বাঙালি জাতির একটি ভয়ঙ্কর মাস আগস্ট। এমন একটি মাস আমাদের জীবনে আসবে এটি দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি। আমরা যারা মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম, বঙ্গবন্ধুর ক্ষতি হোক এটা কেউ চায়নি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নিজের লোকের মধ্যেই কিছু ছিল যারা বঙ্গবন্ধুকে এক সাইডে রেখে নিজেরা কর্তৃত্ব করতে চেয়েছিল। এদের মধ্যে একজন হলো খন্দকার মোশতাক। খন্দকার মোশতাক যুদ্ধের সময়ই আমেরিকান ইনটেলিজেন্সের মাধ্যমে সে তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। এটা যখন তাজউদ্দীন জানতে পারেন তখন তাকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিয়ে দেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। কিন্তু খন্দকার এটা ভুলতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এলেন। মোশতাক চক্রই তাজউদ্দীনকে সরালো। মোশতাক তার কিছু লোকজনকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সরিয়ে নিজে সামনে চলে যেতে চাইছিল। তার কিছু লোকের মধ্যে জিয়াউর রহমান একজন। তারা সব সময় ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত থাকতো। এদিকে ১৯৭২-এ বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পরে, তখনো আমাদের সেনাবাহিনী গড়ে ওঠেনি। স্বাধীন হওয়ার পরে আমাদের সেনাবাহিনীর কিছু নেই বললেই চলে। দায়িত্বটা আমাকে দেয়া হয়। আমি আস্তে আস্তে করছিলাম। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই আমি কাজ করি। দেশের একটা অঙ্গ হলো- ইনটেলিজেন্স অর্থাৎ খবরাখবর। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তখন জিজিএফআই প্রধানকে (একজন এয়ার ভাইস মার্শাল, নামটা ভুলে গেছি) সরিয়ে দিয়ে ব্রিগেডিয়ার রউফকে প্রধান করা হলো। যেহেতু একটা নিউ আর্মি সেহেতু সবকিছু নতুনভাবেই হচ্ছিল। মিলিটারি ইনটেলিজেন্সও তখনো প্রসার লাভ করেনি। আমরা জিজিএফআই নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। কারণ সব সার্ভিসে তাদেরই ইনটেলিজেন্স দেয়ার কথা। ১৯৭৪ পর্যন্ত ওই অর্গানাইজেশনটা আর্মি হেড কোয়ার্টারেই ছিল। ডিজি প্রতিদিন সকালে এসে আমাকে ও অন্যান্য চিফকে ব্রিফ করতেন, কোথায় কী হচ্ছে। ১৯৭৪-এর পরে ডিজিএফআইরা আর আমাদের থেকে প্রেসিডেন্স সেক্রেটারিতে চলে যায়। বাই দ্যান আমাদের মিলিটারি ইনটেলিজেন্সটা প্রসার লাভ করেনি। ফলে আমরা ডিপেন্ডেন্ট ছিলাম ডিজিএফআইয়ের ওপর। কিন্তু ডিজিএফআই চলে যাওয়ার পরে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যেতো না। তাকে ডেকে এনে কথা শুনতে হতো। শুনেছি ডিজিএফআইয়ের মধ্যেই একটা অংশ নাকি খারাপ ছিল। সত্যি মিথ্যা জানি না। ১৫ আগস্টের ঘটনা তারা হয়তো কিছু না কিছু জানছেই। কিন্তু আমাকে কেউ কিছু বলেনি। অন্য কাউকে বলছে কি না, আমি জানি না। এমনকি বঙ্গবন্ধুকে বলেছে কি না তাও আমার জানা নেই।
আমি ছাড়া সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন সবাই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের বিষয়ে জানতেন। কিন্তু কেউ আমাকে সে বিষয়ে কিছু জানাননি। