স্মৃতিতে শেখ কামাল ও আবাহনী

পাভেল রহমান  


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল বললেন, 'পাভেল, আজ সন্ধ্যায় আবাহনীর সবাই যাব গণভবনে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে। তুমি চলে এসো।'

কামাল ভাইয়ের কথায় খুশিতে নেচে উঠল মনটা। প্রিয় আবাহনী আরো প্রিয় হয়ে উঠল। আবাহনীর ছবি তুলব আমি, তাও আবার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে! সেই সকাল কখন সন্ধ্যা হবে! সময় কাটবে কী করে! অস্থির আমি। ধানমণ্ডির সঙ্গে শঙ্কর বাসস্ট্যান্ড। তার পাশের গলিতে জাফরাবাদে একটা দোতলা বাড়ির গেটে সন্ধ্যার আগেই পৌঁছে গেলাম। গেট দিয়ে ঢুকতে যাব অমনি কালো ইয়া ভুঁড়িওয়ালা (লোকমান) একজন আটকে দিল আমার পথ। কামাল ভাইয়ের নাম শুনে বেরিয়ে এলো সাদা ঝকঝকে এক পাটি দাঁত। বললেন, 'আপনি ভেতরে বসেন। কামাল ভাই এসে পড়বেন।'

আমি বসলাম ম্যানেজারের (সুভাষ বাবুর) অফিস ঘরে।

ওই ঘরে বসে আমি যেন স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। বিখ্যাত সব খেলোয়াড় আমার পাশ দিয়ে হাঁটাহাঁটি করছেন দেখে আমি অস্থির হয়ে উঠলাম। শর্টস পরিহিত সামসু ভাই, অমলেশ দাদা, সালাউদ্দিন ভাই, নান্নু, চুন্নু খবরের কাগজের পাতায় দেখা স্টারগুলো জীবন্ত আমার পাশ দিয়ে হেঁটে যায়। চোখের পাতা যেন আটকে আছে। সময় কেটে যায়, মিনিটের মতো ঘণ্টা।

কামাল ভাই এলেন সন্ধ্যার সামান্য আগ দিয়ে। বললেন, 'পাভেল, উঠে পড়ো গাড়িতে, আমরা এখনই রওনা হব।'

কোন গাড়িতে উঠব সংকোচ করছি আমি। কামাল ভাই তুলে নিলেন তাঁর গাড়িতেই, নীল রঙের টয়োটা করোলায়। জাফরাবাদ, শঙ্কর, ধানমণ্ডি ২৭ ধরে আমরা চলেছি গণভবনে, বঙ্গবন্ধুর কাছে।

সন্ধ্যাবাতি কেবলই জ্বলে উঠেছে। গণভবনের গাঢ় সবুজ লনের ঘাস আজ যেন আরো সবুজ দেখাচ্ছে। দিনের আলো তখনো আকাশে। লনটার এক কোণে একটি ইজি চেয়ারে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে বঙ্গবন্ধু বসেন। তাঁর হাতে সেই বিখ্যাত পাইপ। আবাহনীর খেলোয়াড়-কর্মকর্তা- দলের সবাই তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। হালকা আলোয় দেখি বঙ্গবন্ধুর সেই শিশুসুলভ হাসি।

আবাহনী ক্লাবের পক্ষে ফুলের মালা পরিয়ে প্রথমেই শুভেচ্ছা জানালেন কামাল ভাই। তারপর অন্যরা। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল ভাই ছিলেন আমাদের সঙ্গে। আমি ছবি তুলছি ৩৫ মিমি ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্সে। বঙ্গবন্ধু সবার সঙ্গেই হাত মেলাচ্ছেন। মাঝেমধ্যে বিখ্যাত সব খেলোয়াড়ের সঙ্গে কৌতুক করছেন। অনুষ্ঠানের শেষে ঘটল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম ঘটনা। কামাল ভাই আমার নাম ধরে ডাকলেন। সামনে বঙ্গবন্ধু। আমাকে নিশ্চয়ই ছবি তোলার জন্য ডাকছেন। কামাল ভাই অনেকটা ঠেলে দিলেন আমাকে বঙ্গবন্ধুর দিকে। বললেন, 'আব্বা, ওর নাম পাভেল! ও আমাদের আবাহনীর ফটোগ্রাফার।' আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়! বঙ্গবন্ধু কামাল ভাইয়ের কথায় বিস্মিত, 'তোদের আবাহনীতে ফটোগ্রাফারও আছে নাকি?' কামাল ভাই বললেন, 'হ্যাঁ আছে। ওর নাম পাভেল।' বঙ্গবন্ধু ততক্ষণে আমার হাত ধরে কাছে টেনে নিয়েছেন। বিস্মিত বঙ্গবন্ধু বলে উঠলেন, 'বাহ, কী চমৎকার নাম!' আমার হাত তখন বঙ্গবন্ধুর হাতে। আমি এতটাই হতবিহ্বল হয়ে পড়লাম যে কোনো কথাই বলতে পারলাম না।

