বঙ্গবন্ধুর যশোর স্মৃতি

স্মৃতিফলকই ইতিহাস

বি এম ফারুক 
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু যশোরে প্রথম আসেন ১৯৭২ সালের ২৬ ডিসেম্বর। এই জেলার ইতিহাসে স্টেডিয়ামের সর্ববৃহৎ জনসভায় ভাষণ দেন সেদিনের রাষ্ট্রনায়ক ও স্বাধীনতা সংগ্রামের এই মহানায়ক। তবে তা কোথাও লিপিবদ্ধ নেই এই ইতিহাস।

বঙ্গবন্ধুর যশোর আগমনের সাক্ষী হিসেবে শুধু একটি স্মৃতিফলকই টিকে রয়েছে। মহান নেতার একান্ত সান্নিধ্য পাওয়া স্নেহধন্য সেই মানুষগুলোও অনেকেই হয়েছেন গত। আর জীবিতদের অধিকাংশই বয়সের ভারে ন্যুব্জ, হারিয়ে ফেলছেন সেদিনের স্মৃতি; ইতিহাস।

জানা যায়, যশোর পৌর উদ্যানে শহীদ মশিয়ূর রহমানের স্মৃতিফলকের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর নামাঙ্কিত এই স্মৃতিফলকের শিলালিপিতে তারিখ লেখা আছে ১৯৭২ সালের ২৬ ডিসেম্বর। একই দিনে শহরের পুরাতন বাস টার্মিনালের বিজয় স্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তরও উদ্বোধন করেন তিনি। 

আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট পীযূষ কান্তি ভট্টাচার্য জানান, ১৯৭২ সালে হেলিকপ্টারে যশোর আসেন বঙ্গবন্ধু। যশোর স্টেডিয়ামে বিশাল জনসভায় বক্তব্য দেন তিনি। ওইদিন রাত্রিযাপন করেন যশোর সার্কিট হাউসে। 

স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ১৯৭৩ সালে আমি যখন সংসদ সদস্য সে সময়ের জেলা বোর্ড চেয়ারম্যান নেছার আলী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার দেখা করানোর ব্যবস্থা করতে বলেন। চেয়ারম্যান নেছার আলীকে সঙ্গে নিয়ে আমি ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর বাসায় গেলে দেখি তোফায়েল আহমেদ ও প্রয়াত আবদুর রাজ্জাক বঙ্গবন্ধুকে মুজিব কোর্ট পরিয়ে দিচ্ছেন। পরে তিনি খাসকামরায় এলে আমাকে দেখে বলেন, পীযূষ কাকে নিয়ে আইছিস, নেছার সাহেব না।

তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু একটা বিষয় ২০ বছর পর্যন্ত মনে রাখতে পারতেন। 

মুক্তিযোদ্ধা হায়দার গণি খান পলাশ জানান, দেশ স্বাধীনের পরে অন্তত ২ বার যশোরে এসেছেন বঙ্গবন্ধু। 

বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে যশোর প্রেস ক্লাবের সঙ্গেও। শহরের মুজিব সড়কে প্রেস ক্লাব নির্মাণের জন্য ১৮ শতক জমি দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ক্লাবের সেদিনের সভাপতি তৌহিদুর রহমান জানান, সার্কিট হাউসে অবস্থানকালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন তিনিসহ সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেন মীর। অনেকটা খোলামেলাভাবেই সার্কিট হাউসের সামনে বসেছিলেন মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সন্ধ্যা থেকে প্রচণ্ড ভিড় ছিল সেখানে। 

সাক্ষাৎপর্ব শেষে রাত ১২টার দিকে বঙ্গবন্ধু ভিআইপি কক্ষের দিকে যাচ্ছিলেন। এমন সময় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেন মীর বঙ্গবন্ধুর দিকে এগিয়ে যান এবং নিজেকে সাংবাদিক বলে পরিচয় দেন। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে বঙ্গবন্ধু আবার ফিরে আসেন এবং কথা বলার আগ্রহ দেখান। ক্লাবের তিনি এবং সম্পাদক প্রথমেই বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্লাবের জন্য এক খণ্ড জমির প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। এ সময় ক্লাবের বর্তমান স্থানটি (মুজিব সড়কে) এনিমি প্রোপার্টি হিসেবে ক্লাবের নামে বরাদ্দ দেওয়ার জন্য তৎকালীন জেলা প্রশাসক সৈয়দ আক্তার আলীকে নির্দেশ দেন বঙ্গবন্ধু।


বঙ্গবন্ধু সাইকেল চেপে ভাষণ দিতে আসার স্মৃতি আজও ভোলেনি চৌগাছার মানুষ:

মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্মৃতি বিজড়িত কপোতাক্ষ নদের তীরে অবস্থিত ধূলিয়ানী ইউনিয়নের সর্ববৃহৎ গ্রাম মুক্তারপুর। ধূলিয়ানী ইউনিয়নের একমাত্র ডাকঘর এই মুক্তারপুর গ্রামে অবস্থিত যা স্থাপিত হয়েছে আজ থেকে ৬০ বছর আগে।

