বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী রাজনীতি-সুভাষ সিংহ রায়

বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী রাজনীতি-সুভাষ সিংহ রায়
 
মৃত বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সামরিক সরকারের অস্বস্তি ও ভয় ছিল। মৃত বঙ্গবন্ধুকে মোকাবিলা করার জন্য ৪ আগস্ট ১৯৭৬ সালে ইতোপূর্বে জারি করা রাজনৈতিক দলবিধি সংশোধন করা হয়। প্রথমে জারি হওয়া দলবিধিতে ছিল, ‘ক্ষতিকর কার্যকলাপে লিপ্ত’ কোনো সংগঠনকে নিবন্ধন দেওয়া হবে না। একমাত্র আওয়ামী লীগকে ঠেকানোর জন্যই তা করা হয়েছিল। আবার ১৯৭৬ সালের ৪ আগস্টের সংশোধনীতে ক্ষতিকর কার্যকলাপের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ১০টি উপদফার উল্লেখ করা হয়। ১০ নম্বর উপদফায় বলা হয়, ‘কোনো জীবিত বা মৃত ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি বা উত্সাহিত করিবার জন্য পরিকল্পিত হয় বা উত্সাহিত করিতে পারে বলিয়া সম্ভাবনা রহিয়াছে।’ এ কথা এখন আর বলবার অপেক্ষা রাখে না, আওয়ামী লীগকে দলের শক্তি পুনরুদ্ধারে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখার জন্যই ‘রাজনৈতিক দলবিধি’-তে এই পরিবর্তন আনা হয়েছিল।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭৬ সালে সরকারি অনুমোদনের জন্য আবেদন করে। ঘোষণাপত্রে আওয়ামী লীগ ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি উল্লেখ করেছিল। সরকার আওয়ামী লীগকে অনুমোদন দিতে অস্বীকার করে। পরে আওয়ামী লীগ ঘোষণাপত্র থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি বাদ দিয়ে আবার আবেদন করলে ৪ নভেম্বর (১৯৭৬) দলটিকে অনুমোদন দেওয়া হয়। সেই সময় মওলানা ভাসানী অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সামরিক সরকার যথারীতি চিকিত্সার জন্য তাঁকে লন্ডনে পাঠায়। চিকিত্সা শেষে ১৯৭৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর দেশে ফিরে এসে বিমানবন্দরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের জানান, ‘দেশের জনগণ এই মুহূর্তে নির্বাচন চায় না। এদেশের জনগণ মুসলিম লীগ ও বিগত আওয়ামী লীগ আমলেও নির্বাচনের কোনো সুফল পায়নি। দেশের মানুষ এই মুহূর্তে নির্বাচন চায় কিনা, গণভোটের মাধ্যমে তা যাচাই করা দরকার।’ মওলানা ভাসানী আরো যা বলেছিলেন তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। ‘একটা বাজে গণপরিষদ কর্তৃক জণগণের উপর চাপিয়ে দেওয়া সংবিধান বাতিল করে সরকারের ভেতরের ও বাইরের বিশেষজ্ঞদের দিয়ে নতুন খসড়া সংবিধান তৈরির জন্য সরকারের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। নির্বাচন হইলে হানাহানি-কাটাকাটি হইবে। ইহা শান্তিপ্রিয় জনগণ চায় না। এই ধরনের নির্বাচনে ইতোপূর্বে যাহারা ক্ষমতায় গিয়াছিল... আবার তাহারাই ক্ষমতায় আসিবে।’ বস্তুতপক্ষে ভাসানীর এই দাবি ছিল সামরিক সরকারের ইচ্ছারই প্রতিফলন।

অর্থাত্ সেই সময়ও নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় ফিরে আসবে, এ রকম আশঙ্কা ছিল মওলানা ভাসানীর। তাই তিনি চেয়েছিলেন, নির্বাচন যাতে না হয়। তাছাড়া আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগিশের ভূমিকাও খুব ন্যক্কারজনক ছিল।

দুই.