সেই সন্ধ্যার স্মৃতিটা মনের গহনে আজও মধুর হয়ে জ্বলজ্বল করছে। জীবনে এত বড় স্বীকৃতি দিয়ে গেলেন নিরহংকার কামাল ভাই। আমার মতো ক্ষুদ্র একজন আলোকচিত্রী, সবে স্কুল ছেড়েছি, জীবনের বিশাল পাওয়া যেন আমি পেয়ে গেলাম সেদিনই। সেই আমার আবাহনীর সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া। প্রতিদিন খুব কাছে থেকে দেখি কামাল ভাইকে। রাষ্ট্রপ্রধানের ছেলে হয়েও নেই কোনো অহংকার! এতটুকু হুকুমের স্বরে কথা বলেন না তিনি কারো সঙ্গে। আবাহনী ক্লাবের সেই কালো মানুষটি, একজন ক্ষুদ্র পিয়ন, যিনি মকবুল নামে সবার কাছে পরিচিত, ক্লাব সভাপতি শেখ কামাল তাঁকে আপনি সম্বোধন করে ডাকতেন। ছোট-বড় সবাইকে সম্মান করতেন।

কামাল ভাইয়ের সারা দিন কাটত ছকবাঁধা নিয়মে। সকাল ৬টায় আসতেন সেতার-এস্রাজের ওস্তাদ। ৭টায় আবাহনী ক্লাবে। খেলোয়াড়দের অনুশীলন তদারকির পর তাদের সকালের নাশতা থেকে রাতের খাওয়ার মেন্যু তৈরি করা, ৩২-এ ফিরে পরিবারের সঙ্গে নাশতার টেবিলে উপস্থিত থাকা, সকাল ৯টায় ডিপার্টমেন্টের ক্লাস- সব কিছুতেই তাঁর ছিল সরব উপস্থিতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগের অনার্সের ছাত্র ছিলেন তিনি। প্রায় সারা দিন থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয় পাড়ায়। বিকেলে ঢাকা স্টেডিয়ামের প্রতিটি খেলায় তাঁর ছিল স্বাভাবিক উপস্থিতি। নতুন প্রজন্মের ক্রীড়ানৈপুণ্য প্রদর্শনে পারদর্শী আবাহনীর জয় ছিল স্বাভাবিক। আর এই জয়কে স্মরণীয় করতে তিনি টিমের খেলোয়াড়, কর্মকর্তা- সবাইকে নিয়ে রাতের ডিনারের আয়োজন করতেন। কামাল ভাই শুধু নতুন প্রজন্মের আবাহনী ক্রীড়াচক্রকেই সারা দেশে জনপ্রিয় করে তোলেননি, সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও চমক সৃষ্টি করেছিলেন স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠীর মাধ্যমে। নতুন শিল্পীতে ভরে উঠেছিল স্পন্দন। কামাল ভাই সময় পেলেই নিজেও অংশ নিতেন মঞ্চের অনুষ্ঠানে। ১৯৭৫ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি বইমেলায় বাংলা একাডেমি মঞ্চে 'নবান্ন' নাটকটিতে ম হামিদ ও কামাল ভাই দারুণ এক মেকাপে স্টেজে এসেছিলেন। তাঁদের অভিনয়ও ছিল এককথায় অনন্য।

কামাল ভাই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানীর এডিসি। অনারারি ক্যাপ্টেন। তিনি এতটাই সামাজিক ও সংস্কৃতিমনা ছিলেন যে দেশের সেরা ক্রীড়াবিদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ব্লু, দেশের সেরা অ্যাথলেট খুকিকে বঙ্গবন্ধু পুত্রবধূ হিসেবে গণভবনে আমন্ত্রণ জানালেন। আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে 'কনে' দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে মত দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহধর্মিণী ফজিলাতুননেসা মুজিবের জীবনের প্রথম এবং শেষ আনন্দ ছিল ওই বিয়ের অনুষ্ঠানটি। কামাল ভাই এতটাই সহজ-সরল জীবন যাপন করতেন যে বরযাত্রায় তাঁর পুরনো টয়োটা গাড়িটিই রং করিয়ে নিয়েছিলেন।

যে মানুষটি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ক্রীড়া-সংস্কৃতি ছাড়া কিছুতেই মন দিতেন না, সেই মানুষটিকে আজ আমাদের কী দারুণ প্রয়োজন ছিল, তা ভাবলে কষ্টে মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।

লেখক : সাংবাদিক

SUMMARY

1585-1.jpg