জাতীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ অনেক ঘটনা নিয়ে জাতির মনে বিরাট প্রশ্ন রয়ে গেছে। এর কারণ, বিষয়গুলো নিয়ে রহস্য ও অস্পষ্টতা। ফলে সন্দেহ, বিতর্ক, বিভ্রান্তি ইত্যাদির অবসান হয় না। যে যার দৃষ্টিকোণ থেকে সেসব ঘটনাকে দেখে, বিশ্লেষণ করে, অভিমত দেয়।
এ অবস্থায় বিভিন্ন ব্যাপারে মতভেদ যেমন সৃষ্টি হয়, তেমনি সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট তথ্যসমেত পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তবে আশার কথা হলো, সত্য একদিন প্রকাশ পাবেই। সময়ের সাথে সাথে অতীতের নানা ঘটনা যেন সুযোগ পাওয়া মাত্র স্বরূপ মেলে ধরে। আমাদের জাতীয় রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্ধকার কিংবা কুয়াশাচ্ছন্ন দিকগুলো একদিন আলোকিত হবে, এটা ধরে নেয়া যায়। এটা বলা যেতে পারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও কর্ম প্রসঙ্গেও।
‘৭৫-এর ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনার জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাদের যে নেতাকে প্রায় এককভাবে দায়ী করা হয়, তিনি খোন্দকার মোশতাক আহমদ। এই প্রবীণ নেতা আর শেখ মুজিব দুইজনই আওয়ামী লীগের জন্মলগ্নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। ১৯৪৯ সালের প্রতিষ্ঠাকালীন সে কমিটিতে মোশতাকের নাম মুজিবের আগে ছিল। এরপর দুইজনের সিকি শতাব্দীর রাজনৈতিক সহযাত্রায় সম্পর্কের কখনো কখনো হেরফের হলেও তা শেষাবধি ছিল মোটামুটি অম্লমধুর।
প্রসঙ্গক্রমে ১৯৭০ সালের কথা মনে পড়ে। খোন্দকার মোশতাক মাথায় টুপি দিতেন। আওয়ামী লীগবিরোধীরা বলতেন, এটা নাকি এক ধরনের ‘গান্ধি টুপি’। সম্ভবত পীর সাহেবের ছেলে হওয়ায় টুপি পরতেন। জানা যায়, মোশতাকের পরিবারের আদিনিবাস নড়াইল জেলায়। তার বাবা খোন্দকার কবীর উদ্দিন ছিলেন কুমিলøার দাউদকান্দির বারোপাড়ার পীর সাহেব।
১৯৭০ সালে মোশতাক ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। নির্বাচনী প্রচারে নেমে শেখ মুজিব বছরের প্রথম দিকে আমাদের ফেনী শহরে বিরাট পথসভায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন। কাছে দাঁড়ানো শ্রোতা হিসেবে আমার শুধু একটা কথাই মনে আছে তার বক্তৃতার। তা হলো, ‘আল্লার মাইর, দুনিয়ার বাইর।’ পরে মিজানুর রহমান চৌধুরী জনসভা করেন ফেনী সদর উপজেলার লেমুয়ায়। সেখানে বললেন, যদি কলাগাছও দাঁড়ায় নৌকাপ্রতীক নিয়ে, সেটাকে ভোট দিন। এ দিকে খোন্দকার মোশতাক গেলেন দাগনভূঞার জনসভায়। বললেন, ‘একটা কুকুরকেও যদি নৌকা মার্কার প্রার্থী করা হয়, তাকে ভোট দিয়ে জয়ী করতে হবে!’
