জাতির জনকের অমর স্মৃতি
তোফায়েল আহমেদ
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে আমার অনেক স্মৃতি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছিল ১৪ আগস্ট। আমার বাসা ছিল ধানমন্ডিতে- এখন যেখানে আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয়, তার পাশেই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানের বাসভবন, সেটিই তখন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিবের বাসভবন। প্রতিদিনের মতো সকালবেলা ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে যাই। সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গণভবনে গিয়েছিলাম। দিনের কাজ শেষে দুপুরবেলা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একই টেবিলে বসে একসঙ্গে খেয়েছি। বাসা থেকে বঙ্গবন্ধুর খাবার যেত। শ্রদ্ধেয়া ভাবী ফজিলাতুন্নেছা মুজিব- যিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গী। সুখে-দুঃখে, আপদে-বিপদে যিনি বঙ্গবন্ধুকে যত্ন করে রাখতেন। নিজ হাতে রান্না করে বঙ্গবন্ধুকে খাওয়াতেন। খাবার শেষে বঙ্গবন্ধু বিশ্রাম নিলেন। বিকাল ৫টায় প্রথমে সাক্ষাৎ করলেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূতের সঙ্গে। তারপর গণভবনের মাঠে হাঁটলেন অনেকক্ষণ। এবিএম মূসা- কিছুদিন আগে যিনি মৃত্যুবরণ করেছেন, তার সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করলেন। এরপর এসে গণভবনে নিজ কক্ষে বসলেন। বঙ্গবন্ধু প্রায় প্রতিদিন বিকালে মন্ত্রিসভার সহকর্মীদের সঙ্গে দৈনন্দিন রাজনৈতিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করতেন। একসঙ্গে চা পান করতেন। এরপর রাত ৮টায় স্বীয় বাসভবনে ফিরতেন। বঙ্গবন্ধুকে পৌঁছে দিয়ে আমি বাসায় আসতাম। যেতামও একসঙ্গে আসতামও একসঙ্গে। গণভবনে যেখানে বঙ্গবন্ধুর অফিস ছিল সেখানে তিনি বেলা ২টা পর্যন্ত অফিস করতেন। গণভবনের পাশে এখন যেখানে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অফিস সেটি ছিল বঙ্গবন্ধুর অফিস। বঙ্গবন্ধুর অফিস কক্ষের পাশেই আমার দফতর। সেদিন বঙ্গবন্ধুর যুগ্ম সচিব মনোয়ারুল ইসলাম এবং ব্যক্তিগত সচিব ফরাসউদ্দীন এই দুজন পিএইচডি করতে বিদেশ যাবেন এ উপলক্ষে কর্মকর্তাদের নৈশভোজ। নৈশভোজ শেষে তাদের বিদায় করে আমি আবার ৩২ নম্বরে এলাম। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু তখন খাবার টেবিলে। আমাকে কাছে ডেকে বললেন, 'কাল সকালে আমার বাসায় আসবি। তুই তো ডাকসু'র ভিপি ছিলি। তুই আমার সাথে তোর প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাবি।' এই কথা বলে আমি এবং বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা অফিসার মহিউদ্দীন, যিনি মুন্সীগঞ্জ থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং মুন্সীগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি- প্রথমে আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে তার বাসায় চলে গেলেন।
আজ এই পড়ন্ত বেলায় বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে কত কথা, কত স্মৃতি মনের চারপাশে ভিড় করছে। বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখি ১৯৫৭ সালে ভোলার সরকারি স্কুল মাঠের উপনির্বাচনী জনসভায়। তখন আমি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। ভোলায় অনুষ্ঠিত এক জনসভায় সোহরাওয়ার্দী সাহেব ও বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা করেছিলেন। আমরা স্কুলের ছাত্ররাও এসেছিলাম আমাদের রূপকথার নায়ক প্রিয় নেতার বক্তৃতা শোনার জন্য। কৈশোরের সে অনভূতি ভাষায় ব্যক্ত করার নয়। অনেক দূর থেকে মুজিব ভাইয়ের সুন্দর গোছানো বক্তৃতা মন্ত্র-মুগ্ধের মতো শুনেছি।
মনে পড়ে ১৯৬৭-এর ১৭ জানুয়ারির কথা। সেদিন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহ-সভাপতি নির্বাচিত হই। তখন ৬ দফার আন্দোলন চলছে। বঙ্গবন্ধু কারাগারে অন্তরীণ। সেদিন তার নিজ হাতে লেখা একটা গোপন পত্র পাই। তিনি লিখেছেন- 'স্নেহের তোফায়েল, তুই ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হওয়ায় আমি খুব খুশি হয়েছি। আমি বিশ্বাস করি, এই ডাকসুর নেতৃত্বে বাংলাদেশে একটি আন্দোলন গড়ে উঠবে- মুজিব ভাই।' ১৯৫৭-তে প্রিয় নেতাকে প্রথম দর্শনের যে অনুভূতি, এরপর ১০ বছরের ব্যবধানে তার কাছ থেকে পাওয়া চিঠি এবং সেই চিঠিতে আমাদের সাফল্য কামনা করে ডাকসুর নেতৃত্বে আন্দোলন গড়ে উঠবে এমন নির্দেশনা যে কী পরিমাণে উজ্জীবিত করেছে তা ১৯৬৯-এর তুমুল গণঅভ্যুত্থানের সাফল্যগাথাতেই দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