ধূলিয়ানী   ইউনিয়নের  জন্ম মুক্তিযুদ্ধের পর। চৌগাছা থানার সৃষ্টি হয়েছে স্বাধীনতার পরে। ১১ টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা নিয়ে চৌগাছা উপজেলা গঠিত। এর মধ্যে ৩টি ইউনিয়ন যথক্রিমে সুখপুকুরিয়া, নারায়নপুর ও স্বরুপদাহ নেয়া হয়েছে ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলা থেকে, নেওয়া হয় হাকিমপুর, পাতিবিলা ও জগদীশপুর ইউনিয়ন ও একই জেলার কালিগঞ্জ উপজেলা থেকে। চৌগাছা, সিংহঝুলি, ফুলসরা, পশাপোল ও বহুল আলোচিত ধূলিয়ানী  এই ৫টি উইনিয়ন ছিল ঝিকরগাছা উপজেলার অন্তভূর্ক্ত।

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ জাতীয় পরিষদ সদস্য ও সাবেক প্রাদেশিক মন্ত্রী  মরহুম মসিয়ূর রহমানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন মরহুম ভাটাই বিশ্বাস যার বাড়ি এই মুক্তারপুরে।  ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য পদে প্রার্থী ছিলেন শহীদ মসিয়ূর রহমান। জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান তখনো আওয়ামী লীগদের কাছে হয় শেখ সাহেব, নইলে মুজিব ভাই বলে পরিচিত। সেকালের বাঙ্গালীদের প্রিয় মুজিব ভাই যশোরের অসাধাণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন নেতা জনাব মসিয়ূর রহমান কে আপন বড় ভাই এর মতো শ্রদ্ধা করতেন। তিন প্রোগ্রাম দিলেন তৎকালীন ঝিকরগাছা থানায় দুটি জনসভা করার।  একটি থানার উত্তর এলাকায়, অপরটি দক্ষিণে। উত্তর এলাকার জনসভার স্থান বঙ্গবন্ধু নিজেই নির্বাচন কওে দিয়েছিলেন। স্থানটি ছিল নায়ড়া গ্রাম।

সাতক্ষীরার সুলতানপুরের মরহুম খোন্দকার আব্দুল বাতেন ( তিনি খ্যাতনামা কলামিস্ট আব্দুল গফফার চৌধুরীর ঘনিষ্ট বন্ধু) মিয়ার বাড়ীতে রাত্রি যাপন কওে বঙ্গবন্ধু সেকালের সাতক্ষীরা-যশোর ইটের রাস্তায় চলাচলকারী লক্কড়মার্কা মাসে এসে নেমেছিলেন বাগআঁচড়া বাজারে। সেখান থেকে সাইকেলে চেপে দুর্গম রাস্তা পাড়ি দিয়ে নেতৃবৃন্দকে নিয়ে সভা করেন আজকের নায়ড়ার বাজারে। সভা শেষে রাত্রি যাপন করেন ঝিকরগাছা মোটর ব্রীজের প্রায় লাগোয়া দীনবন্ধু দফদারের দোতালায়। দোতলার ঐ কামরাটি তখন যুক্তপ্রন্টের নির্বাচনী কার্যালয় হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছিল। রাত্রে দোতলার বিরাট খোলা ছাদে কর্মীদের নিয়ে সভা করেন তিনি। সে সভার নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহবায়কের দায়িত্ব দেয়া হয় মরহুম হাজী নুর বকসী সাহেবকে।

মরহুম হাজী নুর বকসী সাহেব ছিলেন ঝিকরগাছা থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। পরবর্তীতে জাতির ক্রান্তিলগ্নে ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনের সময় তারই উপর অর্পিত হয় অষন্ড যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বভার। মরহুম হাজী নুর বকসী সাহেবের বাড়ি উজিরপুর- যা মুক্তারপুর গ্রামের একেবারেই লাগোয়া। মরহুম ভাটাই বিশ্বাসের সাথে তার ছিল নিবিড় বন্ধুত্ব। জনাব মসিয়ূর রহমানের আগাত স্নেহ এবং হাজী নুর বকসী সাহেবের বন্ধুত্বকে কাজে লাগিয়ে ভাটাই বিশ্বাস জেদ ধরেছিলেন দক্ষিনের জনসভাটি হবে মুক্তারপুরে। যশোর জেলা পরিষদ ১ম কিস্তিতে যে কয়টি প্রাথমিক বিদ্যারয় কে অনুদান দিয়েছিল তারই একটি আজকের মুক্তারপুর সরকারী প্রথমিক বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ের মাঠে অনতিদূরে নির্বাচনী সভা করেছিলেন।

জাতির জনক বঙ্গবব্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুক্তফ্রন্টের নৌকা প্রতীকের পক্ষে। সেই বিশাল জনসভার শ্রোতাদের মধ্যে আজো যারা জীবিত আছেন তারা  গর্বের সাথে স্মরণ করেন তাদের দূর্লভ সৌভাগের কথা। বর্ণনা দেন যুবক মুজিবের তেজোদীপ্ত বজ্রকন্ঠের অসাধারণ বক্তৃতার। সুদূর ঝিকরগাছা থেকে নিজ বাইসাইকেলে চালিয়ে  এসেছিলেন মুক্তারপুর গ্রামে। সভাশেষে নেতাকর্মীদেও খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল ভাটাই বিশ্বাসের বাড়িতে। সেই দূর্লভ মুহুর্তের স্মৃতির স্বাক্ষর বহন করে চলেছে মুক্তারপুর বঙ্গবন্ধু স্মৃতিস্তম্ভ।

SUMMARY

1571-1.jpg