স্মর্তব্য, ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকা শহরের টিকাটুলীর কাছে এ এম বশির সাহেবের রোজ গার্ডেনে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। এটাই ছিল নবগঠিত পাকিস্তানের জাতীয় পর্যায়ের প্রথম বিরোধী দল। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও শামসুল হক (টাঙ্গাইল) হন যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। সহসভাপতি হলেন আতাউর রহমান খান, সাখাওয়াত হোসেন ও আলী আহমদ খান। যুগ্ম সম্পাদক খোন্দকার মোশতাক আহমদ, শেখ মুজিবুর রহমান, এ কে রফিকুল হোসেন এবং কোষাধ্যক্ষ ইয়ার মোহাম্মদ খান। জেলে থেকেই মুজিব যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের ছাত্র থাকাকালে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ১৯৫৩ সালে তিনি যখন দলের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হন, তখন মূল সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক ভাষা আন্দোলনের কারণে জেলে। ১৯৫৫ সালে ‘মুসলিম’ বিসর্জন দিয়ে দলের নাম আওয়ামী লীগ করা হয় যে কাউন্সিলে, তাতে শেখ মুজিবই সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ততদিনে কারামুক্ত ও মানসিকভাবে অসুস্থ শামসুল হক জনারণ্যে হারিয়ে গেছেন। তিনি ছিলেন বাগ্মী, লেখক ও অসাধারণ জনপ্রিয় যুবনেতা।
মোশতাককে নিয়ে রহস্য
বাংলাদেশ হওয়ার পরপরই মোশতাককে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হলেও তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে গুরুত্ব হারিয়েছিলেন বলে দেখা যায়নি। মোশতাক বাণিজ্যমন্ত্রী হলেন। তখন গোপনে চীনের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রয়াস চলেছিল শীর্ষ নেতৃত্বের জ্ঞাতসারেই। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পার্লামেন্ট নির্বাচনে ভোট কারচুপির কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। তখন যে ক’জন নেতাকে জিতিয়ে আনার জন্য ক্ষমতাসীন দল অস্থির হয়ে গিয়েছিল, তাদের একজন সৌভাগ্যবান এই মোশতাক। দাউদকান্দিতে ভোটে জয়ী হচ্ছিলেন জাসদের আবদুর রশিদ ইঞ্জিনিয়ার। সেখানে ভোট গণনা না করে ব্যালট বাক্স হেলিকপ্টারে বঙ্গভবনে এনে মোশতাককে ‘বিজয়ী’ ঘোষণা করা হয়েছিল। এটা কেন ও কার স্বার্থে, এর জবাব মানুষ চাইবে আওয়ামী লীগের কাছেই। কিন্তু এর সদুত্তর আছে কি? খোন্দকার মোশতাক মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে মুজিবনগরের প্রবাসী রাজনৈতিক মহলে বিতর্কিত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি ‘মার্কিনপন্থী’ হিসেবে আগে থেকেই দলে পরিচিত ছিলেন। যুদ্ধের একপর্যায়ে পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশনের জন্য তৎপরতার দায়ে তিনি অভিযুক্ত ও সমালোচিত হন প্রবাসী সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে। স্মর্তব্য, ২৫ মার্চের আগে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে এই কনফেডারেশনভিত্তিক খসড়া সংবিধান তৈরির খবর প্রচারিত হয়েছিল। যা হোক, মুজিবনগরে কোণঠাসা সেই মানুষটি ’১৯৭২ থেকে ’৭৫-এর ১৪ আগস্ট পর্যন্ত যথারীতি মন্ত্রী ছিলেন মুজিবের মন্ত্রিসভায়। এ দিকে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন মন্ত্রিত্ব হারান ’৭৪ সালেই।
অনেকেই বলে থাকেন, তাজউদ্দীন আহমদের চেয়ে মোশতাক বঙ্গবন্ধুর বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সাথে সাথে প্রশ্ন জাগে, এটা কি অকারণে? নেতা কি তার বিশ্ব সঙ্গী কে, তা ২৬ বছরেও বুঝতে পারেননি? এ প্রশ্নের জবাবও পাওয়া যায় না। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট ছিলেন তাজউদ্দীন ১৯৬৬ থেকে ’৭১ পর্যন্ত। স্বাধীনতার পর তার ওপর নেতার ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ ও সন্দেহের হেতু কী, সে রহস্যও অজানা রয়ে গেল।
