অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিব সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন। সেই সঙ্গে নিহত হয়েছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি ও আবদুর রব সেরনিয়াবাতসহ অন্যরা। আগস্ট হত্যাকাণ্ডের চার যুগ পেরিয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কেন নিহত হলেন, কেন আগস্ট ক্যুদেতা সংঘটিত হয়েছিল সে সম্পর্কে প্রকৃত ও বিস্তৃত ঘটনা আজও উদ্ঘাটিত হয়নি। আগস্ট হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী বক্তব্যগুলো প্রণিধানযোগ্য। আগস্ট ক্যুদেতার ঘটনাবলির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করতে সরকারিভাবে কোনো তদন্ত কমিশন এ যাবৎ গঠিত হয়নি।
২. বিভিন্ন ঘটনা, মূল্যায়ন ও বক্তব্য বিশেল্গষণ করে আগস্ট হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে নানা প্রশ্ন এখনও অমীমাংসিত। এক. সিআইএ আগস্ট ক্যুদেতার সঙ্গে সংশিল্গষ্ট কিনা? দুই. আওয়ামী লীগের একটি অংশ এই ষড়যন্ত্র জ্ঞাত ছিল কিনা? তিন. ক্যুদেতার সঙ্গে খুনিরা জাতীয় আন্তর্জাতিক শক্তির সঙ্গে সংশিল্গষ্ট ছিল? চার. সামরিক, পুলিশ প্রশাসন, গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত ছিল কিনা?
এ কথা সত্য যে, খুনিরা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকলে এর নেপথ্যে বহু ব্যক্তি ও শক্তি প্রচ্ছন্নভাবে কাজ করেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নিহত হওয়ার পর মস্কোপন্থি সংগঠনগুলো থেকে এই অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে যে, সিআইএ শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে যে, শেখ মুজিবের 'সমাজতান্ত্রিক' নীতি পুঁজিবাদী আমেরিকান স্বার্থে আঘাত করেছিল। হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশ সফর করার পর সিআইএ এজেন্টরা তৎপর হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ সাংবাদিক লরেন্স লিফস্যুজ তার ঞযব টহভরহরংযবফ জবাড়ষঁঃরড়হ গ্রন্থে তৎকালীন সিআইএ ঢাকা ব্যুরোপ্রধান ফিলিপ চেরির উদৃব্দতি দিয়ে বলেছেন, অভ্যুত্থানকারী মেজররা '৭৪ সালের শেষ দিকে ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে সম্ভাব্য পরিবর্তন নিয়ে কথা বলেন। চেরির বক্তব্য অনুযায়ী সময়টা ছিল মুজিব নিহত হওয়ার আট মাস আগের। তথ্যটি কিসিঞ্জারের আগমনের সময় নির্দেশ করে। অভ্যুত্থানকারীরা মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছেন এ কথা সত্য। এই সংবাদ শেখ মুজিবের কানে পেঁৗছে যাওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল; কিন্তু যারা সংবাদ দেবে সেই গোয়েন্দা সংস্থার মূলাংশ ছিল খুনিদের দোসর। তৃতীয় বিশ্বের অনেক জাতীয়তাবাদী নেতা সিআইএর ষড়যন্ত্রে প্রাণ হারিয়েছেন। '৭৩ সালে এদের ষড়যন্ত্রে নিহত হয়েছিলেন চিলির প্রেসিডেন্ট আলেন্দে, যিনি একজন সমাজতন্ত্রী, নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। তবে কি '৭৫ সালের বাংলাদেশ পরিস্থিতি মার্কিন স্বার্থের পরিপন্থী ছিল? বাকশাল গঠন করে শেখ মুজিব পুরোপুরি সোভিয়েত বলয়ে চলে গিয়েছিলেন_ এ কথাটি সঠিক নয়। কেননা জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে তিনি জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছেন। নীতি ছিল সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব। কিন্তু নিক্সন প্রশাসনের আক্রোশ ছিল শেখ মুজিবের ওপর। উইলিয়াম মরিস যিনি ছিলেন কিসিঞ্জারের সহকারী, তিনি তার বইতে লিখেছেন, কিসিঞ্জারের তিনজন চিহ্নিত ব্যক্তিগত শত্রু ছিল। তারা হলেন_ থিউ, আলেন্দে ও মুজিব। তবে বহু পরিপ্রেক্ষিত স্পষ্ট করে, বঙ্গবন্ধু মার্কিনিদের কথা শোনেননি। বাংলাদেশ স্বাধীন করায় মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি দক্ষিণ এশিয়ায় হুমকির সম্মুখীন হয়। ফলে ক্ষোভের সৃষ্টি করে।