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ নাম দুটো ছিল নিষিদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের অনেক বড় বড় নেতা খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় গিয়েছিলেন। কেউ কেউ সজ্ঞানে গিয়েছিলেন আবার কেউ কেউ পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়েছিলেন। যারা বাধ্য হয়ে গিয়েছিলেন তারা বেঁচে থাকা অবস্থায় প্রায়শ্চিত্তও করেছেন। তাদের অনেকে দেশের চরম ক্রান্তিলগ্নে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার চেষ্টা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর সময় অশোক গুপ্ত নামের একজন ভারতীয় কূটনীতিক ছিলেন বাংলাদেশে। তিনি পরবর্তীতে একটি বই লিখেছিলেন, ‘কনফিডেন্সিয়াল ডায়েরি’; তাঁর ছদ্মনাম ছিল বিক্রমাদিত্য। আওয়ামী লীগের আজকের নেতাকর্মীদের এই বইটা পড়া উচিত। সেই সময়টা ছিল ভয়াবহ এবং রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্র ছিল বঙ্গবন্ধু ও পরিবারের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারপূর্ণ। ১৯৭৬ সালের বাংলাদেশে একুশে ফ্রেবুয়ারি উপলক্ষে তিনটি কমিটি হয়েছিল। একটি ছিল আওয়ামী ঘরানা হিসেবে চিহ্নিত ‘কেন্দ্রীয় শহীদ দিবস উদ্যাপন কমিটি’; এই কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন কবি জসিম উদ্দিন ও খন্দকার মোহম্মদ ইলিয়াস। তার পাল্টা কমিটি হিসেবে গঠিত হয়েছিল মীর্জ্জা গোলাম হাফিজ ও এনায়েতুল্লাহ খানের নেতৃত্বে। তাছাড়া ছাত্রদের আরেকটি কমিটি হয়েছিল, সেটার নাম ছিল ‘একুশে উদযাপন ছাত্রসমাজের জাতীয় কমিটি’। মীর্জ্জা গোলাম হাফিজ ও এনায়েতুল্লাহ খান কমিটিতে যাদের নাম ছিল তাদের অনেকেই এখন বঙ্গবন্ধুর সাচ্চা প্রেমিক হিসেবে পরিচিত। এই কমিটি পুরোটা উপস্থাপিত হলে অনেক বিজ্ঞজন এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়বেন। পত্রপত্রিকায় বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার নিয়ে বানানো সব গল্প পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছিল। এটা একটা বিশাল গবেষণার বিষয় সব জ্ঞানী গুণীজনরা কী কারণে জিয়াউর রহমানের কাছে আত্মসর্মপণ করেছিলেন। ১৯৭৭ সালের ২৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক শামসুল হক, ২২ জুন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সৈয়দ আলী আহসান ও ২৮ জুন অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ জিয়াউর রহমান সাহেবের উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। এই জন্য ড. হুমায়ুন আজাদ তাঁর প্রবচন গুচ্ছে লিখেছিলেন, ‘বাংলার বিবেক খুবই সন্দেহজনক। বাংলার চুয়াত্তরের বিবেক সাতাত্তরে পরিণত হয় সামরিক একনায়কের সেবাদাসে।’ সবসময় মনে রাখা দরকার, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ১৯৭১ সাল থেকে শুরু হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদের সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বোস্টারের প্রথম বৈঠক হয়। এ সম্পর্কে ২০ আগস্ট প্রেরিত তারবার্তায় বোস্টার লিখেছেন, ‘...মোশতাক বলেছিল, যে সুযোগ একাত্তরে হারিয়েছি, তা এবার আর হাতছাড়া করা যাবে না।’ ভারতের বিখ্যাত সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত একটা বই লিখেছিলেন ‘Midnight Massacre in Dacca’। এই বইটি প্রকাশের সাথে  সাথে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এই বইয়ে সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত স্পষ্ট করে লিখেছেন, জিয়াউর রহমান সাহেব বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদকে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিল এবং তাজউদ্দিন সাহেবের সহযোগিতা চেয়েছিল এবং যথারীতি তাজউদ্দিন আহমেদ তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিল। লে. কর্নেল (অব.) এম এ হামিদ ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’ এই শিরোনামে একটি বই লিখেছেন। ১৯৭৫ সালের প্রথম দিকে জিয়াউর রহমানকে রাষ্ট্রদূত করে পূর্বজার্মানি অথবা বেলজিয়ামে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল। জিয়াউর রহমান সাহেব বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা সাইদুর রহমানের সহযোগিতায় সেই সময়ে দেশের বাইরে পোস্টিং ঠেকিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর সাইদুর রহমান সাহেব লে. কর্নেল হামিদ সাহেবকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘কর্নেল সাহেব, আপনার জন্যই ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর এবং ৭ নভেম্বর সংগঠিত হলো। আপনিই সেই যে জিয়াউর রহমানের পোস্টিং ক্যানসেল করানোর জন্য আমাদেরকে কাজে লাগিয়েছিলেন, সেটাই কাল হলো। জিয়া না থাকলে তো এ তিনটা অভ্যুত্থানের কোনোটাই হতো না।’

তিন.