আমরা জানি না, আসলে কাদের পরামর্শে একদলীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা চালু করেছিলেন আজীবন বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা? তিনি কত বছরের জন্য এই চরম বিতর্কিত ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন, সেটাও স্পষ্ট হয়নি। ঠিক তেমনি জানা যায়নি ১৫ আগস্টের রক্তপাতের খবর পেয়ে রক্ষী বাহিনী নিষ্ক্রিয় থাকার কারণ। ১৯৭৩-৭৫ সালে জনমনে আতঙ্ক উদ্রেককারী এই বø্যাকশার্ট ফোর্স কি সেদিন নিজেরাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল? নাকি তারা পাল্টা অ্যাকশনে যাওয়ার কোনো অর্ডার পায়নি? এ যাবৎ কেউ বলেছেন- রক্ষী বাহিনী সাভারের ঘাঁটিতে তৈরি থাকলেও কমান্ডার কোনো নির্দেশ দেননি। কেউ বলছেন, আওয়ামী লীগের যে নেতা ছিলেন এই বাহিনীর মূল দায়িত্বে, তিনি নিজের নিরাপত্তা নিয়ে দিশেহারা কিংবা কিংকর্তব্যবিমূঢ় ছিলেন। যা হোক, জাতি দেখেছিল, রক্ষী বাহিনীও অবিলম্বে নতুন সরকারের আনুগত্য ঘোষণা করেছে তিন বাহিনী এবং পুলিশ-বিডিআরের সাথে।
এবার প্রকাশিত, মুজিবের অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ৩১০ পৃষ্ঠায় খোন্দকার মোশতাক প্রসঙ্গে টিকায় লেখা আছে, ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দক্ষিণ পন্থী অংশের নেতা ছিলেন। ... বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের মর্মান্তিক ও ষড়যন্ত্রমূলক হত্যায় তার গোপন সমর্থন ও সহায়তা ছিল বলে ধারণা করা হয়।’
আওয়ামী লীগ ষাটের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত দক্ষিণপন্থী হিসেবেই অভিহিত হতো। আত্মজীবনীর রচনাকাল ১৯৬৭-৬৯। এতে এক জায়গায় শেখ মুজিবুর রহমান অর্থনীতির ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্রের প্রতি তার সমর্থনের কথা ব্যক্ত করলেও সাথে সাথে জানিয়ে দেন যে, তিনি কমিউনিস্ট নন। তার ঐতিহাসিক ছয় দফাকে হেয় করার জন্য বামপন্থীরা বলতেন, ‘এর পেছনে আমেরিকার হাত আছে।’ আওয়ামী লীগে মার্কিনপন্থী অংশের প্রভাব ক্রমশ কমে আসে জাতীয়-আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট। মুক্তিযুদ্ধকালে মুজিবনগরে তাজউদ্দীন বনাম প্রধানমন্ত্রী মোশতাক দ্বন্দ্বের কথা সবার জানা।
বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীর টিকা ভাষ্য থেকে প্রমাণিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়, দলের মার্কিনপন্থী গ্রুপটি সক্রিয় ছিল বাংলাদেশ আমলেও। বলা হয়, খোন্দকার মোশতাকের সাথে ছিলেন প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুর, মুক্তিযুদ্ধকালীন পররাষ্ট্রসচিব মাহবুব আলম চাষী, যুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণাকারী প্রথম ক‚টনীতিক হোসেন আলী প্রমুখ। তবে মুজিবনগরে দলের যে সিনিয়র নেতার মাধ্যমে মোশতাক মার্কিন দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ রাখতেন বলে নথিপত্রে উল্লেখ আছে, সেই কাজী জহিরুল কাইয়ুম প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ নীরব।
আত্মজীবনীর টিকায় ১৫ আগস্টের ঘটনায় মোশতাকের সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, তার গোপন সমর্থন ও সহায়তা ছিল বলে ‘ধারণা করা হয়’। বাস্তবে আওয়ামী লীগ এমনভাবে প্রচার করে আসছে যে, তাতে মনে হবে- এ ঘটনার মূল হোতা মোশতাক এবং তা ‘নিঃসন্দেহে প্রমাণিত।’ আর মোশতাক বক্তব্যে এমন ধারণা দিতেন যে, ১৫ আগস্ট ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট সেনাকর্মকর্তাদের অনুরোধে তাকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিতে হয়েছে। প্রকৃত বিষয় আজো অনেকটা রহস্যাবৃত। মুজিব হত্যা মামলা দায়েরের আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন।
ভারত তখন কী ভাবত?