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি অ্যাটাক হয়েছে এটি আমি জানতে পারি ১৫ আগস্ট সকালে। ফজরের নামাজের পরপর। ওইদিন আমি অনেক ক্লান্ত থাকায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালের নামাজটা আমি পড়তে পারিনি। আমার সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের লেফটেন্যান্ট কর্নেল সালাউদ্দিন সকালে আমার বাসায় এসে বলেন, স্যার, আপনি কি আর্মার ও আর্টিলারিকে শহরের দিকে পাঠিয়েছেন? আমি বললাম, নাতো। কেন? তিনি জানালেন, তারা তো বঙ্গভবনের দিকে যাচ্ছে, রেডিও স্টেশনের দিকে যাচ্ছে। এর আগে আর্মির কিছু সদস্য ট্যাংক নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে গেছে। তখন আমি বললাম, তুমি তো জেনেছো, শাফায়াত কি এসব জানে? সালাহউদ্দিনের উত্তর, স্যার আমি জানি না। আমি জেনেই আপনার কাছে দৌড়ে এলাম। তখন আমি ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার শাফায়াত জামিলকে তার তিনটা (প্রথম, দ্বিতীয় ও চতুর্থ) ব্যাটালিয়ন নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিই। এটি বলে আমি সালাহউদ্দিনকে শাফায়াতের কাছে পাঠাই।
সালাহউদ্দিনকে নির্দেশ দিয়ে আমি ঘরে ঢুকে প্রথমেই রেড টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুকে টেলিফোন করি। আমি তাঁকে ১২-১৪ বার ফোন করি। কিন্তু পাচ্ছিলাম না। শুধু এনগেজড আর এনগেজড। অন্য লাইনের মাধ্যমেও পাচ্ছিলাম না। তখন আমি আমার সেটটা আমার স্ত্রীর কাছে দিয়ে বললাম, তুমি বারবার চেষ্টা করতে থাক। লাইন পেলেই আমাকে দেবে। এর মধ্যেই আমি শাফায়াতকে ফোন করি। তাকে জিজ্ঞেস করি, তুমি কি জানো, আর্মার আর আর্টিলারি শহরের দিকে গেছে। সে বললো, না তো। আমি সালাহউদ্দিনের উদ্ধৃতি দিয়ে বললাম, তুমি তাড়াতাড়ি এটি প্রতিহত করার জন্য ব্যাটালিয়ান নিয়ে যাও। তিনটা ব্যাটালিয়নই পাঠাও। এই বলে আমি ফোন রাখি। একজন সেনাপ্রধান সরাসরি অ্যাকশনে যান না। তিনি তার অধীনস্থকে নির্দেশ দিয়ে কাজ করান। আমি ওই রাতে শাফায়াত জামিলকে নির্দেশ দিয়েছিলাম, তার অধীনের তিনটি ট্রুপ নিয়ে দ্রুত বঙ্গবন্ধুর বাড়ি যেতে। এছাড়া আমি সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের (ডিএমআই) লেফটেন্যান্ট কর্নেল সালাহউদ্দিনকে নির্দেশে দিয়েছি, শাফায়াত জামিলের বাড়ি গিয়ে আমার বার্তা পৌঁছাতে। কিন্তু শাফায়াত জামিল আমার নির্দেশ অমান্য করেছেন। শোনেনি। বরং উল্টো মিথ্যা কথা বলেছেন তার বইয়ে, আমি নাকি কোনো নির্দেশ দেইনি। সালাহউদ্দিন এখনো বেঁচে আছেন, তিনি এই সত্যটি অস্বীকার করতে পারবেন না। তাকে আমি শাফায়াত জামিলের কাছে পাঠিয়ে বলেছিলাম, তুমি গিয়ে বলো, তার কাছে যে তিনটি ব্যাটেলিয়ন আছে, তা নিয়ে প্রতিরোধ করতে। ওই সময় সালাউদ্দিন আর খালেদ মোশাররফ ছাড়া আমার কমান্ড তখন কেউ শোনেনি। আমি সবকিছুর বিহাইন্ডে ছিলাম। আমাকে অন্ধকারে রেখে তারা ষড়যন্ত্র করে, যখনই সফল হয়েছে, তখনই আমার নির্দেশ আমলে নেয়নি।
যাহোক, আমার স্ত্রীর কাছ থেকে টেলিফোন নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ফোন করি। এরপর রিসিভ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, সফিউল্লাহ, তোমার আর্মি আমার বাড়ি আক্রমণ করেছে। কামালকে মনে হয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও। আমি তাকে বলেছি, ‘স্যার আই এম ডুয়িং সামথিং। ক্যান ইউ গেট আউট অব দ্য হাউজ।’ কারণ আমি এর আগেই শাফায়াত জামিলকে নির্দেশ দিয়েছি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু আর কোনো নির্দেশ আমাকে দিলেন না। আমি হ্যালো হ্যালো করছি, মনে হলো টেলিফোনটা সেটে না রেখে টেবিলে বা কোথাও ছিল- আমি আওয়াজ পাচ্ছি। এর মিনিটখানেকের মধ্যেই আমি কিছু গুলির আওয়াজ পাই। আমার মনে হয়, সেটাই হয়তো বঙ্গবন্ধুর ওপর আক্রমণ ছিল। ৬টার আগেই হবে। কারণ আমি যখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলি খুব সম্ভবত পৌনে ৬টা। এরপর আমি আমার সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও ডেপুটি চিফ মেজর জেনারেল জিয়াকে ফোন করি। তারা দুজনই আমার