স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধু


হাজী গোলাম মোরশেদ

বঙ্গবন্ধুকে আমি প্রথম দেখি কলকাতায় একটি আন্দোলনে। সময়টা ১৯৪৫ কী ৪৬ সাল হবে। যখন রশিদ আলী মুক্তির আন্দোলন হয়, সে সময় একটি বাড়িতে কলকাতায় প্রথম আমি বঙ্গবন্ধুকে দেখি। তখন আমি নেতা নই, কর্মী।  দূর থেকেই তাকে দেখা হয়। এরপর ৫৩ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠনের পর তার কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ হয়। ৫৪ সালের ১৪ মে তিনি মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তখন আমি ঢাকায় অবস্থান করছি। মুজিব ভাই যেহেতু আওয়ামী লীগের জয়েন্ট সেক্রেটারি তাই তার সঙ্গে দেখা করেছি এবং যোগাযোগের শুরু হলো তার সঙ্গে। এরপর কীভাবে কী করে যেন ওনার সঙ্গী হয়ে গেলাম। এরপর ৭৫ সাল পর্যন্ত নানা স্মৃতি রয়েছে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে।
সকাল থেকে সারা দিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে থাকতাম। অনেক রাতে বাসায় ফিরতাম। এটা প্রতিদিন আমার রুটিন হয়ে যায়। তখন আমার বাসা ছিল কাকরাইলে। আমার একটি গাড়ি ছিল। ওই গাড়িতে বঙ্গবন্ধু মাঝে মধ্যে উঠতেন। এই গাড়িতে করে আমরা আওয়ামী লীগ অফিস, আর বিভিন্ন জায়গায় ট্যুরে যেতাম।
তিনি শত্রু-মিত্র বাছবিচার করতেন না, সবাইকে ২-৪ মিনিটেই আপন করে নিতেন। তিনি ১৯৫৮ সালের ৩০ জুন যশোরে মিটিং করতে গেলেন। আমি ওনাদের জন্য থাকার জায়গা ঠিক করলাম। জিল্লুর রহমান তখন নববিবাহিত। সঙ্গে তার নতুন বউ। বললেন, তোর বাড়িতে নিয়ে যা। উনার সঙ্গে আমার ছোটভাই বড়ভাই সম্পর্ক ছিল। দ্বিতীয় ডাকে আপনি থেকে তুই হয়েছি।
৬২ সালে বঙ্গবন্ধু যখন গ্রেফতার হলেন, আমি তখন যশোরে। কয়েক মাস পরেই তিনি ছাড়া পেলেন। জয়েন  করলেন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে। তখন আমি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। আমি হজ করতে গেলাম। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলছে। ফিরে এলাম। এরপর বঙ্গবন্ধুর মায়ার জালে আটকে গেলাম। আমার মনেও স্বাধীনতার স্বপ্ন বোনা শুরু হলো। এরপর দেখা গেল ৭০ সালের পর থেকে আমি ওনার সব ট্যুরের সঙ্গী হতাম। দিনাজপুর থেকে শুরু করে ভোলা পর্যন্ত।
এবার ৭ মার্চের ঘটনা বলি। বেলা আড়াইটার দিকে আমি গাড়ি চালাচ্ছি। আমার বাম পাশে উনি বসা। পেছনে মহিউদ্দিন, কাজী গোলাম। ৮ নম্বর রোড দিয়ে যাচ্ছিলাম। জানতে চাইলাম, আজকে কী বলবেন?  উনি বললেন, আল্লাহ আমার মুখ দিয়ে যা বের করে তাই বলব। মাঠে গেলাম, উনি মঞ্চে উঠলেন। ওনার পায়ের কাছে আমি বসলাম। উনি বক্তব্য দিতে উঠলেন। কোনো লেখা না, কোনো পড়া না। বক্তৃতা করলেন সে এক মহাকাব্য। যেন কবিতার মতো বলে গেলেন। পরে বাসায় নিয়ে আসলাম। এর পরের দিন অনেকেই এসে দেখা করেছেন তার সঙ্গে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ আমি তার বাসায় গেলাম। । আমার মা মারা গেছেন ৩ ফেব্রুয়ারিÑ সে বছরই। মায়ের জানাজায় মুজিব ভাই, তাজউদ্দীন ভাই সবাই অংশগ্রহণ করেছিলেন। আমার বড় ভাই (আতাউর রহমান) তখন চিফ ইঞ্জিনিয়ার, পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের। হাতিরপুলের বাসায় থাকতেন। সেখানেই জানাজা হয়। যখন আমি বের হলাম, তখন ৮ কী ৯টা বাজে। মায়ের কবর জিয়ারত করেছি। তারপর মুজিব ভাইয়ের বাসায় যাব। বের হয়ে দেখি, শাহবাগের মোড়ে ব্যারিকেড ফেলা হচ্ছে। তখন ১০টা বাজেনি,  বাজে বাজে করছে। ৮ নম্বর রোডের ব্রিজটা পার হয়ে বঙ্গন্ধুর বাড়ির সামনে গাড়িটা রেখে সোজা ছুটে গেলাম। দেখলাম, নিচে কেউ নেই। সুনসান নীরবতা। শুধু পুলিশের একজন দারোগা দাঁড়িয়েছিল। আমি সোজা উপরে উঠলাম। উঠে দেখি, বঙ্গবন্ধু পাইপ হাতে বসে আছেন। ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘আমরা স্বাধীন হয়ে গেলাম। দে আর কামিং টু অ্যারেস্ট মি। আই হ্যাভ ডিসাইডেড টু স্টে।’ এই কথাগুলো উচ্চারণ করলেন।
এরপর ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম আসলেন। ওনারা নিচে বারান্দায় বসলেন। আমি তখন উপর-নিচ করছি। প্রচুর টেলিফোন আসছে। মওদুদ (ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ) বলল, হাজী সাহেব পালান। এরপর সিরাজুল হক সাহেবের স্ত্রী বললেন যে, মুজিব ভাইকে বলেন পালিয়ে যেতে, ওরা মেরে ফেলবে। সুবোধ ছিলেন যশোরের এমসিএ। তিনি বললেন, আপনারা পালান। উপরেও টেলিফোন নিচেও টেলিফোন। মুজিব ভাই কোনো ফোন ধরছিলেন না।
এরপর অনেকে আসল বাড়িতে, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলল। তবীবুর রহমান নামে একজন আসল। তিনি বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, মুজিব ভাই পালান, ওরা আপনাকে ধরে মেরে ফেলবে। তখন বঙ্গবন্ধু বলল, ইফ দে ডু নট গেট মি, দে উইল ম্যাসাকার অল মাই পিপল অ্যান্ড ডেস্ট্রয়  দ্য সিটি। এরপর  ১২টা প্রায় বাজে এমন সময় ফোন আসল, আমি বলধা গার্ডেন থেকে বলছি। মেসেজ পাঠানো হয়ে গেছে, মেশিন নিয়ে কী করব? আমি মুজিব ভাইয়ের কাছে দৌড়ে গেলাম, বললাম যে ফোন এসেছেÑ মেসেজ পাঠানো হয়ে গিয়েছে। উনি বললেন, মেশিনটা ভেঙে পালিয়ে যেতে বল। আমাকে যেভাবে বলা হলো সেভাবেই আমি সে কথাই বার্তা প্রেরককে বললাম।
আমার হাতের ঘড়িতে দেখলাম ১টা ১০-১৫ হবে। সে সময় চারদিক আলোকিত হয়ে গেল। আমি তখন নিচ-উপর করছি। বঙ্গবন্ধু বললেন, কোন দিক দিয়ে এ গুলিগুলো আসল। আমি দিক দেখিয়ে দিলাম। আমার তখন হিতাহিত জ্ঞান নেই। তারপর বঙ্গবন্ধু আবার উপরে চলে গেলেন। এরপর আমি ফোন ধরে কথা বলছি তখন একটা কথা শুনলাম ‘হ্যান্ডস আপ’। আমি হাত উঁচু করে ফেললাম। তারপর একজন আওয়াজ করল, মাত মারো। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই আমার মাথায় আঘাত লাগল। আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম।
এরপর আমাদের জাতীয় সংসদের মাঠে রাখা হয়েছিল বলে শুনেছি। সূর্য ওঠার আগেই আমাকে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে নিয়ে গেল। এরপর তো নির্যাতন। মুজিব কা সেক্রেটারি, মুজিব কা ড্রাইভার এই বলে পেটায় আর চলে যায়। এভাবেই জুন মাস পর্যন্ত চলল। যতক্ষণ না অজ্ঞান হই, ততক্ষণ মারে। তারপর নানা ঘটনা। এরপর ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আটকাধীন আমার ওপর চলে পাশবিক নির্যাতন। মুমূর্ষু অবস্থায় মুক্তি পাই ২৫ নভেম্বর ১৯৭১ সালে। তখন যুদ্ধ চলছে। আমরা কাকরাইলের বাসায় ছিলাম। বের হওয়ার মতো ক্ষমতা ছিল না। থর থর করে পা দুটো কাঁপত। দাঁড়াবার ক্ষমতা ছিল না। এভাবে কিছু দিন গেল।
