অতন্দ্র এক গবেষকের দৃষ্টিতে শতবর্ষের বঙ্গবন্ধু


ড. আব্দুল মুহিত

সৃষ্টির আদিম প্রভাত থেকে বাংলার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ভাষা। আর্য, অশোক, গুপ্ত, পাল, সেন, সুলতানী, মুঘল এবং ব্রিটিশ প্রত্যেক স্তরের রাজনীতিতেই সংস্কৃৃতি আর ভাষা ছিল অন্যতম উপজীব্য। ১৯৫৭ সালের ২৩ জুন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর বাঙালির অস্থি-মজ্জায় আঘাত আসে। দেখা দেয় বিভক্তি, জাতি বিদ্বেষ, রক্তপাত, দাঙ্গা, পারস্পরিক দ্বন্দ্ব। তবে, এর মধ্য থেকে জন্ম নেয় নতুন ধারা, সাংস্কৃতিক লড়াই, সচেতনতা। জন্ম নেয় আত্ম-উপলব্ধিবোধ, দেশপ্রেম। বেরিয়ে আসে নেতৃত্ব। জাতির চরম এক সংকটে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ টুংগিপাড়ায় জন্ম নেয়- দুই শ বছরের শোষিত, নিগৃহিত, বঞ্চিত এক জাতির অগ্রদূতের। তিনি হলেন- হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ইতিহাসের এই শ্রেষ্ঠ পুরুষকে নিয়ে যে গবেষকগণ নিজেদের আত্মনিমগ্ন করেছেন ড. হারুন অর রশিদ তাদের একজন। তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘পাকিস্তান আন্দোলন, বাঙালির রাষ্ট্রভাবনা ও বঙ্গবন্ধু’ এমনই একটি সৃষ্টি যা পড়ে একশো বছরের ইতিহাস এখন স্পষ্ট, দৃষ্টি সম্মুখে।

বেশ কয়েক বছর আগে জাতীয় জাদুঘরে একটি আলোচনা সভায় গিয়েছিলাম, সেখানে ৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থানের নায়ক তোফায়েল আহমেদ সাহেবকে বলতে শুনেছিলাম- ‘কেউ যদি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্টাডি করতে চায় তবে ড. হারুনের শরণাপন্ন হতেই হবে। তাঁর বইয়ে যে সংখ্যক রেফারেন্স থাকে তাতে মনে হয় যে ইতিহাসের ঐ দিনে, ঐ ক্ষণে আমি হারিয়ে গেছি। চোখের সামনে ভাসতে থাকে এক একটি শ্লোগান, আন্দোলন। সে দিনগুলো বইয়ের পাতায় দেখলে শিহরিত হই আমি’।

কথাগুলো এজন্য বললাম যে- টেলিভিশন, পেপার পত্রিকা, স্মরণসভা সেমিনারে এ দেশের রাজনীতি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে প্রতিনিয়ত আলোচনা হচ্ছে। দেখে আনন্দে বুকটা ভরে যায়। কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে এ বক্তব্যগুলো কিছুদিন পর হারিয়ে যায়। অর্থাত্, পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তা পৌঁছানো দুরূহ হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া এ দেশে ‘রাজনীতি ও ইতিহাস’ নিয়ে গবেষণা করার মতো পণ্ডিতের সংখ্যা দিনকে দিন কমে যাচ্ছে। নানা কারণে তাঁরা উত্সাহ হারিয়ে ফেলছেন। শারীরিক সামর্থ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা এর অন্যতম একটি বাধা। এ দেশে গবেষণা করতে গেলে যে পরিবেশ দরকার তাও পাওয়া কঠিন। এতশত প্রতিবন্ধকতা থাকার পরও একজন মানুষ নিরবে নিভৃতে গবেষণা করে যাচ্ছেন। তিনি হলেন- জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. হারুন অর রশিদ। তাঁর ১১টির মধ্যে বেশ কয়েকটি গবেষণা গ্রন্থের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। দ্য ফোরস্যাডোয়িং অব বাংলাদেশ, ইনসাইড বেঙ্গল পলিটিক্স, বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তা ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়, বাংলাদেশ: রাজনীতি, সরকার ও শাসনতান্ত্রিক উন্নয়ন ১৭৫৭- ২০০০, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পূণর্পাঠ, আমাদের বাঁচার দাবি: ৬ দফার ৫০ বছর, মূল ধারার রাজনীতি: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, কাউন্সিল ১৯৪৯-২০১৬, বঙ্গীয় মুসলিম লীগ, পাকিস্তান আন্দোলন, বাঙালির রাষ্ট্রভাবনা ও বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিতে ২০ খণ্ডে ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এনসাইক্লোপিডিয়া’ রচনা প্রকল্পের প্রধান হিসেবে গবেষণা কর্মে নিয়োজিত তিনি।