৩. মুজিব হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে দেশে এমন গুজব প্রচলিত ছিল যে, মেজর ডালিমের স্ত্রীকে গাজী গোলাম মোস্তফার ছেলে এক বিয়েবাড়িতে অসম্মান করেছিলেন। সংবাদ পেয়ে ডালিম সামরিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে নিজেই তার অধীন সেনাবাহিনী নিয়ে গাজীর বাড়ি ঘেরাও করে। ঊর্ধ্বতন সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপে তাকে ফিরে আসতে হয়। মেজর ডালিম বঙ্গবন্ধুর কাছে বিচার প্রার্থনা করলে বঙ্গবন্ধু তাকে বলেছিলেন, কোন অধিকারে ও আইনে তিনি শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন। সামরিক আইনে শৃঙ্খলা ভঙ্গ অমার্জনীয় অপরাধ। সামরিক আইনে তাকে দণ্ড দেওয়া হয়। এই ক্রোধ মেজর ডালিম সবসময় পোষণ করতেন। তবে অভ্যুত্থানকারীদের অন্যতম নেতা কর্নেল ফারুক ও কর্নেল রশীদ পত্রপত্রিকায় যে বিবৃতি দিয়েছেন তার সঙ্গে সাংবাদিক ম্যাসকারেন হাসের মূল্যায়নের কিছুটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। কর্নেল ফারুক ও কর্নেল রশীদ উলেল্গখ করেছেন, তারা '৭৪ সাল থেকে মুজিব উৎখাতের চেষ্টা করেছেন। তারা নিজেরাই ক্যুদেতার পরিকল্পনা করেন। তাদের দাবি অনুযায়ী, তারা তৎকালীন ডেপুটি আর্মি চিফ অব স্টাফ ও পরবর্তীকালে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সঙ্গে ক্যুদেতার ব্যাপারে আলোচনা করেছিলেন এবং তাকে নেতৃত্ব দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। জিয়া তাদের গ্রিন সিগন্যাল দেন।
৪. বঙ্গবন্ধু ছিলেন জাতীয়তাবাদী নেতা। জাতির স্বার্থই তার কাছে বড় ছিল। তবুও তিনি বৃহৎ শক্তিসহ সব রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব সহযোগিতার সম্পর্ক বজায় রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। যে সোভিয়েত রাশিয়া মুক্তির সংগ্রামে যেভাবে উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন, '৭৫-এর পূর্বে সে মনোভাব অনেকটা হ্রাস পায়। বঙ্গবন্ধুর জোটনিরপেক্ষ অবস্থান ধরে রাখায় সোভিয়েত ইউনিয়ন হতাশ হয়ে পড়ে। সোভিয়েত ইউনিয়ন মনে করেছে, শেখ মুজিব ধীরে ধীরে পশ্চিমা বিশ্বের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সমাজতান্ত্রিক নীতির ঘোরতর বিরুদ্ধে ছিল। তারা স্বাধীন বাংলা চায়নি। নিক্সনের উক্তি ছিল, 'ডব হবাবৎ ৎবপড়মহরংব ইধহমষধফবংয.' এ সময় ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তাদের পক্ষেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে উলেল্গখযোগ্য সাহায্য করতে পারেনি। সে কারণে লক্ষ্য করা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আসলেই তখন বৃহৎ শক্তির সক্রিয় সাহায্য পাননি। এর প্রমাণ মেলে '৭৪-এর খাদ্য সংকটের সময়। '৭৪ সালে ভারতের খাদ্য ঘাটতি ছিল। সোভিয়েত রাশিয়া ও চীন তাদের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য দুনিয়াজুড়ে খাদ্য ক্রয় করছিল। শুধু উদ্বৃত্ত খাদ্য ভাণ্ডার ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র; কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে খাদ্য প্রদান করেনি। বাংলাদেশ মাত্র ৫ মিলিয়ন অর্থে কিউবায় পাটের চট রফতানি করেছিল। সেজন্য বাংলাদেশকে তারা 'ট্রেডিং উইথ দি এনিমি অ্যাক্টে'র আওতায় খাদ্য দেয়নি। কিন্তু পিএল-৪৮০র সঙ্গে এই আইনের সম্পর্ক না থাকলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম খাদ্যের চালান বঙ্গোপসাগর থেকে জাহাজ বোঝাই খাদ্য অন্যত্র ডাইভার্ট করে। পরে অবশ্য যখন খাদ্য সরবরাহ করে তখন খাদ্য সংকট প্রায় ছিল না। কেননা নতুন ফসল তখন কৃষকের ঘরে উঠতে শুরু করেছে।