বঙ্গবন্ধুর সাথে ভারতের সম্পর্ক নিয়ে অনেক আলোচনা ও লেখালেখি হয়েছে। তাদের পরস্পরের প্রতি মনোভাব কেমন ছিল, তা নিয়ে নানাভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা যায়। তবে ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনা প্রসঙ্গে একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য। এ দিনের হত্যাকাণ্ডের অন্যতম নায়ক ছিলেন কর্নেল ফারুক। অবশ্য তিনি আবুধাবি থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। একবার ফারুক এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আমরা কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামের সাথে যোগাযোগ করেই ১৫ আগস্টের ঘটনা ঘটিয়েছি। ফোর্ট উইলিয়ামে ভারতের সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের হেডকোয়ার্টার। যা হোক, ভারতের রাষ্ট্রদূত সমর সেন ১৫ আগস্টের পর কালবিলম্ব না করে মোশতাকের সাথে সাক্ষাৎ করেন। বঙ্গভবনে সে সাক্ষাৎ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং বেশ দীর্ঘ হয়েছিল। মুজিব-পরবর্তী সরকারকে তড়িঘড়ি স্বীকৃতিদানের পরপরই ভারত মুজিব হত্যার প্রতিশোধকামীদের সশস্ত্র তৎপরতায় সর্বাত্মক সহযোগিতা দিতে শুরু করে। এতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, নয়াদিল্লির শাসকেরা তৎকালীন প্রেক্ষাপটে দুইপক্ষেই খেলতে চেয়েছেন বাংলাদেশকে নিয়ে।
এখন যারা ভারত ও বাংলাদেশ হরিহর আত্মা বলতে বলতে অজ্ঞান, তাদের জানা উচিত ১৯৭২-৭৫ সালে ‘দিলিøর দরবার’ মুজিবের ব্যাপারে কতটা হতাশ ও বিক্ষুব্ধ ছিল। আধিপত্যবাদী শক্তি চায় বশংবদ। তারা কোনো জাতীয়তাবাদী নেতাকে মাথা তুলতে দিতে চায় না। ভারতের একজন শীর্ষ কূটনীতিক জে এন দীন্ডিত তার লেখায় মুজিবকে নিয়ে ভারতের হতাশার কথা উল্লেখ করেছেন।
বিবিসিখ্যাত সাংবাদিক কলামিস্ট সিরাজুর রহমান শেখ মুজিবের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও স্নেহভাজন ছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘(১৯৭১ সালে) অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ইন্দিরা গান্ধী সরকারের সাথে সাত দফা চুক্তি করেছিলেন। অবশ্য তা না করে তার উপায় ছিল না। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় না হলে ভারতে আশ্রিত আওয়ামী লীগ নেতারা আর কখনো দেশে ফিরতে পারতেন না। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের আশার গুড়ে বালি ঢেলে দিলেন। তিনি সাত দফা চুক্তিটি নাকচ করে দেন। বাংলাদেশ থেকে সৈন্য সরিয়ে নিতে ইন্দিরা গান্ধীকে বাধ্য করেন। যে যাই বলুক, ভারতের পররাষ্ট্রনীতি, বিশেষ করে এশিয়াবিষয়ক পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করে র’। মুজিবের নীতিতে তারা খুবই নাখোশ হয়েছিল। মুখে যাই বলুন, মুজিবের হত্যায় র’ এবং একশ্রেণীর ভারতীয় নেতা মনে মনে খুশি হয়েছিলেন।... জিয়াউর রহমান গোড়া থেকেই মোটামুটি শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরূপ স্বাধীন রাষ্ট্রনীতি অবলম্বন করেন। এতে আরো একবার ভারতের হতাশার কারণ ঘটে। এ জন্যই দিল্লি জিয়াকে সুনজরে দেখেনি।’
সেই আত্মজীবীনীর হদিস নেই
