তোফায়েল আহমেদ
আজ ১৫ আগস্ট। জাতীয় শোক দিবস। আজকের এই কালরাত্রিতে শাহাদাতবরণকারী সবার প্রতি আমার শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। এই দিনে জাতির জনককে তাঁর পরিবারের ১৭ জন সদস্যসহ নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। ঘাতক খুনিচক্র স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল দেশের অগ্রগতিকে। ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সকল অর্জনকে- আওয়ামী লীগকে, সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে। অবৈধ পন্থায় রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে কুখ্যাত ইনডেমনিটি বিল চাপিয়ে দিয়ে তৎকালীন সামরিক সরকার এই ঘৃণ্য মানবতাবিরোধী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের পথ রুদ্ধ করে রেখেছিল। দীর্ঘ ২১টি বছর এর বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম শেষে ১৯৯৬-এ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার অবৈধ ইনডেমনিটি বিল সংবিধান থেকে অপসারণ করে। বিচারের পথ হয় সুগম। প্রচলিত আইনে একজন বিচারপ্রার্থী নাগরিক বিধি-বিধান অনুযায়ী যেসব সুবিধাদি পেয়ে থাকেন, সেভাবেই চলে বিচারিক প্রক্রিয়াটি। এবং বিজ্ঞ আদালত খুনিদের ফাঁসির রায় ঘোষণা করেন। পরবর্তী সময়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে বিচারের রায় ভণ্ডুল করতে খুনিচক্রকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য বিভিন্ন রকম টালবাহানা শুরু করে। এর বিরুদ্ধে আমাদের প্রাণপ্রিয় দল, বাংলাদেশের আপামর গণমানুষের দল, জাতির জনকের নিজ হাতে গড়া দল, জাতীয় মুক্তি-সংগ্রামের নেতৃত্ব প্রদানকারী দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কখনো এককভাবে, কখনো বা মৈত্রীজোট গঠন করে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সমমনাদের ঐক্যবদ্ধ করে রাজপথে-সংসদে কঠিন লড়াই-সংগ্রাম শেষে ২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বরে বাংলার মানুষের গণরায়ের ভিত্তিতে আমরা অভিশাপমুক্ত হয়েছি। দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে যে গ্লানি আমরা বয়ে বেড়াচ্ছিলাম, তা থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করে বাঙালির ইতিহাস আজ কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। সমগ্র জাতি সেদিন কী হারিয়েছিল, আর হারানোর ৩৫ বছর পর, খুনিদের ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার পর আজ যেন তা সম্যকভাবে সামগ্রিকতায় উপলব্ধি করার সময় এসেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে এবারের জাতীয় শোক দিবস তাই সবিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
বঙ্গবন্ধু তাঁর সমগ্র জীবনব্যাপী একটিই সাধনা করেছেন, আর তা হচ্ছে বাংলা ও বাঙালির মুক্তির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করা। তাঁর এই সাধনার শুরু ১৯৪৮ থেকে। ১৯৪৭-এ দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন এই রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে আমরা বাঙালিরা নির্যাতিত-নিষ্পেষিত হব। তাই ’৪৮-এর জানুয়ারির ৪ তারিখে গঠন করেছিলেন ছাত্রলীগ এবং ’৪৯-এর জুনের ২৩ তারিখে আওয়ামী লীগ। এবং সেই থেকে ধাপে ধাপে প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। আমরা আজ বিস্মৃত হয়েছি ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্ব ’৪৮-এর মার্চের ১১ তারিখটি। ’৫২-এর পূর্বে ’৪৮-এর মার্চ মাসের ১১ তারিখটি ভাষা দিবস হিসেবে পালিত হতো। আর এই পর্বের ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু স্বয়ং।
পাকিস্তান সৃষ্টির গোড়া থেকেই শাসক শ্রেণীর কোনো অন্যায়কে তিনি আন-চ্যালেঞ্জ যেতে দেননি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ-প্রতিবাদ করাকে তিনি ন্যায়সঙ্গত জ্ঞান করতেন। বঙ্গবন্ধুর কৈশোর জীবনেই এর প্রমাণ মেলে। ১৯৩৯-এ তিনি গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। সে সময় শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের স্কুল পরিদর্শনে আসা ও তাঁকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষ দলের বচসা হয়। বঙ্গবন্ধু ছিলেন সংবর্ধনার পক্ষে এবং পক্ষ-বিপক্ষ গ্রুপগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে তিনি একটি সফল সংবর্ধনা সভার আয়োজন করেন। কিন্তু এক চক্রান্তের ফাঁদে পড়ে পুলিশ কর্তৃক সাতদিনের জন্য কারারুদ্ধ হন। জীবনের প্রথম কারাবন্দি হওয়ার অভিজ্ঞতায় তিনি দমে যাননি বরং আরো দুঃসাহসী হয়ে ওঠেন। একই স্কুলে ছাত্র থাকাকালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ওই স্কুল পরিদর্শনে আসেন। সে সময় বঙ্গবন্ধু তাঁদের পথরোধ করে দাঁড়ান এবং বলেন, ‘স্যার, আমাদের স্কুলের বোর্ডিংয়ের ছাদ ভাঙা। বৃষ্টি হলেই ছাদ দিয়ে পানি পড়ে। ওটা আমরা ঠিক করে নিতে চাই।’ কিশোর বঙ্গবন্ধুর বলার ভঙ্গিতে মুগ্ধ হয়ে সোহরাওয়ার্দী সাহেব সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, তোমার দাবি পূরণ করা হবে।’ দাবি পূরণ হয়েছিল এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেব এই কিশোরকে তার ডাকবাংলোয় দেখা করতে বলেছিলেন। নির্দিষ্ট সময়ে বঙ্গবন্ধু শহীদ সাহেবের সঙ্গে দেখা করলেন এবং দীক্ষা নিলেন এক নতুন জীবনের। যে জীবনের নাম রাজনীতি ও সংগ্রাম। বাল্যকাল ও কৈশোর জীবন থেকেই যে সংগ্রামের শুরু তা থেমে থাকেনি বরং কালক্রমে তা বিস্তৃত ও প্রসারিত হয়ে সমগ্র বাঙালি জাতির জাতীয় মুক্তি-সংগ্রামের এক মহৎ প্রচ্ছদপট এঁকে স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠেন ইতিহাসের মহামানব।
১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারির মহান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে, ’৫৬-এর শাসনতন্ত্রের জন্য আন্দোলন, ’৬২-এর ১৭ সেপ্টেম্বরের শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৪-এর সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলন এবং ’৬৬-এর ৭ জুনে ছয় দফা আন্দোলন প্রতিটি সংগ্রামেই বঙ্গবন্ধু মুজিবের একচ্ছত্র নেতৃত্ব। বঙ্গবন্ধু মুজিবকে প্রথম দেখি ১৯৫৭ সালে, ভোলার সরকারি স্কুল মাঠের উপনির্বাচনী জনসভায়। তখন আমি অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। ভোলায় অনুষ্ঠিত এক জনসভায় সোহরাওয়ার্দী সাহেব ও বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা করেছিলেন। আমরা স্কুলের ছাত্ররাও এসেছিলাম আমাদের রূপকথার নায়ক সকলের প্রিয় মুজিব ভাইয়ের বক্তৃতা শোনার জন্য। কৈশোরের সে অনুভূতি ভাষায় ব্যক্ত করবার নয়। রাজনীতি করার বয়স তখনো হয়নি। অনেক দূর থেকে মুজিব ভাইয়ের সুন্দর গোছানো বক্তৃতা মন্ত্র-মুগ্ধের মতো শুনেছিলাম।
১৯৬৬-এর ৭ জুনে ৬ দফা আন্দোলন চলাকালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ছাত্রলীগের সার্বক্ষণিক কর্মী, ইকবাল হল (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ভিপি। শেখ ফজলুল হক মণি, আমাদের প্রিয় মণি ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা সেদিন হরতাল কর্মসূচি পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আমার স্মৃতিপটে এখনো ভাস্বর হয়ে আছে সেদিনটি। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মণি ভাই এসেছেন হরতালের সপক্ষে প্রচারকাজ চালানোর জন্য। তিনি তখন ছাত্র নন। ড. ওদুদুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ছিলেন। তিনি মণি ভাইকে বললেন, ‘মণি, তুমি এখন ছাত্র নও। তুমি ক্যাম্পাসে অবস্থান কোরো না, চলে যাও। তুমি যদি না যাও তবে আমার চাকরি যাবে।’ মণি ভাই স্যারের কথায় সবিনয়ে সম্মতি জানিয়ে আমাদের হরতাল কর্মসূচি যথাযথভাবে পালনের নির্দেশ দিয়ে ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন। সেদিনের হরতাল কর্মসূচিতে ধর্মঘটী ছাত্র-জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য সরকারের নির্দেশে পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। ফলে তেজগাঁওয়ে শ্রমিক মনু মিয়া, মুজিবুল্লাহসহ ১১ জন শহীদ হন এবং প্রায় ৮০০ লোককে গ্রেফতার করা হয়। আমরা যারা ছাত্রলীগের কর্মী ছিলাম, আমাদের রাজনৈতিক চেতনার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল এদিনটিতেই। এরপর ১৯৬৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। সেদিন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহ-সভাপতি নির্বাচিত হই। তখন ৬ দফার আন্দোলন চলছে। বঙ্গবন্ধু কারাগারে অন্তরীণ। সেদিন রাতেই তাঁর কাছ থেকে একটা গোপন পত্র পাই। সেটাই বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে পাওয়া প্রথম চিঠি। তিনি লিখেছেন, ‘স্নেহের তোফায়েল, তুই ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হওয়ায় আমি খুব খুশি হয়েছি। আমি বিশ্বাস করি, এই ডাকসুর নেতৃত্বে বাংলাদেশে একটি আন্দোলন গড়ে উঠবে। মুজিব ভাই।’ ১৯৫৭-তে মুজিব ভাইকে প্রথম দর্শনের যে অনুভূতি, এরপর ১০ বছরের ব্যবধানে তাঁর কাছ থেকে পাওয়া চিঠি এবং সেই চিঠিতে আমার সাফল্য কামনা করে ডাকসুর নেতৃত্বে আন্দোলন গড়ে উঠবে এমন নির্দেশনা যে কী পরিমাণে উজ্জীবিত করেছিল আমায় তা আমাদের সংগ্রামের সাফল্যগাথাতেই দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। ’৬৯-এর ১৭ থেকে ২৪ জানুয়ারির গণ-আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থান। ৯ ফেব্রুয়ারি ১১ দফা বাস্তবায়ন ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে শপথ দিবস পালন। স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পদত্যাগ, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুসহ সকল রাজবন্দির নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ১৯, ২০ ও ২১ ফেব্রুয়ারি লাগাতার সংগ্রাম শেষে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম প্রদান। অতঃপর ২২ ফেব্রুয়ারি সকল রাজবন্দির মুক্তির পর বঙ্গবন্ধুর মুক্তিলাভ। ২৩ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ১০ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে মুক্ত মানব শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রদান।
পঞ্চাশের দশক থেকে বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের লক্ষ্যে গড়ে তোলা সকল আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। মনে পড়ে, ১৯৭০-এ বরিশাল-পটুয়াখালী-ভোলা অঞ্চলে নির্বাচনী সফরের কথা। ’৭০-এর নির্বাচনে বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ৬ দফা এবং ছাত্রসমাজের ১১ দফার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করে। এ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু আমাকে জাতীয় পরিষদে মনোনয়ন দেন এবং মাত্র ২৭ বছর এক মাস ১৫ দিন বয়সে আমি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হই, যা আমি স্বপ্নেও কল্পনা করি নাই। ২৪ ফেব্রুয়ারি ছিল ভোলায় নির্বাচনী জনসভা। এদিন ভোলার ইতিহাসে সর্ববৃহৎ গণসমাবেশে বঙ্গবন্ধু আমার গুণবাচক বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তিনি নেতা-কর্মীদের এভাবেই সম্বোধন করতেন। যখন যে এলাকায় যেতেন, তখন সে এলাকার সংগঠক বা নেতাকর্মীকে মহিমান্বিত করে বক্তব্য রাখতেন। নিজে কর্মী থেকে সংগঠক হয়েছেন, সংগঠক থেকে নেতা হয়েছেন, নেতা থেকে জাতীয় নেতা এবং পরিশেষে জাতীয় নেতা থেকে জাতির জনক হয়েছেন। আর এটি সম্ভবপর হয়েছে অসংখ্য কর্মীকে তিনি নেতা বানিয়েছেন, অসংখ্য নেতাকে স্থানীয় পর্যায় থেকে টেনে তুলে উন্নীত করেছিলেন জাতীয় নেতায়। ফলে সারা দেশে আওয়ামী লীগ তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজও বঙ্গবন্ধুর চেতনা ধারণ করেই টিকে আছে।
১৯৭১-এর জানুয়ারির ৩ তারিখের কথা। ঐতিহাসিক রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে ৭০-এর নির্বাচনে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। শপথ গ্রহণ করাবেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। সেদিন বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘৬ দফা ও ১১ দফা আজ আমার নয়, আমার দলেরও নয়। এ আজ বাংলার জনগণের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। কেহ যদি এর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে বাংলার মানুষ তাঁকে জ্যান্ত সমাধিস্থ করবে। এমনকি আমি যদি করি আমাকেও।’ জনগণের জন্যই ছিল তাঁর রাজনীতি ও কর্মসূচি। তিনি তাঁর বক্তৃতায় সেদিন আরো বলেছিলেন, ‘আমাকে মোনেম খান কাবু করতে পারেনি, এমনকি আইয়ুব খানও পারেনি কিন্তু আমাকে দুর্বল করে দিয়েছে আপনাদের এই অকুণ্ঠ ভালোবাসা। আপনারা দোয়া করবেন যেন আপনাদের এই ভালোবাসার মর্যাদা দিতে পারি।’ বাংলার মানুষের প্রতি ভালোবাসার মর্যাদা তিনি রক্ত দিয়ে পরিশোধ করে গেছেন। কবিগুরুর ভাষায়, ‘আমৃত্যু দুঃখের তপস্যা এ জীবন, সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে, মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে দিতে।’
মনে পড়ে ১৯৭৩-এর ১৭ মার্চের কথা। সেদিন আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর ৫৪তম জন্মদিবসে জিল্লুর রহমানের (প্রয়াত রাষ্ট্রপতি) সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রবীণ নেতা শ্রদ্ধাভাজন জননেতা কমরেড মণি সিংহ তাঁর স্মৃতিচারণায় বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫১ সালে কারাগারে থাকাকালেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরিকল্পনা করেছিলেন।’ চিঠিপত্র আদান-প্রদানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর এই পরিকল্পনার কথা অবহিত হয়েছিলেন জানিয়ে তিনি আরো বলেছিলেন, ‘যদিও আমাদের মতপার্থক্য ছিল, তথাপি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের কাছে এটা জানতে চেয়ে প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলেন যে, স্বাধীনতা সংগ্রামকে আমরা সমর্থন করব কি না।’ এবং সেই সভায় তিনি অকপটে স্বীকার করেছিলেন যে, তিনি তখন ধারণাটির বিরোধিতা করেছিলেন এবং ভেবেছিলেন যে, স্বাধীনতার জন্য সমগ্র জনগণ মানসিকভাবে প্রস্তুত নয় এবং এ ধরনের উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত সফল হবে না। সেদিন মহান মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম নেতা কমরেড মণি সিংহ আরো বলেছিলেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘজীবন কামনা করি। কোনো জনতা তাদের নেতা নির্বাচনে ভুল করে না। বাংলাদেশের জনগণও তাঁর পশ্চাতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে এবং তাঁকে মুক্তিদাতা হিসেবে গ্রহণ করেছে।’ প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত সকলেই একবাক্যে এ কথার সাথে একমত পোষণ করবেন। কেননা বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের প্রতিটি ধাপেই বাঙালির সার্বিক মুক্তির জয়গান গেয়েছেন। তিনি তো সব সময় বলতেন, এমনকি দু-দুবার মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তিনি বলেছেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’ যে বাংলার স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, যে বাংলার জন্য তিনি যৌবনের অধিকাংশ সময় কারাগারে কাটিয়েছেন, ফাঁসির মঞ্চে গেয়েছেন বাঙালির জয়গান, সেই বাংলা ও বাঙালির জন্য তাঁর হৃদয়ের ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। সমুদ্র বা মহাসমুদ্রের গভীরতা পরিমাপ করা সম্ভব; কিন্তু বাংলা ও বাঙালির জন্য বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ের যে দরদ, যে ভালোবাসা তার গভীরতা অপরিমেয়।
বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে কত কথা, কত স্মৃতি আজ মনের চারপাশে ভিড় করে। এমন মহামানবের সান্নিধ্য কেঁদেও আর পাব না কোনোদিন, এমনটা ভাবলেই মন খারাপ হয়ে যায়। মনে পড়ে ১৯৭১-এর রক্তঝরা মার্চের ১৭ তারিখের কথা। সেদিন ছিল বঙ্গবন্ধুর ৫২তম জন্মদিন। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা শেষে দুপুরে ধানমণ্ডির বাসভবনে বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে ঘরোয়া আলোচনাকালে একজন সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনার ৫২তম জন্মদিনে আপনার সবচাইতে বড় ও পবিত্র কামনা কী?’ উত্তরে বঞ্চিত বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা স্বভাবসুলভ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘জনগণের সার্বিক মুক্তি।’ এরপর সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জ্ঞাপনকালে তিনি ব্যথাভারাতুর কণ্ঠে বেদনার্ত স্বরে বলেছিলেন, ‘আমি জন্মদিন পালন করি না, আমার জন্মদিনে মোমের বাতি জ্বালি না, কেকও কাটি না। এ দেশে মানুষের নিরাপত্তা নাই। আপনারা আমাদের জনগণের অবস্থা জানেন। অন্যের খেয়ালে যেকোনো মুহূর্তে তাদের মৃত্যু হতে পারে। আমি জনগণেরই একজন, আমার জন্মদিনই কি, আর মৃত্যুদিনই কি? আমার জনগণের জন্য আমার জীবন ও মৃত্যু।’ কত বিশাল হৃদয়ের মহৎ মনের অধিকারী মানুষ ছিলেন তিনি। নিজের সবকিছুই তিনি জনগণের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। অতি সাধারণ জীবন ছিল তাঁর। রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়েও সরকারি বাসভবনে থাকতেন না। নিরাভরণ, ছিমছাম আর আটপৌঢ়ে ৩২ নম্বরের বাড়িটিতেই আমৃত্যু থেকেছেন। ধানমণ্ডিতে যখন প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়, তখন ভালো একটি প্লট নেওয়ার জন্য সবার শত অনুরোধ সত্ত্বেও বলেছিলেন, ‘আগে সবাইকে দাও, তারপর যদি থাকে তখন দেখা যাবে।’
নিজের জন্য কিছুই চাইতেন না। অপরের দুঃখ-কষ্টের প্রতি অপরিসীম দরদ তাঁকে সর্বদাই আবেগাপ্লুত করত। একবার এক জনসভায় তিনি বলেছিলেন, ‘একজন মানুষ আর কী চাইতে পারে-আমি যখন ভাবি, দূরে এক জনশূন্য পথের ধারে আধো আলো-ছায়ায় এক লোক লণ্ঠন হাতে দাঁড়িয়ে আছে শুধু আমাকে একনজর দেখবে বলে, তখন মনে হয়, একজন মানুষের পক্ষে আর কী চাওয়া-পাওয়ার থাকতে পারে।’ নিরন্ন-হতদরিদ্র-মেহনতী মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল প্রগাঢ় ভালোবাসা। তা প্রতিফলিত হয়েছে, অভিব্যক্ত হয়েছে তাঁর প্রতিটি কর্মে এবং চিন্তায়। ১৯৭৩-এর ৯ সেপ্টেম্বর, আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত-শোষক আর শোষিত; আমি শোষিতের পক্ষে।’