৫. কোনো কোনো মহলের ধারণা, ভারত ও সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ সামরিক অভ্যুত্থানের বিষয়টি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে জ্ঞাত করিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর জবাব ছিল, 'কোনো বাঙালি আমাকে হত্যা করতে পারে না।' বঙ্গবন্ধুর কথাটিই সত্য ছিল। খুনি ফারুক-রশীদ মনে-প্রাণে, ধ্যান-ধারণায় পাকিস্তানি। তারা এমন এক সময় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে এসেছিল ততদিনে মুক্তিযুদ্ধের অংশগ্রহণের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। সে কারণে তারা মুক্তিযোদ্ধা নয়। লিবিয়ার গাদ্দাফি ও পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টোর ব্রিফ নিয়ে তারা সেনাবাহিনীতে যোগদান করে। ভুট্টো ১৪ ডিসেম্বর '৭১ সালে জাতিসংঘে বলেছিলেন, বাংলাদেশকে পুনরায় অখণ্ড পাকিস্তানের আওতায় আনা হবে। ১৯৭৫ সালের ১১ আগস্ট কাকুলে সেনা অফিসারদের এক বৈঠকে ভুট্টো বলেন, অচিরেই উপমহাদেশে নাটকীয় পরিবর্তন হবে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান বঙ্গবন্ধুকে তার নিরাপত্তার বিষয়ে সতর্ক থাকার অনুরোধ জানালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, 'ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা উচিত।' বঙ্গবন্ধুর এ কথার মাধ্যমেই প্রমাণ হয় ,কোনো বাঙালি তাকে হত্যা বা ক্ষতি করতে পারে তা তিনি বিশ্বাস করতেন না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ডেভিড ফ্রস্ট বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিল, 'যিধঃং ুড়ঁৎ য়ঁধষরভরপধঃরড়হ?্থ বঙ্গবন্ধু উত্তর ছিল, 'ও ষড়াব সু ঢ়বড়ঢ়ষব.্থ ফ্রস্ট পাল্টা এক প্রশ্নে আবার বলেন, 'যিধঃং ুড়ঁৎ ফরংয়ঁধষরভরপধঃরড়হ?্থ বঙ্গবন্ধু জবাব দেন, 'ও ষড়াব ঃযবস ঃড়ড় সঁপয.্থ বাংলার জনগণের প্রতি আবেগময় ভালোবাসা ছিল তার সহজাত চারিত্রিক দুর্বলতা। এই দুর্বলতার সুড়ঙ্গ দিয়ে বিষাক্ত সর্পরা তাকে ছোবল মারতে উদ্যত ছিল।
৬. অনেকে বলেন, রক্ষীবাহিনী নামে মিলিশিয়া গঠন নিয়ে সেনাবাহিনীতে ব্যাপক অপপ্রচার চালানো হয়। মুজিব সম্পর্কে সেনাবাহিনীর একাংশের বড় অভিযোগ, তিনি সেনাবাহিনীকে পরিপূর্ণ বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। একই সঙ্গে সেনাবাহিনীর পাল্টা রক্ষীবাহিনী গঠন এই অংশকে হতাশ করেছিল। এদের কারও কারও মাঝে এমন ধারণা জন্মেছিল যে, কালক্রমে রক্ষীবাহিনী সেনাবাহিনীর স্থলাভিষিক্ত হবে। জিয়াউর রহমান এমন ধারণা পোষণ ও প্রচার করতেন। কর্নেল (অব.) শওকত আলীর বইতে এর বিস্তারিত বিবরণ আছে। এই হতাশা ও ক্ষোভ থেকে আগস্ট অভ্যুত্থানের জন্ম বলে কেউ কেউ মনে করেন। এর পেছনে ছিল সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বঙ্গবন্ধু যাদের বিশ্বাস করতেন।
৭. জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পটভূমি তৈরির জন্য বিভিন্নভাবে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়েছে। মূলকথা হলো, প্রতিবিপল্গবী পরাজিত শক্তি ও স্বাধীনতাবিরোধী চক্র জাতির পিতাকে হত্যা করে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের ধ্যান-ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় মোশতাক-মার্কিন বল্গুপ্রিন্ট ছিল স্বাধীনতা নয়, পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন। এক নাজুক পরিস্থিতিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে তাদের পূর্বপরিকল্পিত বল্গুপ্রিন্ট কার্যকর করতে চেয়েছে।
৮. হেনরি কিসিঞ্জার লিখেছেন, 'জীবিত মুজিবের চেয়ে মৃত মুজিব হবে আরও শক্তিশালী।' মিথ্যার বেড়াজাল ছিন্ন করে প্রতিদিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু আরও মহীয়ান ও প্রদীপ্ত আলোকশিখার মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠছেন। প্রয়োজন তার আদর্শের আলোকবর্তিকা হাতে সমগ্র জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করে উজ্জ্বল আগামীর দিনে এগিয়ে যাওয়ার সব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করার দুরন্ত দুঃসাহস।