সেনা সমর্থিত মইনুদ্দিন ফকরুদ্দিন শাসনের এক-এগারো সরকারকে নিশ্চয়ই কেউ ভোলেনি। দেশের গণতন্ত্র রক্ষার জন্য জাতির দুঃসময়ে এক-এগারো সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, প্রতিবাদ করেছেন ড. হারুন। ধীরে ধীরে চক্ষুশূল হয়ে যান ফকরুদ্দিন-মইনুদ্দিন সরকারের। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার মুক্তি চেয়ে ২০০৭ সালের ২০-২২ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে জেল খেটেছেন। জাতির প্রতিবাদ স্বর স্তব্ধ করে দিতে রাতের আঁধারে চোখ বেঁধে টর্চার শেলে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। দিনের পর দিন নির্যাতন সহ্য করেছেন তিনি।

মূলত বঙ্গবন্ধুর জন্ম থেকে মৃত্যু, রাজনৈতিক জীবন, জেল জুলুম, প্রতিদিনের কাজকর্ম ও স্বাধীনচেতা, মুক্তি পাগল, আলোর দিশারি, অন্যায়ের প্রতিবাদ, আপসহীন বঙ্গবন্ধু এবং তার স্বপ্ন নিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা করেছেন ড. হারুন অর রশিদ। তার গবেষণার মূল উপজীব্য হাজার বছরের বাংলার রাজনীতি, মুঘল-ব্রিটিশদের রাজনীতি, বাংলায় পাকিস্তান আন্দোলন ও তার ভিত্তি, ভাষা আন্দোলন, মুসলিম লীগ ও বঙ্গবন্ধু, সোহরাওয়ার্দীর প্রভাব, বাংলায় পাকিস্তান আন্দোলন, স্বাধীন অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্র ও বঙ্গবন্ধু, পাকিস্তান আন্দোলনে বাঙালি-অবাঙালি দ্বন্দ্ব, স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু ইত্যাদি। এ ছাড়াও ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা-বাঙালির বাঁচার দাবি, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন বাংলা এবং বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধুর শাসনামল, নির্বাচন, রাষ্ট্রনীতি, বাকশাল গঠন, শাসনতান্ত্রিক উন্নয়ন ও ’৭৫ এ একদল বিপথগামী সেনা সদস্য কর্তৃক হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হত্যা— সব কিছুই উঠে এসেছে ড. হারুনের গবেষণামূলক বইগুলোতে। শুধু তাই নয়, দালিলিক প্রমাণাদিসহ তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব উঠে এসেছে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এতো সহি শুদ্ধ ও তথ্যবহুল গবেষণা দ্বিতীয়টি মেলা ভার। আজ যে গবেষণা গ্রন্থগুলো তিনি রেখে যাচ্ছেন, শত বছর পর তা অমূল্য রতনসম হিসেবে মূল্যায়িত হবে আগামী প্রজন্মের কাছে।

n লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

SUMMARY

155-1.jpg