বঙ্গবন্ধুর কথা এবং বক্তৃতায় প্রায় সময়ই উদ্ধৃত হতো রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত-জীবনানন্দের কবিতার চরণ। এত সাবলীল আর প্রাসঙ্গিকতায় তিনি কবিতা আবৃত্তি করতেন, মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে হতো। মনে পড়ে ১৯৭১-এর রক্তঝরা মধ্য মার্চের কথা। যখন ইয়াহিয়ার সাথে আলোচনা চলছে, তখন সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে নজরুলের কবিতা থেকে বলতেন, ‘আমি নরকে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি।’ কবিগুরুর কবিতা থেকে বলতেন, ‘চারিদিকে নাগিনীরা ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস, শান্তির ললিত বাণী শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।’ সে সময় অগ্নিঝরা মার্চে একদিকে চলছে আলোচনার নামে ইয়াহিয়ার প্রহসন, অন্যদিকে যুদ্ধ-প্রস্তুতি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমরা প্রতিদিন ঐক্যবদ্ধ হচ্ছি। সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলার কাজ পূর্ণোদ্যমে এগিয়ে চলেছে। এমতাবস্থায়, রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ছিল নেতার অভয় মন্ত্র। এই মার্চেই টঙ্গীতে পাক সেনাবাহিনীর গুলিতে বহু শ্রমিক হতাহত হয়। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের এক বিশাল মিছিল ভয়াল গর্জনে সমবেত হয় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে। উত্তেজিত শ্রমিক শ্রেণীর উদ্দেশে বক্তৃতাদান শেষে বিদ্রোহী কবিকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, ‘বিদ্রোহী রণক্লান্ত, আমি সেইদিন হবো শান্ত, যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ ভূমে রণিবে না...।’ আশ্চর্যরকম অবলীলায় পরিস্থিতি-পরিবেশের সঙ্গে যুক্ত করে মৃত্যুঞ্জয়ী শক্তি নিয়ে তিনি এসব কাব্যাংশ উচ্চারণ করে যেতেন।
মনে পড়ে, ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় দেরাদুনে মুজিব বাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্পে শপথ গ্রহণের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলোর কথা। শপথনামা পাঠের সময় আমরা সমস্বরে বলতাম, ‘বঙ্গবন্ধু মুজিব, তুমি কোথায় আছ, কেমন আছ আমরা জানি না। কিন্তু যতদিন আমরা প্রিয় মাতৃভূমি এবং তোমাকে মুক্ত করতে না পারব, ততদিন আমরা মায়ের কোলে ফিরে যাব না।’ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী দিনগুলোতে বাঙালির চেতনায় বন্দি মুজিব ছিলেন, মুক্ত মুজিবের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। যারা ষড়যন্ত্রকারী তাদের হোতা খুনি মুশতাক তো তখনই আমাদের কাছে প্রশ্ন তুলেছিল, ‘জীবিত মুজিবকে চাও, না স্বাধীনতা চাও।’ আমরা বলতাম, ‘আমরা দুটোই চাই। স্বাধীনতাও চাই, বঙ্গবন্ধুকেও চাই।’ ত্রিশ লাখ প্রাণ আর দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা বাংলার স্বাধীনতা এবং বঙ্গবন্ধু মুজিবকে মুক্ত করতে পেরেছিলাম।
১৯৬৬-এর ৮ মে থেকে ’৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ৩৩ মাস কারাবন্দি ছিলেন তিনি। তাঁর ১৪ বছরের জীবনে দীর্ঘ কারাবাস। ১৯৬৯-এ মহান গণ-অভ্যুত্থানের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে আমরা সেদিনও বঙ্গবন্ধু মুজিবকে কারামুক্ত করতে ৬৯-এর ৯ ফেব্রুয়ারি শপথ দিবসে এই বলে শপথ নিয়েছিলাম, ‘শপথ নিলাম শপথ নিলাম, মা-গো তোমায় মুক্ত করব; শপথ নিলাম শপথ নিলাম, মুজিব তোমায় মুক্ত করব।’ সেদিনও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারাবন্দি বঙ্গবন্ধু মুজিব ছিলেন মুক্ত মুজিবের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। দুবারই আমরা দুর্বার গণ-আন্দোলন ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করে জাতির জনককে কারামুক্ত করেছিলাম। ’৬৬ থেকে ’৬৯ সময়কালে সংঘটিত গণ-আন্দোলনে রাজপথ প্রকম্পিত করা স্লোগান ছিল ‘জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব।’ কিন্তু দুঃখ আর বিষাদের সাথে বলতে হয়, স্বাধীন বাংলাদেশেই ঘৃণ্য ঘাতকরা জাতির জনককে এমন নির্মমতায় হত্যা করল। কিন্তু হত্যা করতে পারল না বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে। এ চেতনা যে অবিনাশী, এর বিনাশ নাই। এ চেতনার বাহক আওয়ামী লীগ। আর এ দল থেকেই প্রতিনিয়ত প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে লাখো মুজিব জন্ম নিচ্ছে। পৃথিবীর কোনো ঘাতকের শক্তি নাই যে, এ চেতনাকে হত্যা করে নিঃশেষ করতে পারে।
