প্রতি বছর ১৫ই আগস্ট ভারতজুড়ে মহাসমারহে স্বাধীনতা দিবস পালিত। কিন্তু প্রতিবছর ১৫ আগস্ট ওপার বাংলায় শোকের ছায়া নেমে আসে। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টেই তো গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।সেদিন প্রাণে বেচে গিয়েছিলেন মুজিবরের কন্যাদ্বয় - শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা
১৫ই আগস্টের কাকভোরে গোটা পরিবার সহ খুন করা হয়েছিল মুজিবরকে। তাঁর পরিবারের মাত্র দু'জন সেদিন রক্ষা পেয়েছিলেন। তাঁর কন্যাদ্বয় - শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। সে অভিশপ্ত দিনে সেনাবাহিনী মুজিবরের বাড়িতে ঢুকে তাঁকে ও তাঁর গোটা পরিবারকে যখন হত্যা করলেন তখন তাঁর দুই কন্যা ইউরোপে ছিলেন।
সেই সময় বহু বছরের পাক শাসনের থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছিল বাংলাদেশ। অনেকেই মনে করেন যে এই হত্যা আদতে পাকিস্তানের কারসাজি যাদের পিছনে ভারত বিরোধী শক্তি ও বাংলাদেশিদের একাংশের মদত ছিল।
বহু বছর ধরে অনেকেই বিশ্বাস করে এসেছেন যে মুজিবরের উপর এই ধরণের আক্রমণ হতে পারে তা নাকি কেউই ঘুণাক্ষরে টের পায়নি। তবে এখন শোনা যায় যে ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নাকি স্বয়ং মুজিবরকে সতর্ক করেছিলেন যে তাঁর জীবনের আশঙ্কা রয়েছে। এমনও বলা হচ্ছে যে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র-য়ের তৎকালীন প্রধান সেই সময় মুজিবরকে উদ্ধার করবার জন্যে একটি হেলিকপ্টারেরও ব্যবস্থা করে ছিলেন।
দুর্ভাগ্যবশত, তা আর কোনও কাজে আসেনি। আর, বাকিটা তো ইতিহাস।
অনেকেরই ধারণা যে মুজিব সরকারের ক্যাবিনেট মন্ত্রী খন্দকার মুস্তাক এই আক্রমণের ছক কষেছিলেন। তিনিই মুজিবরের স্থলাভিষিক্ত হন। এছাড়াও পাক-পন্থী বাংলাদেশী রাজনৈতিক নেতারাও এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে মনে করা হয়। দেশের সেনাবহিনীর এক বড় অংশও এই হত্যাকাণ্ডে যোগ দিয়েছিল কারণ তাদের রাজনৈতিক ভাবে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছিল।
এখানে উল্লেখযোগ্য, সেনাবাহিনীর তৎকালীন সহকারী প্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানও এই ষড়যন্ত্রে সামিল ছিলেন। এই জিয়াউর রহমান কিন্তু পরবর্তীকালে সে দেশের সেনা প্রধান এমনকি বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টও হন। তাই বলে এটা মনে করার কারণ নেই যে তিনিই একমাত্র সেনাবাহিনী অফিসার নন যিনি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তদন্তে জানতে পাওয়া গিয়েছে যে সেই সময় প্রায় গোটা সেনাবাহিকে মুজিবরের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত করে তোলা হয়েছিল।
মুজিব হত্যার আগের দিন ফারুক আহমেদ নামের একজন সেনাবাহিনী অফিসার এক জ্বালাময়ী মুজিব-বিরোধী বক্তৃতা দেন। তিনি মূলত মুজিবের নীতি-আদর্শের সমালোচনা করেছিলেন। এই হত্যা কাণ্ডের আরেক জন খলনায়ক হচ্ছেন মুয়াম্মার গদ্দাফি যিনি খুব সম্ভবত মুজিব-বিরোধী শক্তিকে অর্থদান করে সাহায্যে করে ছিলেন। দুঃখের বিষয় সেই সময় ফারুক আহমেদর জ্বালাময়ী বক্তৃতা সেই সময় বাংলাদেশ সরকার কিংবা বাংলাদেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর কানে পৌঁছায়নি। তা পৌঁছালে হয়ত এত বড় মর্মান্তিক ঘটনার এড়ানো যেত।
মুজিবের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বলয় সেদিন মুজিবকে রক্ষা করতে ডাহা ব্যর্থ হয়েছিল।
মুজিব তাঁর দেশ ও দেশের মানুষের জন্যে এত কিছু করেছেন। তাই তাঁকে বঙ্গবন্ধু বলে সম্বোধন পর্যন্ত করা হয়। কিন্তু এরকম একজন পিতৃতুল্য চরিত্রকেও প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দিতে পাড়া গেল না। সত্যি খুবই বেদনাদায়ক।
খুবই লজ্জাজনক, যে মুজিবের মৃত্যুর পর তাঁর হত্যাকারীদের ব্যাপক সম্মান দেওয়া হয়েছিল এবং প্রত্যেককেই উচ্চপদে আসীন করা হয়েছিল।
ঐতিহাসিক এএফ সালাহউদ্দিন মুজিবের জীবনীতে এক জায়গায় লিখেছেন, "শেখ মুজিবর রহমানের মতো রাজনৈতিক নেতা বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে খুব কমই এসেছেন যাঁর নাম নিয়ে, অথচ অনুপুস্থিতিতে, একটি দেশ সস্বাধীনতা লাভ করল। একাত্তরের যুদ্ধে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ আদতে মুজিবের দীর্ঘ সংগ্রামেরই ফসল। তিনি দেশকে ঘুরে দাঁড় করবার জন্যে মাত্র তিন বছর সময় চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর শত্রুরা চেয়েছিলেন তিনি যেন জীবিত না থাকেন। তাই তো ১৫ই অগাস্ট, ১৯৭৫ সালে তাঁকে তাঁর পরিবার সহ হত্যা করা হল। মৃত্যুর পরেও তিনিই কিন্তু বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক প্রতীক রয়ে গিয়েছেন।"
তাঁর বাবার মৃত্যু থেকে শিক্ষা নিতে হবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তথা মুজিবর কন্যা শেখ হাসিনাকে। তাঁকে যেনতেন প্রকারে নিশ্চিত করতে হবে যেন দেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর মুহূর্তের জন্যেও ঢিলেমি না আসে। হাজার হোক, সামনেও সুযোগ পেলেই নিজের কার্যসিদ্ধি বা অভীষ্ট লক্ষ পূরণের লোকের তো অভাব নেই।