পাকিস্তানের কাছে আমাদের অনেক পাওনা। অথচ এ কথা কাউকে বলতে শুনি না। সেই সময়ের এক হিসাব অনুযায়ী যুদ্ধের অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি ২১-২৩ বিলিয়ন ডলার বলে ধারণা করা হয়েছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে দাতাদের অব্যাহত চাপের ফলে বাংলাদেশ পাকিস্তানের ঋণের এক অংশের দায় মেনে নিতে বাধ্য হয়। অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর সময়ে জাতীয় পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি ‘বাংলাদেশ জাতি গঠনকালে এক অর্থনীতিবিদের কথা’ নামে এক অসাধারণ বই লিখেছেন। স্পষ্ট বোঝা যায় বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কাছে পাওনা আদায়ের ব্যাপারে ভীষণ রকমের ছিলেন। সর্বশেষ ১৯৭৪ সালে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, কিভাবে পাকিস্তান আমাদের পাওনা পরিশোধ করবে। পাকিস্তান এটা মোটেই ভালোভাবে নেয়নি। যে কারণে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছিল। (ক) পাকিস্তান নীতিগতভাবে সব সম্পদ ও দায় সমানভাবে ভাগ করে নেবে, (খ) একটি যৌথ কমিশন এ বিষয়ে বিস্তারিত পরীক্ষা করে দেখবে, এবং (গ) পাকিস্তান দুই মাসের মধ্যে কিছু অর্থ তার সদিচ্ছার প্রতীক হিসেবে বাংলাদেশকে প্রদানের উদ্যোগ নেবে। প্রথম কিস্তিতে সহজে হিসাবযোগ্য সম্পদ দিয়ে পরিশোধ করা হবে, যেমন, স্বর্ণ ও বৈদেশিক মুদ্রা, বেসামরিক বিমান ও জাহাজ। এই প্রতীকী অর্থ প্রদানের পরিমাণ ২০০ থেকে ৩০০ মিলিয়ন ডলার ধার্য করা হয়। এটি ছিল সমগ্র পরিশোধ ও বণ্টনযোগ্য সম্পদের একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। তা ছাড়া অন্যদিকে বাংলাদেশ এরই মধ্যে পাকিস্তানের বৈদেশিক দায় ভাগ করে নিয়েছিল।

১৯৭৫ সালে কমনওয়েলথ রাষ্ট্রের প্রধানদের কনফারেন্সেও তিনি এই ইস্যু উত্থাপন করেন। এমনকি ১৯৭৫-এর জুলাই মাসে ইসলামি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনেও প্রসঙ্গটি আলোচিত হয়।

বাংলাদেশ এ বিষয়ে আগাম আশ্বাস দিয়ে রাখতে রাজি যে, সে মধ্যস্থতাকারীর প্রস্তাব মেনে নেবে। বাংলাদেশ এর আগেও পাকিস্তানের কাছে বন্ধু আরব আমিরাতের নাম মধ্যস্থতাকারী হিসেবে প্রস্তাব করে। কিন্তু পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা সম্মেলনে এ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় রাজি ছিলেন না। বাংলাদেশের আহ্বানে তারা সাড়া দেননি। ইসলামাবাদ ফিরে গিয়ে পাকিস্তান সরকার এ বিষয়ে উত্তর জানাবে বলে আশ্বাস দেয়। সেই উত্তর কখনোই আসেনি। পাকিস্তান বুঝে গিয়েছিল শেখ মুজিব বেঁচে থাকলে পাওনা টাকা আদায় করে ছাড়বে।

অধ্যাপক নরুল ইসলাম লিখেছেন, ১৯৭৫-এর আগস্ট মাসে বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসে। ক্ষমতা দখলের সঙ্গে সঙ্গেই অভ্যুত্থানকারী সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে। অনিষ্পন্ন বিষয়গুলোর সুরাহা না করেই ওই পদক্ষেপ নেওয়া হয়।’ এইজন্য বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের আগে ও পরে পাকিস্তান দূতাবাস নানাভাবে সক্রিয় ছিল। এখনো অনেকের ঘাড়ে পাকিস্তানি ভূত চেপে বসে আছে। বঙ্গবন্ধুর আর্দশের সৈনিকদের দায়িত্ব এদের শিকড় উপড়ে ফেলার।

লেখক :রাজনৈতিক বিশ্লেষক

SUMMARY

1591-B3.jpg