১৯৭৫-এর জানুয়ারির ১১ তারিখের কথা আমার স্মৃতির মণিকোঠায় এখনো জ্বলজ্বল করে। হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসে দীর্ঘশ্বাস। এদিন বাংলাদেশ সামরিক একাডেমিতে প্রথম শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠানে বিদায়ী ক্যাডেটদের উদ্দেশে এক মর্মস্পর্শী বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “... আমি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে একথা বলছি না, তোমাদের জাতির পিতা হিসাবে আদেশ দিচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী অনেক হবেন, অনেক আসবেন, প্রেসিডেন্টও অনেক হবেন, অনেক আসবেন। কিন্তু জাতির পিতা একবারই হন, দুবার হন না। জাতির পিতা হিসাবেই যে আমি তোমাদের ভালোবাসি, তা তোমরা জানো। আমি তোমাদের আবার বলছি, তোমরা সৎ পথে থাকবে, মাতৃভূমিকে ভালোবাসবে। মনে রেখো তোমাদের মধ্যে যেন পাকিস্তানি মনোভাব না আসে। তোমরা পাকিস্তানের সৈনিক নও, বাংলাদেশের সৈনিক। তোমরা হবে আমাদের জনগণের বাহিনী।’ দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর স্বৈরতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামের অভিজ্ঞতা থেকে জাতির জনক যে শিক্ষা অর্জন করেছিলেন সেই চেতনায় স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে তিনি ‘জনগণের বাহিনী’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। বক্তৃতায় তিনি বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর অভিপ্রায় ব্যক্ত করে, সেনাসদস্যদের আদর্শবান হওয়ার, সৎ পথে থাকার অঙ্গীকার করে দৃঢ়তার সঙ্গে স্নেহার্দ্য কণ্ঠে কবি জীবনানন্দ দাশের জননী কবি কুসুমকুমারী দাশের কবিতা থেকে উদ্ধৃত করেছিলেন, ‘মুখে হাসি বুকে বল তেজে ভরা মন, মানুষ হতে হবে মানুষ যখন।’
অতুলনীয় সংগঠক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রত্যেককে দেখতেন নিজ পরিবারের সদস্যের মতো। প্রতিটি নেতা-কর্মীর বিপদ-আপদে তিনি তাদের পাশে দাঁড়াতেন পরম হিতৈষীর মতো। মমতা মাখানো সাংগঠনিক প্রয়াস নিয়ে কর্মীদের হৃদয় জয় করে নেওয়ার ব্যতিক্রমী এক ক্ষমতা ছিল তাঁর। ১৯৭২-এর ১৪ এপ্রিল, আমি তখন গ্যাস্ট্রিক-আলসারে আক্রান্ত হয়ে হলিফ্যামিলিতে চিকিৎসাধীন। আমার পাকস্থলীতে নালি-ঘায়ের অপারেশন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু আমাকে দেখতে এসেছেন। সস্নেহে আমার হাত ধরে, পরম মমতায় কপালে হাত বুলিয়ে আদর করে আমার খোঁজ-খবর নিয়েছিলেন। আমার একমাত্র মেয়ে মুন্নী যখন দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে, তখন টিভিতে ওর অনুষ্ঠান দেখে ওকে স্নেহাশীষ জানিয়েছিলেন। অপরিসীম ভালোবাসা ছিল শিশুদের প্রতি। ছবি তুলতে ভালোবাসতেন। ফটোগ্রাফার অনেকেই প্রশ্ন করতেন, ‘লিডার আপনি এত ছবি তোলেন কেন?’ বলতেন, ‘ভবিষ্যতের মানুষ যারা, ওরা বড় হয়ে দেখবে কেমন ছিল ওদের নেতা।’ বঙ্গবন্ধু যখন গণভবনে যেতেন, সামনে পেছনে দুটি গাড়ি থাকত। রাস্তায় ট্রাফিক সিগন্যাল পড়লে আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ত। তখন এ রকম স্বয়ংক্রিয় সিগনাল বাতি ছিল না। একদিনের কথা খুব মনে পড়ে। একবার আমাদের গাড়ি সিগনালে দাঁড়ানো। হঠাৎ, একটি শিশু কত বয়স হবে সাত কি আট, গাড়ির কাছে এসে বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে বলছে, “আসসালামু আলাইকুম, মুজিব সাহেব!” তৎক্ষণাৎ বঙ্গবন্ধু শিশুটির হাত ধরে আদর করলেন, ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আমি পাশে বসে দেখছি একজন রাষ্ট্রনায়কের, জাতির জনকের শিশুদের প্রতি কী অপার ভালোবাসা, কী অপূর্ব মমত্ববোধ। আজ মনে হয়, ‘এখন এসব স্বপ্নকথা দূরের শোনা গল্প; তখন সত্যি মানুষ ছিলাম এখন আছি অল্প।’
বঙ্গবন্ধু ছিলেন পরশ পাথরের মতো। তাঁর পুণ্য হস্তের ছোঁয়ায় আমরা সকলেই গোটা বাঙালি জাতি নিরস্ত্র থেকে সশস্ত্র হয়েছিলাম; অচেতন থেকে সচেতনতার এমন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিলাম যে আমরা স্বপ্ন দেখতাম শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের। দীর্ঘ নয় মাস চৌদ্দ দিন কারাবাসের পর পাকিস্তানের জিন্দানখানা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি রেসকোর্সের সর্বকালের সর্ববৃহৎ ঐতিহাসিক গণমহাসমুদ্রে তিনি বলেছিলেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি।’ অশ্রুসিক্ত নয়নে উচ্চকিত হয়েছিলেন এই বলে যে, ‘কবিগুরু, তুমি এসে দেখে যাও, তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে, তুমি ভুল প্রমাণিত হয়েছো, তোমার কথা আজ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে...।’
বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে স্মৃতির পাতা থেকে আমি আমার অভিজ্ঞতাই আজকের লেখায় লিখছি। বঙ্গবন্ধু মনপ্রাণ উজাড় করে ভালোবাসতেন প্রিয় মাতৃভূমিকে, বাঙালি জাতিকে। হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতেন বাঙালির দুঃখ-কষ্ট। বাঙালির জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে তিনি বাংলায় মিশে আছেন। দেশের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় তাঁর পবিত্র স্মৃতি অমর হয়ে আছে এবং থাকবে তা চিরকাল। বাঙালির প্রতিটি বসত, নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, দিগন্ত প্রসারিত সবুজে উজ্জ্বল হয়ে থাকা প্রিয় স্বদেশের বুক জুড়ে কেবলই জনকের ছবি। বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে আমার স্মৃতির শেষ নেই। দুনিয়ার অনেক দেশ আমি সফর করেছি বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হয়ে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আন্তর্জাতিক প্রতিটি ফোরামে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। ওই সময়ে খুব কাছ থেকে অনেক কিছু দেখেছি, অনেক কিছু শিখেছি। আজো কানে বাজে, চেতনায় অনুরণন তোলে বঙ্গবন্ধুর কতো কথা। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার সম্পর্কে আমাদের বলতেন, ‘বাংলার মানুষ রাজনীতিকের কাছে ধর্মের ব্যাখ্যা যেমন শুনতে চায় না, তেমনি ধার্মিকের মুখে রাজনীতির ব্যাখ্যাও শুনতে চায় না।’
১৯৭৪-এর ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দিয়ে দারুণ এক অসাধ্য সাধন করে গেছেন বঙ্গবন্ধু। আমার এখনো চোখে ভাসে হিমালয় সমান উচ্চতার তেজোদ্দীপ্ত এই মানুষটি জাতিসংঘে মাতৃভাষা বাংলায় কী সাবলীল বক্তৃতাই না করলেন। জাতিসংঘে যে ছয়টি ভাষায় বক্তৃতা দেওয়ার রেওয়াজ ছিল, তার মধ্যে বাংলা ছিল না। আন্তর্জাতিক ফোরামে প্রথম বাংলাভাষী এই নেতার বক্তৃতা শুনে সেদিনের উপস্থিত রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সবাই বিমোহিত হন। ভাষণ শেষ হওয়ার পর নিজ নিজ আসন থেকে উঠে এসে কেউ করমর্দন করে, আবার কেউ বা বুকে জড়িয়ে ধরে শুভেচ্ছা জানান বঙ্গবন্ধুকে। বাংলা ভাষা সেদিন থেকেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নতুন মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়।
বঙ্গবন্ধুর একান্ত সান্নিধ্যে থেকে দেখেছি তাঁর কৃতজ্ঞতাবোধ, বিনয়, মানুষের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা। আকাশের মতো উদার ছিল তাঁর হৃদয়। জ্যোতির্ময় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি। স্বদেশে কিংবা বিদেশে সমসাময়িক নেতা বা রাষ্ট্রনায়কদের তাঁর তেজোময় ব্যক্তিত্বের ছটায় সম্মোহিত করার, উদ্দীপ্ত করার এক আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল বঙ্গবন্ধুর। বীরত্ব, সাহস ও তেজস্বতার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে তিনি ছিলেন ভাস্বর। তাঁর কাছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ছিল ন্যায়সঙ্গত। খুব সহজেই মানুষকে কাছে টেনে নিতেন। নাম মনে রাখতে পারতেন মাঠপর্যায়ের কর্মীদেরও। তিনি যা কিছু করতেন, চিন্তা-ভাবনা করেই বলতেন এবং একবার যা বলতেন, সেখান থেকে একচুলও নড়চড় করতেন না। আর সম্ভবত এই একটি মাত্র কারণেই বঙ্গবন্ধুর জীবনের কোথাও ব্যর্থতার ছাপ পড়েনি। তিনি কেবলমাত্র নেতা হওয়ার বাসনা নিয়ে আওয়ামী লীগের জন্ম বিকাশ ঘটাননি। অসংখ্য নেতা-কর্মী সৃষ্টি করে দেশকে পরাধীনতার গ্লানিমুক্ত করেছিলেন। আর তাই তো তিনি জাতির জনক হয়েছেন, হয়েছেন নেতারও নেতা।
প্রতিটি বাঙালির মতো আওয়ামী লীগের প্রতিটি কর্মীকেও হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা দিয়ে কাছে টেনে নিতেন বঙ্গবন্ধু। কর্মীরাই ছিল তাঁর সবকিছু। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দক্ষতা বাড়াতে তিনি সারা দেশ চষে বেড়িয়েছেন। বঙ্গবন্ধু সৎ, নিষ্ঠাবান কর্মীদের কাজের মূল্যায়ন করতেন। তাদের উৎসাহ দিতেন নানাভাবে। প্রশংসা করে কর্মীদের নব-উদ্যমে উজ্জীবিত করতেন। কর্মীদের ক্ষুদ্র অবদানকে অনেক বড় করে দেখিয়ে তাকে আরো বড় ভূমিকা পালনে উদ্দীপ্ত করার অনুপ্রেরণা দিতেন। বিশাল হৃদয়ের এই মানুষটি সকল রকমের ঝড়-ঝাপ্টা থেকে কর্মীদের আগলে রাখতেন। কোনোরকম পারিবারিক, আমলাতান্ত্রিক বা গোষ্ঠীগত কায়েমি স্বার্থবাদী ফ্রেমে বন্দি থাকার মানুষ তিনি ছিলেন না; ইতিহাসের ফ্রেমে বরণীয় আর আদৃত ছিলেন তিনি। যেকোনো স্তরের কর্মী যখন-তখন ইচ্ছা করলেই বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে তাদের আনন্দ-বেদনার কথা জানাতে পারতেন। আর এ কারণেই বঙ্গবন্ধু ছিলেন সর্বস্তরের বাঙালির হৃদয়ের নয়নমণি। জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন, আর স্বৈরশাসকের রক্ত চক্ষু ছিল বঙ্গবন্ধুর নিত্যদিনের সঙ্গী। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন বহুবার। একাধিকবার ফাঁসির মঞ্চ তৈরি ছিল তার জন্য। বাঙালির প্রতি বিশ্বাস এবং আস্থার পরিমাণ ছিল আকাশচুম্বী। সে জন্যই বীরদর্পে হাসিমুখে, নির্ভীকচিত্তে দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য এসব জুলুম নির্যাতনকে বরণ করেছেন।