গত ১২ আগস্ট দৈনিক ইত্তেফাকে বহুলালোচিত প্রবাসী কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী উপসম্পাদকীয় লিখেছেন ‘বঙ্গবন্ধুর সাথে একটি কল্প সাক্ষাৎকার’। এতে শুরুতেই জানিয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা সই করে তাকে অসমাপ্ত আত্মজীবনী উপহার দিয়েছেন। লন্ডনের বাসায় সেটা পড়তে পড়তে ঝিমুনি এসে যায়। তখন দেখেন বঙ্গবন্ধু তার সামনে হাজির। এরপর এই কলামিস্ট লিখেছেন, তিনি আমার হাতে তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটা দেখে বললেন, তোমার কি এই বই পড়ার দরকার আছে? তোমাকে আমি ১৯৭৩ সালে আমার আত্মজীবনী লেখার ডিকটেশন দেইনি? সেটাও অসমাপ্ত রয়েছে। বললাম, বঙ্গবন্ধু, তখন কিন্তু আপনি বলেননি- আপনি জেলে বসে বা অন্য কোনোখানে আপনার মধ্য বয়স পর্যন্ত আত্মজীবনী লিখেছেন।
বঙ্গবন্ধু মৃদু রহস্যময় হাসি হাসলেন। জবাব দিলেন না। আমি বইটা তাকে রেখে দিলাম। তার কাছে ফিরে এসে বললাম, আপনি টুঙ্গিপাড়া থেকে ঢাকায় না গিয়ে লন্ডনে চলে এলেন কেন? তিনি বললেন, ঢাকায় এখন আমার মৃত্যুদিবস পালন নিয়ে সাড়ম্বর আয়োজন চলছে। এতা আড়ম্বর যে, মনে হচ্ছে, আমার মৃত্যুটাই যেন ওদের কাছে সত্য, আমার আদর্শ ও সংগ্রাম ততটা সত্য নয়। আমার আদর্শ রেখে ওরা মাতমটাকেই বড় করে দেখছে।’
যদিও আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী কৌশল হিসেবে কাল্পনিক সাক্ষাৎকারের আশ্রয় নিয়েছেন, তবে এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ইউপিএল প্রকাশিত অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ব্যাপারে তার মনে বিরাট জিজ্ঞাসা রয়েছে। তার বর্ণনা মতে, এটা পড়ার যে প্রয়োজন নেই, তা স্বয়ং বঙ্গবন্ধুই স্বপ্নে জানিয়ে দিয়েছেন! তদুপরি জনাব চৌধুরী নেতার অন্য একটি আত্মজীবনীর কথা বলেছেন। এটি সম্পর্কে কেউ কেউ জানেন এবং আলোচনাও করেছেন। একজন প্রবীণ সাংবাদিক কিছুদিন আগে তার কলামে বলেছিলেন, স্বাধীনতার পর শেখ সাহেব ডিকটেশন দিয়ে আত্মজীবনী লিখে গিয়েছিলেন এবং এটা তার ঘনিষ্ঠ একজন তরুণ নেতার হেফাজতে ছিল। সেই নেতা এখনো আওয়ামী লীগের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে সক্রিয়।
কিন্তু সেই আত্মজীবনীর বিষয়ে তিনি কোনো দিন কিছু বলেননি। কিংবা জানা যায়নি মুজিব কন্যারা এটি সম্পর্কে জানেন কি না অথবা এর হদিস জানতে চেয়েছেন কি না। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর বক্তব্য থেকে পাঠকের মনে হবে, ডিকটেশন নিয়ে তার লেখা সেই আত্মজীবনীই পূর্ণাঙ্গ ও আসল। বঙ্গবন্ধু নাকি জেলে বসে আত্মজীবনী লেখার কথা তাকে জানাননি। এটা সত্য হলে এর কারণ কী, সে প্রশ্ন দেখা দেয়। আমরা স¤প্রতি প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে বিশের দশক থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত স্মৃতিচারণ পেয়েছি। ডিকটেশন দিয়ে লিখিত অন্য আত্মজীবীবনীটিতে এর পরের ঘটনাবলি থাকলে দুটো মিলিয়ে আমরা বাংলাদেশের একটা তথ্যপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইতিহাসগ্রন্থ পেতাম। তখন বক্তা ও নেতা শেখ মুজিবের লেখক পরিচয়ও ভালোভাবে ফুটে উঠত।