১৯৭০-এ বরিশাল-পটুয়াখালী-ভোলা অঞ্চলে নির্বাচনী সফরে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু। '৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ৬ দফা এবং ছাত্রসমাজের ১১ দফার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করে। এ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু আমাকে জাতীয় পরিষদে মনোনয়ন দেন এবং মাত্র ২৭ বছর ১ মাস ১৫ দিন বয়সে আমি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হই, যা আমি স্বপ্নেও কল্পনা করিনি। ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোলায় নির্বাচনী জনসভা। এদিন ছিল ভোলার ইতিহাসে সর্ববৃহৎ গণসমাবেশ। আমাকে ভোলার জনগণের হাতে তুলে দিয়ে বঙ্গবন্ধু আমার গুণবাচক বৈশিষ্ট্যগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে প্রশংসাসূচক যে বক্তৃতা করেছিলেন তা আজও আমার স্মৃতিতে অম্লান। নেতা-কর্মীদের তিনি ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করতেন। যখন যে এলাকায় যেতেন সে এলাকার সংগঠক বা নেতা-কর্মীকে মহিমান্বিত করে বক্তব্য রাখতেন। নিজে কর্মী থেকে সংগঠক, সংগঠক থেকে নেতা, নেতা থেকে জাতীয় নেতা এবং পরিশেষে জাতীয় নেতা থেকে জাতির জনক হয়েছেন। আর এটি সম্ভবপর হয়েছে অসংখ্য কর্মীকে তিনি নেতা বানিয়েছেন, অসংখ্য নেতাকে স্থানীয় পর্যায় থেকে উন্নীত করেছেন জাতীয় নেতায়। ফলে সারা দেশে আওয়ামী লীগ তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে বহু চড়াই-উতড়াই পেরিয়ে আজও বঙ্গবন্ধুর চেতনা ধারণ করেই টিকে আছে।
'৭১-এর জানুয়ারির ৩ তারিখের কথা। ঐতিহাসিক রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে '৭০-এর নির্বাচনে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। শপথ গ্রহণ করাবেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। সেদিন বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, '৬ দফা ও ১১ দফা আজ আমার নয়, আমার দলেরও নয়- এটা আজ বাংলার জনগণের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। কেউ যদি এর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে, তবে বাংলার মানুষ তাকে জ্যান্ত সমাধিস্থ করবে। এমনকি আমি যদি করি আমাকেও।' জনগণের জন্যই ছিল তার রাজনীতি ও কর্মসূচি। তিনি তার বক্তৃতায় সেদিন আরও বলেছিলেন, 'আমাকে মোনেম খান কাবু করতে পারেনি, এমনকি আয়ুব খানও পারেনি, কিন্তু আমাকে দুর্বল করে দিয়েছে আপনাদের এই অকুণ্ঠ ভালোবাসা। আপনারা দোয়া করবেন, যেন আপনাদের এই ভালোবাসার মর্যাদা দিতে পারি।' বাংলার মানুষের প্রতি ভালোবাসার মর্যাদা তিনি রক্ত দিয়ে পরিশোধ করে গেছেন। কবিগুরুর ভাষায়- 'আমৃত্যু দুঃখের তপস্যা এ জীবন, সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে, মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে দিতে।'
১৯৭১-এর রক্তঝরা মার্চের ১৭ তারিখ ছিল বঙ্গবন্ধুর ৫২তম জন্মদিন। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা শেষে দুপুরে ধানমন্ডির বাসভবনে বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে ঘরোয়া আলোচনাকালে একজন সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন, '৫২তম জন্মদিনে আপনার সবচাইতে বড় ও পবিত্র কামনা কী?' উত্তরে বঞ্চিত বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা স্বভাবসিদ্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন, 'জনগণের সার্বিক মুক্তি।' এরপর সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জ্ঞাপনকালে তিনি ব্যথাভারাতুর কণ্ঠে বেদনার্ত স্বরে বলেছিলেন, 'আমি জন্মদিন পালন করি না- আমার জন্মদিনে মোমের বাতি জ্বালি না, কেকও কাটি না। এ দেশে মানুষের নিরাপত্তা নাই। আপনারা আমাদের জনগণের অবস্থা জানেন। অন্যের খেয়ালে যে কোনো মুহূর্তে তাদের মৃত্যু হতে পারে। আমি জনগণেরই একজন, আমার জন্মদিনই কী, আর মৃত্যুদিনই কী? আমার জনগণের জন্য আমার জীবন ও মৃত্যু।' কত বিশাল হৃদয়ের মহৎ মনের অধিকারী মানুষ ছিলেন তিনি। নিজের সবকিছুই তিনি জনগণের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন।