মনে পড়ে ১৯৭৪-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি, বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হয়ে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলন সংস্থার সম্মেলনে গিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানের লায়ালপুরের মিয়ানওয়ালী কারাগারে বন্দি ছিলেন তখন যিনি কারা কর্মকর্তা ছিলেন, জনাব হাবিব আলীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল সেখানে। হাবীব আলী আমাদের বলেছিলেন, ‘বন্দি থাকা অবস্থায়, বিচারকার্য চলাকালীন অবস্থায় তোমাদের নেতার মুখ থেকে আমরা একটি শব্দও বের করতে পারিনি। তোমরা মহা সৌভাগ্যবান এই কারণে যে, তোমরা এমন একজন নেতা পেয়েছো যিনি সত্যিই মহান। কারাগারের পাশে তাঁর জন্য কবর খোঁড়া হয়েছিল এবং আমরা তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আত্মপক্ষ সমর্থন বা অন্তিম কোনো ইচ্ছা তোমার আছে কি না। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে নিয়ে এই নাটকের যখন যবনিকাপাত ঘটবে, আমার অন্তিম ইচ্ছা, আমার লাশটা যেন আমার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে পাঠানো হয়।” কমনওয়েলথ সম্মেলনে তানজানিয়ার প্রেসিডেন্ট জুলিয়াস নায়ারের সঙ্গে যখন দেখা হয়েছিল, তখন তিনি আমাদের বলেছিলেন, ‘তোমরা এমন একজন নেতা পেয়েছো যিনি শুধুমাত্র তোমাদের নেতা নন, সমগ্র বিশ্বে নির্যাতিত মেহনতী মানুষের নেতা।’ বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে এতসব দুর্লভ গুণের সমাবেশ ঘটেছিল বলেই তিনি বাঙালি জাতির জনক।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব হিসেবে তাঁর একটা তহবিল থাকত আমার কাছে। এই তহবিল থেকে বিভিন্নজনকে সাহায্য-সহায়তা করতেন। এর মধ্যে দলীয় নেতা-কর্মী ছাড়াও বিরোধী দলের প্রতিপক্ষীয় লোকজনও ছিল। কিন্তু শর্ত ছিল যাদেরকে অর্থ সাহায্য দেওয়া হচ্ছে, তাঁদের নাম-ঠিকানা গোপন রাখতে হবে, প্রকাশ করা যাবে না। বঙ্গবন্ধু কখনোই মানুষের মনে আঘাত দিয়ে কথা বলতেন না। তাঁর রাজনৈতিক বক্তব্য ছিল মার্জিত, কখনোই রাজনৈতিক বক্তব্যে ব্যক্তিগত বিষয়কে প্রাধান্য দিতেন না। বঙ্গবন্ধুর সময়ানুবর্তিতা-নিয়মানুবর্তিতা ছিল অসাধারণ। সময়ের এক চুল হেরফের হতো না, ঘড়ি ধরে অনুষ্ঠানাদিতে যেতেন। দলের নেতা-কর্মী সবার প্রতি ছিল গভীর মমত্ববোধ। তাদের কাজের মর্যাদা দিতেন, ভালোবেসে বুকে টেনে নিতেন। প্রচণ্ড রেগে গেলেও পরমুহূর্তেই শিশুর মতো শান্ত হয়ে যেতেন। অফুরন্ত প্রাণশক্তির অধিকারী বঙ্গবন্ধুর সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল অপরিসীম। এক মুহূর্তে মানুষকে আপন করে নেওয়ার অবিশ্বাস্য ক্ষমতা ছিল তাঁর। নীতির প্রশ্নে ছিলেন অটল। মনে পড়ে, ১৯৭৪-এ দলের কাউন্সিলে দলীয় পদ ত্যাগ করে সভাপতির পদটি ছেড়ে দিয়েছিলেন। তদস্থলে আসীন হয়েছিলেন শ্রদ্ধাভাজন জননেতা শহীদ কামরুজ্জামান সাহেব। ঠিক ১৯৫৭-তে করেছিলেন বিপরীত কাজটি অর্থাৎ মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দলীয় পদে বহাল করেছিলেন নিজেকে। সময়ের চাহিদা অনুযায়ী নিজস্ব অবস্থান কোথায় হওয়া উচিত সেটি যেমন বুঝতেন; তেমনিভাবে কে কোথায় যোগ্যতর আসনে অধিষ্ঠিত হবেন তাঁকে সে জায়গাটিতে যথাসময়ে যথামর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে দিতে ভুল করতেন না মোটেও। বজ্রকণ্ঠের অধিকারী বঙ্গবন্ধু ছিলেন অতুলনীয় বাগ্মী। আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল বক্তৃতায় বিভিন্ন কবির কবিতা থেকে উদ্ধৃতি চয়ন যা আমি আগেই উল্লেখ করেছি। যেজন্য তাঁকে অভিহিত করা হয়েছিল ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গুণবাচক বৈশিষ্ট্যের কথা বলে শেষ করা যাবে না। তাঁর সারা জীবনের কর্মের মধ্যেই ছড়িয়ে আছে এই অমর, অবিনাশী চেতনা। তিন যুগেরও অধিক সময় জুড়ে প্রবাহিত এই মহান মানুষটির বিপুল কর্মময় রাজনৈতিক জীবনে যে আচরণ চর্চিত হয়েছিল, তার মধ্যে ছড়িয়ে আছে হিরণ্ময় দ্যুতি ছড়ানো মানবিক কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতিমানবিক সব আচরণ বৈশিষ্ট্য। যা সত্যি সত্যিই দুর্লভ, সচরাচর দৃষ্ট নয়। আমার পরম সৌভাগ্য হয়েছিল ইতিহাসের এই মহামানবের একান্ত সান্নিধ্যে আসার। আমার জীবন ধন্য। বঙ্গবন্ধু ছিলেন পরশপাথরের মতো। বঙ্গবন্ধুর চেতনা অমর, অবিনাশী-এর মৃত্যু নেই।
লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, বাণিজ্যমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার