'খেলোয়াড়' বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন

         
ড. শেখ আবদুস সালাম

'খেলোয়াড়' বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন
কিছুদিন আগে একটি খবরে দেখেছিলাম, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ একটি ক্রীড়া অনুরাগ সম্পর্কে মন্তব্য করায় জনৈক নারী ফুটবল সংগঠককে জেলে পাঠানো হয়েছিল। তার অপরাধ, তিনি প্রধানমন্ত্রীকে দোষারোপ করে বলেছিলেন, তিনি ক্রিকেট বা অন্যান্য খেলাধুলাকে যতটা পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছেন, ফুটবলকে তেমনটি দিচ্ছেন না। এ ঘটনার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী নিজে আদৌ কতখানি জ্ঞাত বা সম্পৃক্ত, তা আমার জানা নেই। তবে আমার এতটুকু আস্থা ও ভরসা রয়েছে যে, তার জ্ঞাতসারে এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। যাহোক খবরটি পড়ে খুব খারাপ লেগেছিল এ কারণে, এমন একটি সামান্য কথায় একজন নাগরিক বা ক্রীড়া সংগঠককে জেলে যেতে হবে! এ সময়ে আমার ভাবনায় এটাও ভর করেছিল, শুধু প্রধানমন্ত্রী নন; কয়েক প্রজন্ম ধরে শেখ পরিবারের মানুষ বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করেছেন, খেলাধুলাকে সংগঠিত করেছেন, পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে গেছেন এবং এখনও দিয়ে যাচ্ছেন। এত কিছুর পরও প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে এমন ধারণা কেন? 

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থের প্রথমদিকে বলা হয়েছে- 'ছোট সময়ে আমি খুব দুষ্ট প্রকৃতির ছিলাম। খেলাধুলা করতাম, গান গাইতাম .......। সেবা সমিতির কাজ করতাম। ......... ফুটবল, ভলিবল খেলতাম। খুব ভাল খেলোয়াড় ছিলাম না। তবুও স্কুলের টিমের মধ্যে (আমার) ভাল অবস্থান ছিল।' এ গ্রন্থের ১৪ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু নিজ বয়ানে বলছেন- 'খেলাধুলার দিকে আমার খুব ঝোঁক ছিল। আব্বা আমাকে বেশি খেলতে দিতে চাইতেন না। কারণ আমার হার্টের ব্যারাম হয়েছিল। আমার আব্বাও ভাল খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি অফিসার্স ক্লাবের সেক্রেটারি ছিলেন। আর আমি মিশন স্কুলের ক্যাপ্টেন ছিলাম। আব্বার টিম ও আমার টিমে যখন খেলা হত তখন জনসাধারণ খুব উপভোগ করত। আমাদের স্কুল টিম খুব ভাল ছিল। মহকুমায় যারা ভাল খেলোয়াড় ছিল, তাদের এনে ভর্তি করতাম এবং বেতন ফ্রি করে দিতাম।' এই হলো বঙ্গবন্ধুর ক্রীড়াজীবন আর ক্রীড়ার প্রতি তীব্র অনুরাগের এক প্রত্যক্ষ টেস্টিমনি। শুধু গোপালগঞ্জে নয়; ৪০-এর দশকে ওয়ান্ডারার্সের হয়ে ঢাকা গিয়েও ফুটবল খেলেছেন তিনি।

শেখ পরিবারের দুই প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুর বাবা এবং বঙ্গবন্ধু নিজেই ছিলেন খেলোয়াড় এবং ক্রীড়া সংগঠকও বটে। এর পর থেকে শেখ মুজিবুর রহমান ভীষণভাবে যুক্ত হয়ে যান তাঁর রাজনৈতিক জীবনে। শেখ মুজিব থেকে আওয়ামী লীগের কাণ্ডারী, সেখান থেকে বঙ্গবন্ধু; অতঃপর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি, রাষ্ট্রপতি/প্রধানমন্ত্রী, জাতির পিতা- সব ধরনের বরমাল্য শোভা পেয়েছে তাঁর গলায়। রাষ্ট্র পরিচালনার শীর্ষ ব্যক্তি এসব সময়ে এসেও বঙ্গবন্ধু ক্রীড়াকে ভালোবেসে গেছেন আমৃত্যু। ১৯৭২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি একাদশ ও স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া প্রধানমন্ত্রী একাদশের মধ্যকার ম্যাচ দিয়ে ঢাকা স্টেডিয়ামে প্রথম ফুটবল মাঠে গড়িয়েছিল। সেদিন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এবং প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উভয়েই মাঠে উপস্থিত থেকে সাদা পায়রা উড়িয়ে এবং জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে সেই খেলার উদ্বোধন করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী সেদিন একসঙ্গে স্টেডিয়ামে বসে খেলা উপভোগও করেছিলেন। সেই খেলায় রাষ্ট্রপতি একাদশ ২-০ গোলে জয়লাভ করেছিল। সেদিন বঙ্গবন্ধু জনৈক খেলোয়াড়ের ব্যাক পাস দিয়ে গোল করার পদ্ধতি দেখে বলে উঠেছিলেন, 'সবাই তো আর হাফেজ রশীদ নন'। 

১৯৭২ সালে কলকাতা মোহনবাগান দল ঢাকা একাদশ ফুটবল দলের সঙ্গে ফুটবল খেলতে ঢাকা সফর করে। বঙ্গবন্ধু সেদিনও খেলা শুরুর আগে মাঠে উপস্থিত হয়ে খেলোয়াড়দের উৎসাহ জুগিয়েছিলেন। বাংলাদেশ দল দেশের মাটিতে সেদিন সালাউদ্দিনের দেওয়া ১-০ গোলে জয়লাভ করে। ১৯৭৩ সালেও বঙ্গবন্ধু কলকাতা মোহনবাগান ও ঢাকা একাদশ দলের খেলা উপভোগ করেন স্টেডিয়ামে উপস্থিত থেকে। ১৯৭৩ সালে ঢাকা স্টেডিয়ামে রাশিয়ান মিনস্ক ডায়নামো বনাম বাংলাদেশ একাদশ দলের মধ্যে ফুটবল প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা স্টেডিয়ামে বঙ্গবন্ধু সেদিন তার ডানদিকে শেখ রাসেল, বাম দিকে তাজউদ্দীন আহমদসহ তাঁর মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের নিয়ে গ্যালারিতে বসে খেলা উপভোগ করেছিলেন। পরের বছর (১৯৭৪ সাল) বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামালের গড়া দল আবাহনী আইএফএ শিল্ড টুর্নামেন্ট খেলতে যায় কলকাতায়। বঙ্গবন্ধু তাদের এই যাত্রার প্রাক্কালে আবাহনীর খেলোয়াড়, কোচ, কর্মকর্তা প্রমুখকে বঙ্গভবনে ডেকে নিয়ে তাদের শুভেচ্ছা জানান। একইভাবে ১৯৭৫ সালে মালয়েশিয়ার মারদেকা টুর্নামেন্টে খেলতে যাওয়া বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের গণভবনে ডেকে নিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে তাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন- 'খেলায় জয়লাভের চেয়েও দেশের মান-সম্মান অনেক বড়।' তারা যেন এমন আচরণ না করে, যাতে দেশের সম্মান ক্ষুণ্ণ হয়। তিনি সেদিন খেলোয়াড়দের কঠোর অনুশীলনেরও তাগিদ দিয়েছিলেন এবং খেলাধুলার সার্বিক মান উন্নয়নে তাঁর সরকারের নানা পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টার কথাও তুলে ধরেছিলেন। শুধু বঙ্গবন্ধুই নন, তাঁর উত্তর প্রজন্মের সদস্যরাও এদেশের ক্রীড়াকে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর অবস্থায় নিয়ে যেতে অবদান রেখেছেন। আজকের ক্রীড়াঙ্গনের কতজন এসব ঘটনা জানে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক, বাংলাদেশ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড (BCAPC)-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি

SUMMARY

1546-1.jpg