অতি সাধারণ জীবন ছিল তার। রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়েও সরকারি বাসভবনে থাকতেন না। নিরাভরণ, ছিমছাম আর আটপৌড়ে ৩২ নম্বরের বাড়িটিতেই আমৃত্যু থেকেছেন। ধানমন্ডিতে যখন প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয় তখন ভালো একটি প্লট নেওয়ার জন্য সবার শত অনুরোধ সত্ত্বেও বলেছিলেন, 'আগে সবাইকে দাও, তারপর যদি থাকে তখন দেখা যাবে।' নিজের জন্য কিছুই চাইতেন না। অপরের দুঃখ-কষ্টের প্রতি অপরিসীম দরদ তাকে সর্বদাই আবেগাপ্লুত করত। একবার এক জনসভায় তিনি বলেছিলেন, 'একজন মানুষ আর কী চাইতে পারে, আমি যখন ভাবি দূরে এক জনশূন্য পথের ধারে আধো আলো-ছায়ায় এক লোক লণ্ঠন হাতে দাঁড়িয়ে আছে শুধু আমাকে একনজর দেখবে বলে, তখন মনে হয়, একজন মানুষের পক্ষে আর কী চাওয়া-পাওয়ার থাকতে পারে।' নিরন্ন-হতদরিদ্র-মেহনতী মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর প্রগাঢ় ভালোবাসা প্রতিফলিত ও অভিব্যক্ত হয়েছে তার প্রতিটি কর্মে এবং চিন্তায়। '৭৩-এর ৯ সেপ্টেম্বর, আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, 'বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত শোষক আর শোষিত; আমি শোষিতের পক্ষে।'
মনে পড়ে, '৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় দেরাদুনে মুজিব বাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্পে শপথ গ্রহণের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলোর কথা। শপথনামা পাঠকালে সমস্বরে আমরা বলতাম- 'বঙ্গবন্ধু মুজিব, তুমি কোথায় আছ, কেমন আছ আমরা জানি না। কিন্তু যতদিন আমরা প্রিয় মাতৃভূমি এবং তোমাকে মুক্ত করতে না পারব, ততদিন আমরা মায়ের কোলে ফিরে যাব না।' সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী দিনগুলোতে বাঙালির চেতনায় বন্দী মুজিব ছিলেন মুক্ত মুজিবের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। যারা ষড়যন্ত্রকারী তাদের হোতা খুনি মোশতাক তো তখনই আমাদের কাছে প্রশ্ন তুলেছিল, 'জীবিত মুজিবকে চাও, না স্বাধীনতা চাও।' আমরা বলতাম, 'আমরা দু'টোই চাই। স্বাধীনতাও চাই, বঙ্গবন্ধুকেও চাই।' ৩০ লাখ প্রাণ আর চার লক্ষাধিক মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা বাংলার স্বাধীনতা এবং বঙ্গবন্ধু মুজিবকে মুক্ত করতে পেরেছিলাম।
অতুলনীয় দক্ষ সংগঠক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রত্যেককে দেখতেন নিজ পরিবারের সদস্যের মতো। প্রতিটি নেতা-কর্মীর বিপদ-আপদে তিনি তাদের পাশে দাঁড়াতেন পরম হিতৈষীর মতো। মমতা মাখানো সাংগঠনিক প্রয়াস নিয়ে কর্মীদের হৃদয় জয় করে নেওয়ার ব্যতিক্রমী এক ক্ষমতা ছিল তার। '৭২-এর ১৪ এপ্রিল, আমি তখন গ্যাস্ট্রিক-আলসারে আক্রান্ত হয়ে হলি ফ্যামিলিতে চিকিৎসাধীন। আমার পাকস্থলীতে নালি-ঘায়ের অপারেশন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু আমাকে দেখতে এসেছেন। স্বস্নেহে আমার হাত ধরে, পরম মমতায় কপালে হাত বুলিয়ে আদর করে আমার খোঁজখবর নিয়েছিলেন। আমার একমাত্র কন্যা মুন্নী যখন ২য় শ্রেণিতে পড়ে তখন টিভিতে ওর অনুষ্ঠান দেখে ওকে স্নেহাশীষ জানিয়েছিলেন। অপরিসীম ভালোবাসা ছিল শিশুদের প্রতি। ছবি তুলতে ভালোবাসতেন। ফটোগ্রাফার অনেকেই প্রশ্ন করতেন, 'লিডার আপনি এত ছবি তোলেন কেন?' বলতেন, 'ভবিষ্যতের মানুষ যারা, ওরা বড় হয়ে দেখবে কেমন ছিল ওদের নেতা।' বঙ্গবন্ধু যখন গণভবনে যেতেন, সামনে পেছনে দুটি গাড়ি থাকত। রাস্তায় ট্রাফিক সিগন্যাল পড়লে আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ত। তখন এরকম স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল বাতি ছিল না। একদিনের কথা খুব মনে পড়ে। একবার আমাদের গাড়ি সিগন্যালে দাঁড়ানো। হঠাৎ একটি শিশু কত বয়স হবে সাত কি আট, গাড়ির কাছে এসে বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ করে বলছে, 'স্লামুআলাইকুম, মুজিব সাহেব!' তৎক্ষণাৎ বঙ্গবন্ধু শিশুটির হাত ধরে আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আমি পাশে বসে দেখছি শিশুদের প্রতি জাতির জনকের অপার ভালোবাসা, অপূর্ব মমত্ববোধ। বঙ্গবন্ধু ছিলেন পরশ পাথরের মতো। তার পুণ্য হস্তের ছোঁয়ায় আমরা সবাই গোটা বাঙালি জাতি নিরস্ত্র থেকে সশস্ত্র হয়েছিলাম; অচেতন থেকে সচেতনতার এমন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিলাম যে আমরা স্বপ্ন দেখতাম শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের।
'৭৪-এর ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দিয়ে দারুণ এক অসাধ্য সাধন করে গেছেন বঙ্গবন্ধু। আমার এখনো চোখে ভাসে হিমালয় সমান উচ্চতার তেজোদ্দীপ্ত এই মানুষটি জাতিসংঘে মাতৃভাষা বাংলায় কী সাবলীল বক্তৃতাই না করলেন। জাতিসংঘে যে ছয়টি ভাষায় বক্তৃতা দেওয়ার রেওয়াজ ছিল তার মধ্যে বাংলা ছিল না। আন্তর্জাতিক ফোরামে প্রথম বাংলাভাষী এই নেতার বক্তৃতা শুনে সেদিনের উপস্থিত রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সবাই বিমোহিত হন। ভাষণ শেষ হওয়ার পর নিজ নিজ আসন থেকে উঠে এসে কেউ করমর্দন করেন, আবার কেউবা বুকে জড়িয়ে ধরে শুভেচ্ছা জানান বঙ্গবন্ধুকে। বাংলা ভাষা সেদিন থেকেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নতুন মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়। কমনওয়েলথ সম্মেলনে তাঞ্জানিয়ার প্রেসিডেন্ট জুলিয়াস নায়ারের সঙ্গে যখন দেখা হয়েছিল তখন তিনি আমাদের বলেছিলেন, 'তোমরা এমন একজন নেতা পেয়েছো যিনি শুধু তোমাদের নেতা নন, সমগ্র বিশ্বে নির্যাতিত মেহনতী মানুষের নেতা তিনি।' বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে এতসব দুর্লভ গুণের সমাবেশ ঘটেছিল বলেই তিনি বাঙালি জাতির জনক।