এরপর ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে ফজরের নামাজের পর আমার মামাতো ভাই আবুল মজিদের গাড়িতে করে ভাবী (বেগম মুজিব) যেখানে বন্দি ছিলেন সেটা খুঁজে খুঁজে সেখানে গেলাম। ধানমন্ডির ১৮ নম্বর রোডে। পাকিস্তানি আর্মি ওনাদের অবরুদ্ধ করে রেখেছে। আমি পিছিয়ে খানিক দূরে আসলে দেখি, এম ই চৌধুরী সিএসপি আর হাতেম আলী খান চিফ ইঞ্জিনিয়ার ওনারা হেঁটে যাচ্ছেন। মর্নিং ওয়াক করে। ওনাদের দুইজনকে আমি চিনতাম। আমাকে দেখে বললেন, করছেন কী কাল বিকালে এখানে দুইজনকে গুলি করে মেরেছে। তখন আমি চলে আসলাম। ভাইকে সঙ্গে করে সার্কিট হাউসে ঢুকলাম, সেখানে  দেখি একজন মেজর জেনারেল (নাম গনজালভেস)। ওনাকে বললাম, মুজিব ভাইয়ের ফ্যামিলি ইন সিরিয়াস কনডিশন। আর্মি মে কিল হার অ্যানি টাইম। তখন উনি এক শিখ জেনারেলের সঙ্গে কথা বললেন। দুইজনে আলোচনা করে আমাকে বললেন, তোমার গাড়ি আছে? আমি বললাম, আমার ভাই গাড়ি নিয়ে নিচে বসে আছে। তিনি বললেন, আমাকে এয়ারপোর্টে নিয়ে চল। এরপর উনি মেজর রাজা বলে একজনের সঙ্গে কথা বললেন। মেজর রাজাকে আমার সঙ্গে পাঠালেন বেগম মুজিবকে রেসকিউ করার জন্য।
১০ জানুয়ারি তিনি ফিরে আসলেন। আমি তখন পা টেনে টেনে হাঁটি। আমাকে তিনি বার্লিন পাঠালেন চিকিৎসার জন্য। এরপর আমাকে ১৯৭২ সালের এপ্রিলে অনারারি এইড টু প্রাইমমিনিস্টার (প্রধানমন্ত্রীর অবৈতনিক সহায়ক) করলেন। একটা গেজেট নোটিফিকেশন করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিলেন। তৌফিক ইমাম তখন কেবিনেট সেক্রেটারি।  যেতাম, কাজ করতাম, লোকের সুখ-দুঃখের কথা শুনতাম। তখন প্রত্যেক শহীদ পরিবারকে ২ হাজার টাকা দেয়া হতো। সেটার চেক লেখা হতো সই হতো। বঙ্গবন্ধু সময় পেতেন না, রাত ১১টা-১২টার পর বাসায় গিয়ে সই করিয়ে নিয়ে আসতাম। এ নিয়ে অনেক কথা শুনতে হতো। তাই একদিন মনের দুঃখে চিঠি লিখে চলে আসলাম। রিজাইন দিলাম। অবশ্য প্রয়োজনে যেতাম। সম্ভবত ১০ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ফোন করেছিলেন। আমি তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। সামনে যেতেই বললেন, তুই কালকে থেকে অফিস করবি। এরপর বিকালে তার বাসভবন গণভবনে গেলাম, পাশে হাঁটলাম এবং আমার সঙ্গে গল্প করলেন।
তখন আমার যশোরে বাড়ির ছাদ ঢালাই’র কাজ চলছিল এবং পরে আজমির শরিফে যাওয়ার কথা ছিল। সেটা আর তখন তাকে বলিনি। আমাকে যশোরে যেতে হলো বাড়ির কাজে। ১২ আগস্ট। বঙ্গবন্ধু আমার স্ত্রীকে ফোন করে বললেন। হাজী সাহেব কোথায়? স্ত্রী বললেন, হাজী সাহেব যশোরে গেছেন। তারপর সেই ১৫ আগস্ট।  আর দেখা হলো না তার সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু সব সময় মমতাময় ছিলেন। মমতা তার ধর্ম ছিল। কঠোরতা তার ছিল না কখনও

SUMMARY

1570-1.png