বঙ্গবন্ধুর একান্ত সানি্নধ্যে থেকে দেখেছি তার কৃতজ্ঞতাবোধ, বিনয়, মানুষের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা। আকাশের মতো উদার ছিল তার হৃদয়। জ্যোতির্ময় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি। স্বদেশে কিংবা বিদেশে সমসাময়িক নেতা বা রাষ্ট্রনায়কদের তার তেজোময় ব্যক্তিত্বের ছটায় সম্মোহিত করার, উদ্দীপ্ত করার এক আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল বঙ্গবন্ধুর। বীরত্ব, সাহস ও তেজস্বতার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে তিনি ছিলেন ভাস্বর। তার কাছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ছিল ন্যায়সঙ্গত। খুব সহজেই মানুষকে কাছে টেনে নিতেন। নাম মনে রাখতে পারতেন মাঠ পর্যায়ের কর্মীদেরও। তিনি যা কিছু করতেন, চিন্তা-ভাবনা করেই করতেন এবং একবার যা বলতেন, সেখান থেকে একচুলও নড়চড় করতেন না। আর সম্ভবত এই একটি মাত্র কারণেই বঙ্গবন্ধুর জীবনের কোথাও ব্যর্থতার ছাপ পড়েনি। তিনি কেবল নেতা হওয়ার বাসনা নিয়ে আওয়ামী লীগের জন্ম বিকাশ ঘটাননি। অসংখ্য নেতা-কর্মী সৃষ্টি করে দেশকে পরাধীনতার গ্লানি মুক্ত করেছিলেন। আর তাই তো তিনি জাতির জনক হয়েছেন, হয়েছেন নেতারও নেতা।
প্রতিটি বাঙালির মতো আওয়ামী লীগের প্রত্যেক কর্মীকেও হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা দিয়ে কাছে টেনে নিতেন বঙ্গবন্ধু। কর্মীরাই ছিল তার সবকিছু। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দক্ষতা বাড়াতে তিনি সারা দেশ চষে বেড়িয়েছেন। বঙ্গবন্ধু সৎ, নিষ্ঠাবান কর্মীদের কাজের মূল্যায়ন করতেন। নানাভাবে তাদের উৎসাহ দিতেন। প্রশংসা করে কর্মীদের নবোদ্যমে উজ্জীবিত করতেন। কর্মীদের ক্ষুদ্র অবদানকে অনেক বড় করে দেখিয়ে তাকে আরও বড় ভূমিকা পালনে উদ্দীপ্ত করার অনুপ্রেরণা দিতেন। বিশাল হৃদয়ের এই মানুষটি সব রকমের ঝড়-ঝাপ্টা থেকে কর্মীদের আগলে রাখতেন। কোনোরকম পারিবারিক, আমলাতান্ত্রিক বা গোষ্ঠীগত কায়েমি স্বার্থবাদী ফ্রেমে বন্দী থাকার মানুষ তিনি ছিলেন না; ইতিহাসের ফ্রেমে বরণীয় ছিলেন তিনি। যে কোনো স্তরের কর্মী যখন-তখন ইচ্ছা করলেই বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে তাদের আনন্দ-বেদনার কথা জানাতে পারতেন। আর এ কারণেই বঙ্গবন্ধু ছিলেন সর্বস্তরের বাঙালির হৃদয়ের নয়নমণি। জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন, আর স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষু ছিল বঙ্গবন্ধুর নিত্যদিনের সঙ্গী। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন বহুবার। একাধিকবার ফাঁসির মঞ্চ তৈরি ছিল তার জন্য। বাঙালির প্রতি বিশ্বাস এবং আস্থার পরিমাণ ছিল আকাশচুম্বী। সেজন্যই বীরদর্পে হাসিমুখে, নির্ভীকচিত্তে দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য এসব জুলুম নির্যাতনকে বরণ করেছেন।
স্মৃতির পাতায় এখনো জ্বলজ্বল করে ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎপ্রার্থী হাবীব আলীর কথা। '৭৪-এর ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং একই তারিখে ইরান ও তুরস্কের সরকারদ্বয়ও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এর পর দিন অর্থাৎ ২৩ ফেব্রুয়ারি ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের জন্য আমরা যাত্রা করেছিলাম লাহোরের উদ্দেশে। সেদিন বঙ্গবন্ধুকে নিতে এসেছিলেন কুয়েতের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী যিনি আজকে কুয়েতের আমির, এসেছিলেন লেবাননের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ওআইসির ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল, তিউনিসিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আলজেরিয়ার তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবদুল আজিজ বুতাফলিফা। এই পাঁচজন এসেছিলেন আলজেরিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুয়ারে বুমেদিনের বিশেষ বিমান নিয়ে। লাহোর বিমানবন্দরে আমাদের অভ্যর্থনা জানান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট চৌধুরী ফজলে এলাহী এবং প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো। সেখানে বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে প্রেজেন্টেশন লাইনে যারা দণ্ডায়মান ছিলেন বঙ্গবন্ধু তাদের সবার সঙ্গে করমর্দন করলেও টিক্কা খানের সঙ্গে করমর্দন করেননি। কারণ টিক্কা খানের হাত শহীদের রক্তে রঞ্জিত ছিল। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে যাওয়ার সময় লাহোরে রাস্তার দুই পাশে লাখ লাখ লোক দাঁড়িয়েছিল। তারা বঙ্গবন্ধুকে লক্ষ্য করে স্লোগান তুলছিল, 'জিয়ে মুজিব, জিয়ে মুজিব।' বঙ্গবন্ধু যখন অতিথিশালায় পৌঁছলেন সেখানে সুট-টাই পরিহিত ছোটখাটো একজন ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গন করেন। বঙ্গবন্ধুও পরমাদরে তাকে বুকে টেনে নিয়ে বলেন, ‘হাবীব আলী ইউ আর হেয়ার।’ জানতে পারলাম এই লোকটির নাম হলো হাবীব আলী। বঙ্গবন্ধু যখন মিয়ানওয়ালী কারাগারে বন্দী তখন তিনি ছিলেন সেই কারাগারের প্রিজন গভর্নর। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপ করার পরে তিনি আমাদের কক্ষে আসেন এবং আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বলেন। বঙ্গবন্ধু মিয়ানওয়ালী কারাগারে কীভাবে জীবনযাপন করেছেন, কীভাবে তিনি মুক্তিলাভ করেছেন সবিস্তারে তার বর্ণনা দেন। তিনি গভীর শ্রদ্ধায় স্মৃতিতর্পণ করে একটানা বলে যান, মিয়ানওয়ালী কারাগারের নির্জন একটি সেলের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নয় মাস চৌদ্দ দিনের কঠিন কারাজীবনের কথা। বঙ্গবন্ধু মুক্তি পাওয়ার আগের দিনগুলোর কথা স্মরণ করে তিনি আমাদের বলেছিলেন- “বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বরের ১০ দিন পর ২৬ ডিসেম্বর রাতে মুজিবকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ পাবার পরপরই একটা ট্রাক নিয়ে মিয়ানওয়ালী কারাগারের দিকে যাই। কারা ফটক খুলে তার সেলের কাছে গিয়ে দেখি তিনি একটা কম্বল জড়িয়ে বিছানার ওপর ঢুলছেন। এমন সময় সেখানে যারা কয়েদি ছিল তারা মুজিবকে ফিসফিস করে বলছিল যে, ‘ওরা এসেছে।’ মুজিবও ফিসফিসিয়ে বললেন যে, ‘শেষ পর্যন্ত আমি মাথা নত করবো না।’ তার আগে মিয়ানওয়ালী কারাগারেই সেলের মধ্যে একটা কবর খোঁড়া হয়েছিল। মুজিব যখন জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এটা কী?’ তখন তাকে বলেছিলাম যে, ‘যুদ্ধ চলছে, এটা বাংকার। শেল্টার নেবার জন্য।’ আসলে ছিল কবর। তখন মুজিবকে একজন কয়েদি বলছিল যে, ‘আসলে এটা কবর। আপনি যদি আজ বের হন আপনাকে মেরে এখানে কবর দেওয়া হবে।’ তখন মুজিব আমাকে বলেছিল, ‘কবরকে আমি ভয় পাই না। আমি তো জানি ওরা আমাকে ফাঁসি দেবে। কিন্তু আমি জানি আমার বাংলাদেশ একদিন স্বাধীন হবে। এবং আমি এও জানি, বাংলার দামাল ছেলেরা হাসিমুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারে। সেই বাঙালি জাতিকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না।’ তিনি সেদিন মিনতি করে বলেছিলেন, ‘আমাকে হত্যা করে এই কবরে না, এই লাশটি আমার বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছে দিও। যে বাংলার আলো-বাতাসে আমি বর্ধিত হয়েছি- সেই বাংলার মাটিতে আমি চির-নিদ্রায় শায়িত থাকতে চাই।’ যাহোক, ঐদিন ২৬ তারিখে আমি ট্রাকে করে মুজিবকে নেওয়ার জন্য মিয়ানওয়ালী কারাগারে আসি। কারণ ইতিমধ্যে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। ক্ষমতা হস্তান্তরকালে ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর কাছে প্রার্থনা করেছিল যে, ‘আমার ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে শেখ মুজিবকে হত্যা করার অনুমতি দাও। আমার জীবনে যদি কোনো ভুল করে থাকি তাহলে শেখ মুজিবকে ফাঁসিকাষ্ঠে না ঝুলানো।’ তখন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো আমার নিকট এই মর্মে জরুরি বার্তা প্রেরণ করেন যে, ‘শেখ মুজিবকে কারাগার থেকে দ্রুত নিরাপদ কোনো স্থানে সরিয়ে ফেলা হোক।’ তখন আমি মুজিবকে মিয়ানওয়ালী কারাগার থেকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে ট্রাক নিয়ে কারা ফটকে আসি এবং সেলের মধ্যে গিয়ে শেখ মুজিবকে আমার সঙ্গে যেতে অনুরোধ করি। কিন্তু তিনি আমাকে বাধা দেন। তখন আমি তাকে বলি, ‘শেখ, আমি আপনার একজন শুভাকাক্সক্ষী, বন্ধু। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমি আপনাকে এখান থেকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে এসেছি। কারণ, এখানে কমান্ডো আসতে পারে। তারা আপনাকে হত্যা করবে। আমার ওপর আপনি আস্থা রাখুন।’ তারপর মুজিবকে ট্রাকে তুলে, ট্রাকের মধ্যে লুকিয়ে, আমার চশমা ব্যারাজ নামক বাড়িতে নিয়ে যাই। সেখানে গিয়েই তিনি একটা টেলিফোন করতে চান। মুজিব আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি কী আমার স্ত্রীর সাথে কথা বলতে পারি।’ তখন আমি তাকে বলেছিলাম, ‘না, আমার একমাত্র কাজ হলো আপনার জীবন রক্ষা করা। আপনি টেলিফোন করতে পারবেন না।’ তখন তিনি বললেন, ‘আমি কী খবরের কাগজ পড়তে পারি।’ আমার উত্তর ছিল, ‘না।’ এরপর বললেন, ‘আমি কী এক কাপ চা পেতে পারি।’ তখন তাকে এক কাপ চা দেওয়া হয়। আমার বাড়িতে তিনি দুই দিন থাকেন। দিন দুই পরে মুজিবকে নিয়ে যাই শাহুল্যা নামক স্থানে। যেটা একসময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর রেস্ট হাউস ছিল। পিন্ডি থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে এই শাহুল্যাতে প্রেসিডেন্ট ভুট্টো মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন। ভুট্টো যখন আসলেন তখন একজন কর্নেল এসে মুজিবকে বলছিল, ‘পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসবে।’ তারপরে সেখানে ভুট্টো আসলেন এবং মুজিবকে সালাম দিয়ে বললেন যে, ‘নাউ আই অ্যাম দ্য প্রেসিডেন্ট অব পাকিস্তান অ্যান্ড চিফ মার্শাল ল’ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর।’ ওই অবস্থায় মুজিব হেসে দিলেন। তখন ভুট্টো জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি হাসছেন কেন?’ তখন মুজিব বললেন, ‘আমি বুঝতে পারি একজন প্রেসিডেন্ট সিভিলিয়ান হতে পারে। কিন্তু আমি অবাক হই যখন শুনি যে, একজন সিভিলিয়ান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক।’ তখন ভুট্টো বলেছিলেন, ‘দ্যাট ইজ পসিবল ইন পাকিস্তান।’ তারপরই মুজিবের দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল যে, ‘ভুট্টো, টেল মি ফার্স্ট, হোয়েদার আই অ্যাম এ ফ্রি ম্যান অর প্রিজনার।’ তখন ভুট্টো উত্তর দিয়েছিলেন, ‘নাইদার ইউ আর এ প্রিজনার, নর ইউ আর এ ফ্রিম্যান।’ তখন মুজিব পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইন দ্যাট কেইস আই উইল নট টক টু ইউ।’ তখন জুলফিকার আলী ভুট্টো বলতে বাধ্য হলেন যে, ‘ইউ আর এ ফ্রিম্যান।’ এরপর মুজিব প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন। তারপরে সে অনেক রকমের প্রস্তাব দিলেন। কীভাবে একটা কনফেডারেশন করা যায়, কীভাবে একসঙ্গে থাকা যায় ইত্যাদি। কিন্তু মুজিব কোনো কথাই বললেন না। চুপ করে থেকে শুধু বললেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত আমি আমার প্রিয় সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে না পারব, ততক্ষণ আমার পক্ষে কিছুই বলা সম্ভবপর নয়।’ এরপর মুজিবকে একটা যৌথ ইশতেহার দেওয়া হয়েছিল স্বাক্ষর করার জন্য। মুজিব সেটাও প্রত্যাখ্যান করলেন। পরিশেষে শেখ মুজিব বললেন, ‘আমি কী এখন দেশে যেতে পারি?’ ভুট্টো বললেন, ‘হ্যাঁ, যেতে পারেন। কিন্তু কীভাবে যাবেন? পাকিস্তানের পিআইএ ভারতের ওপর দিয়ে যায় না।’ তখন মুজিব বললেন, ‘সেক্ষেত্রে আমি লন্ডন হয়ে যাবো।’ এরপর ৮ জানুয়ারি শেখ মুজিব মুক্তি পেয়ে পিআইএ’র একটি বিশেষ বিমানে লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করেন।” কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি লাভ এবং ভুট্টোর সঙ্গে কথোপকথনের স্মৃতিচারণ শেষে হাবীব আলী আমাদের বলেছিলেন, ‘তোমরা বাঙালিরা গর্বিত ও মহাসৌভাগ্যবান যে, শেখ মুজিবের মতো একজন নেতা তোমরা পেয়েছো।’ সেদিন হাবীব আলীর স্মৃতিকথা ও মন্তব্য শুনে বিস্মিত হইনি, কিন্তু গর্বে বুক ভরে উঠেছিল। আমরা তো জানতাম আমাদের নেতার ইস্পাত-কঠিন দৃঢ় সংকল্পবোধের কথা।
১৯৭১-এর ২৬ মার্চ প্রথম প্রহর থেকে ’৭২-এর ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত দীর্ঘ ৯ মাস ১৪ দিন নির্জন কারাগারে মৃত্যুর প্রহর গোনা জাতির জনক লাখো-কোটি মানুষের হৃদয়-নিংড়ানো ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে প্রিয় মাতৃভূমি স্বাধীন বাংলাদেশে পদার্পণ করে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতির উদ্দেশে যে দিকনির্দেশনামূলক বক্তৃতা দিয়েছিলেন তা আজও আমার স্মৃতির মণিকোঠায় সযতনে রক্ষিত আছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বাংলার মানুষের উদ্দেশে সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘ভায়েরা, তোমাদেরকে একদিন বলেছিলাম, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। আজকে আমি বলি, আজকে আমাদের উন্নয়নের জন্য আমাদের ঘরে ঘরে কাজ করে যেতে হবে।’ এমন পরিস্থিতিতেও সব কথার মধ্যে তিনি বলেন, ‘সকলে জেনে রাখুন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের স্থান চতুর্থ।’ এটাও একটি ইঙ্গিতবাহী কথা। বক্তৃতায় তিনি আরও বলেন, ‘আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই যে, বাংলাদেশ একটি আদর্শ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মীয় ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের মূলনীতি হবে- গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র।’ ত্রিশ লাখ মানুষের আত্মদান স্মরণ করে বেদনা-ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার বাংলায় আজ বিরাট ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা এসেছে। ৩০ লাখ লোক মারা গেছে। আপনারাই জীবন দিয়েছেন, কষ্ট করেছেন। বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে, খেয়ে-পরে সুখে থাকবে, এটাই ছিল আমার সাধনা।’ পাকিস্তানের উদ্দেশে বলেন, ‘আমি ফিরে আসার আগে ভুট্টো সাহেব অনুরোধ করেছেন দুই অংশের মধ্যে বাঁধন সামান্য হলেও রাখা যায় কি না। আমি তখন বলেছিলাম, আমি আমার মানুষের কাছে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত কিছু বলতে পারছি না। আজ আমি বলতে চাই- ভুট্টো সাহেব, আপনারা সুখে থাকুন। আপনাদের সঙ্গে আর না।’ ভারতবর্ষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে আমি চিনি। তাকে জানাই আমার শ্রদ্ধা। তার রক্তে মিশে রয়েছে রাজনীতি। তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বের সব রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে আমার মুক্তির জন্য আবেদন করেছেন। আমার সঙ্গে দিল্লিতে শ্রীমতী গান্ধীর আলাপ হয়েছে। আমি যখনই বলব, ভারতীয় সেনাবাহিনী তখনই দেশে ফেরত যাবে।’ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে বলেন, ‘গত পঁচিশে মার্চ থেকে এ পর্যন্ত দীর্ঘ নয় মাসে বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী এ দেশের প্রায় সব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে। হাজার হাজার মা-বোনের সম্ভ্রম নষ্ট করেছে। বিশ্বকে মানব ইতিহাসের জঘন্যতম কুকীর্তির তদন্ত অবশ্যই করতে হবে। একটি নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এসব কুকীর্তির বিচার করতে হবে।’ বিশ্বের সব রাষ্ট্র ও জাতিসংঘের প্রতি আবেদন জানিয়ে তিনি বলেন, “আমি বিশ্বের সকল মুক্ত দেশকে অনুরোধ জানাই, আপনারা অবিলম্বে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেন। জাতিসংঘেরও উচিত অবিলম্বে বাংলাদেশকে আসন দিয়ে তার ন্যায়সঙ্গত দাবি পূরণ করা।’ পরিশেষে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা থেকে উদ্ধৃত করে তাকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করনি।’ কবিগুরু, তুমি এসে দেখে যাও, তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।”
অসাধারণ রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞায় রাষ্ট্রের আশু করণীয় কী হবে তা সবিস্তারে ব্যাখ্যা করে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত, ইঙ্গিতবহ অথচ তাৎপর্যপূর্ণ নীতি-নির্ধারণী বক্তৃতা দিলেন। লাখ লাখ মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছে এবং পরম পরিতৃপ্ত হয়েছে এই ভেবে যে, আজ থেকে আমরা প্রকৃতই স্বাধীন। সভামঞ্চ থেকে বঙ্গবন্ধু ধানমন্ডির ১৮ নম্বর বাড়িতে গেলেন। যেখানে পরিবারের সদস্যরা অবস্থান করছিলেন। সেই বাড়ির সামনে আর একটি বাড়ি তার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। কেননা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবনটি শত্রুবাহিনী এমনভাবে তছনছ করে দিয়েছিল যে বসবাসের অনুপযুক্ত ছিল। ১১ জানুয়ারি প্রিয় সহকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ১২ জানুয়ারি তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন এবং আবু সাইদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি করলেন। ১৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু আমাকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় তার রাজনৈতিক সচিব করেন। দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় সংসদীয় গণতন্ত্র।
’৭৫-এর জানুয়ারির ১১ তারিখের কথা স্মৃতির মণিকোঠায় এখনো জ্বলজ্বল করে। এদিন বাংলাদেশ সামরিক একাডেমিতে প্রথম শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠানে বিদায়ী ক্যাডেটদের উদ্দেশে এক মর্মস্পর্শী বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘... আমি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে এ কথা বলছি না, তোমাদের জাতির পিতা হিসাবে আদেশ দিচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী অনেক হবেন, অনেক আসবেন, প্রেসিডেন্টও অনেক হবেন, অনেক আসবেন। কিন্তু জাতির পিতা একবারই হন, দু’বার হন না। জাতির পিতা হিসাবেই যে আমি তোমাদের ভালোবাসি, তা তোমরা জানো। আমি তোমাদের আবার বলছি, তোমরা সৎ পথে থাকবে, মাতৃভূমিকে ভালোবাসবে। মনে রেখো তোমাদের মধ্যে যেন পাকিস্তানি মনোভাব না আসে। তোমরা পাকিস্তানের সৈনিক নও, বাংলাদেশের সৈনিক। তোমরা হবে আমাদের জনগণের বাহিনী।’ দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর স্বৈরতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামের অভিজ্ঞতা থেকে জাতির জনক যে শিক্ষা অর্জন করেছিলেন সেই চেতনায় স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে তিনি ‘জনগণের বাহিনী’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। বক্তৃতায় তিনি বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর অভিপ্রায় ব্যক্ত করে, সেনা সদস্যদের আদর্শবান হওয়ার, সৎ পথে থাকার অঙ্গীকার করে দৃঢ়তার সঙ্গে øেহার্দ্য কণ্ঠে কবি জীবনানন্দ দাশের জননী কবি কুসুমকুমারী দাশের কবিতা থেকে উদ্ধৃত করেছিলেন, ‘মুখে হাসি বুকে বল তেজে ভরা মন, মানুষ হইতে হবে মানুষ যখন।’ মুখে হাসি আর বুকে বল নিয়েই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু মুজিব যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশের ধ্বংসস্তূপ মাঝারে সোনার বাংলার ইমারত নির্মাণের শুভসূচনা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত কর্মসূচি যখন সাফল্যের দিকে, অর্থনৈতিক সূচকগুলো যখন ঊর্ধ্বমুখী তখনই খুনি চক্র তাকে সপরিবারে হত্যা করে।
১৫ আগস্ট ভোর থেকেই দিনটি ছিল বিভীষিকাময়। ইতিহাসের নৃশংসতম ও ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের পরপরই সকালে আমাকে প্রথমে গ্রেফতার করে গৃহবন্দী করা হয়। সরকারিভাবে বরাদ্দকৃত সেই বাসাটি সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। বাসায় কাউকে ঢুকতে বা বেরোতে দেওয়া হয়নি। আমার সাথে তখন বাসায় অবস্থান করছিলেন ভোলা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামসুদ্দীন আহমেদ মিয়া। তিনি ভোলা জেলা বাকশালের সেক্রেটারি ছিলেন। দুই দিন পর ১৭ তারিখ খুনি চক্রের অন্যতম ক্যাপ্টেন মাজেদের নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনীর একদল উচ্ছৃঙ্খল অভ্যুত্থানকারী আমার বাসভবন তছনছ করে। ঘরের দেয়ালে সংরক্ষিত বঙ্গবন্ধুর ছবিগুলো ভেঙে ফেলে। খুনি চক্র মায়ের সামনেই হাত-চোখ বেঁধে আমায় রেডিও স্টেশনে নিয়ে যায় ও আমার উপর নির্মম নির্যাতন করে। ভয়াবহ সেই নির্যাতনের ক্ষত এখনো আমি বয়ে বেড়াচ্ছি। খুনিরা সেদিন আমায় বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে নানারকম ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। আমি ঘাতকচক্রকে শুধু একটি কথাই বলেছিলাম, ‘বঙ্গবন্ধু যা ভালো করেছেন আমি তার সাথে ছিলাম, যদি কোনো ভুল করে থাকেন তার সাথেও ছিলাম। এর বেশি কিছুই আমি বলতে পারবো না।’ আমার এপিএস শফিকুল আলম মিন্টুকে প্রথমে গ্রেফতার ও পরে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে সম্মত করতে না পেরে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করেই খুনি চক্র ক্ষান্ত হয়নি। একই বছরের ৩ নভেম্বর কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে যারা নেতৃত্ব দিতেন বা বারংবার নেতৃত্ব দিয়েছেন দলের এবং সরকারের- ঐতিহাসিক মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, কামরুজ্জামান সাহেব- আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করার জন্য তাদেরকে কারাভ্যন্তরে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়।
এ হত্যাকাণ্ডের আসল উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব শূন্যতা তৈরি করা। কিন্তু ঘাতকচক্রের ধ্বংসাত্মক ষড়যন্ত্রিক প্রয়াসকে আমরা সফল হতে দেইনি। বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে ধারণ করেই ঐক্যবদ্ধভাবে আমাদের লক্ষ্যের দিকে এগিয়েছি। চরম প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে সাংগঠনিক তৎপরতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি করে মূল দলসহ সহযোগী সংগঠনকে শক্তিশালী করে নিজেদের মধ্যে সব ভেদাভেদ ভুলে কেবল দলকেই ধ্যান-জ্ঞান করে, দলীয় ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতে আওয়ামী লীগের পতাকা তুলে দিয়েছি।
আজ সবকিছু ছাপিয়ে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে কেবলই মনে পড়ে ১৪ আগস্ট সেদিনটির কথা। যেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার যাওয়ার কথা ছিল। স্মৃতির পাতায় আজও অনুরণিত হয় বঙ্গবন্ধুর শেষ কথাগুলো, ‘কাল সকালে আমার বাসায় আসবি।... তুই আমার সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবি।’ আমার আর যাওয়া হয়নি।