বাসায় আসেন। জিয়া অফিসিয়াল পোশাকে অফিসের গাড়িতে অফিসের ড্রাইভার নিয়ে আসেন। ক্লিন সেভ। তাকে দেখে খুব নিশ্চিত মনে হচ্ছিল। আর খালেদ মোশাররফ আসেন ¯িøপিং স্যুট পরে নিজেই ড্রাইভ করে। আমি দুজনকেই জানাই। শাফায়াত জামিলকে নির্দেশ দেয়ার কথাও তাদের জানাই। কিন্তু কোনো কর্মকাণ্ড দেখছি না। খালেদকে শাফায়াতকে সহায়তা করার নির্দেশ দেই। খালেদ মোশাররফকে বাহিনী নিয়ে এগিয়ে যেতে বলি। কিন্তু জিয়াউর রহমান বাধা দিচ্ছিল। পাঠাইও না, পাঠাইও না করে এক পর্যায়ে এসে বলে, ‘হি ইজ গোয়িং টু স্পয়েল।’ (স্পয়েল মানে আমি বুঝতে পারিনি।) এর মধ্যে ডিজিএফআইয়ের প্রধান রউফ এলেন। সবাই আমার দরজা দিয়ে বাসা এলেও রউফ এল দেয়ালের পেছন দিক গলফ মাঠ দিয়ে। আমার সেন্ট্রি বলল, রউফ কিছু জিনিসপত্র নিয়ে গলফ মাঠের একটা গাছের নিচে বসেছিল তার স্ত্রী ও বাচ্চাদের নিয়ে। ওখান থেকেই সে আমার বাসায় আসে। এসেই আমাকে বলে, ‘ডোন্ট লিসেন টু জিয়া। হি ইজ এসোশিয়েটেড উইথ দিস’ তখন আমার এসব চিন্তা করার সময় ছিল না। বললাম, ঠিক আছে, এখন অফিসে যাই। আমার এডিসি গাড়ি নিয়ে আসার পরই অফিসে গেলাম। এ সময় জিয়াও আমার সঙ্গে অফিসে আসেন।
সকাল ৬টার দিকে অফিসে এসে জানলাম, বঙ্গবন্ধু ইজ ডেড। সালাহউদ্দিনই আমাকে জানায়। আই কুড নট টেক ইট। শোনার পর আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল। আমি বেঁচে আছি না মরে গেছি- এই অনুভূতি বোঝাতে পারব না। এডিসি সালাহউদ্দিন বলল, স্যার এখন ইমোশনাল হওয়ার সময় না। নিজেকে কন্ট্রোল করেন। অফিসে শাফায়াত আর খালেদের খবরের অপেক্ষা করছি। এ সময় খালেদ মোশাররফ ফোনে জানায়, তাকে ওরা আসতে দিচ্ছে না। আমি বলি, কারা আসতে দিচ্ছে না? কিন্তু কোনো উত্তর পাই না। ৮টার দিকে হবে- মেজর ডালিম তার প্রায় ১৭/১৮ জন সৈন্য নিয়ে সশস্ত্র অবস্থায় আমার অফিসে আসে। ডালিম সরাসরি আমার রুমে ঢুকে আমার খুব কাছে এসে অস্ত্র তাক করে। তখন আমি আমার দিকে তাক করা অস্ত্রের নলে হাত দিয়ে বলি, এই অস্ত্র আমি দেখে এবং ব্যবহার করে অভ্যস্ত। তুমি যদি এটি ব্যবহার করতে এসে থাকো, তাহলে করো। আর যদি কিছু বলার জন্য এসে থাকলে অস্ত্র আর অন্য সেনাদের বাইরে রেখে এসে কথা বল। তখন সে অস্ত্র নামিয়ে রেখে বলে, স্যার, আমি আপনাকে রেডিও স্টেশনে নিয়ে যেতে এসেছি। প্রেসিডেন্ট আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছেন। বললাম, প্রেসিডেন্ট? আমি তো শুনেছি, বঙ্গবন্ধু আর বেঁচে নেই তাহলে তিনি আমাকে কীভাবে ডেকে পাঠান। ডালিম তখন বলে, বাই নাউ খন্দকার মোশতাক ইজ দ্য প্রেসিডেন্ট। তিনি আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছেন। আমি বলি, খন্দকার মোশতাক মে বি ইয়োরস প্রেসিডেন্ট, বাট হিজ ইজ নট মাইন। হতে পারে না। তোমরা যা পার করতে পার। আমি তোমার সঙ্গে কোথাও যাব না। এ কথা বলে আমি তাদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বাইরে এসে আমার গাড়িতে উঠতে যাই। ঠিক এ সময় পেছনে তাকিয়ে দেখি আমার পেছনে জিয়াউর রহমান, এর পেছনে ডালিম এবং তাদের পেছনে খালেদ মোশাররফ। বারান্দা থেকে নেমেই জিয়া ডালিমের দিকে ঘুরে বলে, ‘কনগ্রাচুলেশন ডালিম, ওয়েলডান, ওয়েলডান, কিস মি, কিস মি। এসো আমার গাড়িতে ওঠো।’ এই কথা শুনে আমি খুব অবাক হয়ে যাই। তখনই আমার মনে হয় এর মধ্যে তার হাত আছে। তখন ডালিম বলল, ‘না আমি কোনো জেনারেলের গাড়িতে উঠব না। আমার সঙ্গে গাড়ি আছে।’ এদিকে খালেদ আমাকে সবকিছু জানাতে এসেছিল কিন্তু ওদের জন্য কোনো কথা বলতে পারেনি। শুধু বলেছিল, তারা তাকে কিছু করতে দিচ্ছিল না। তারা বলছে আমাকে নিয়ে যেতে।
এরপর আমি গাড়িতে ওঠার পরে আমার গাড়িটাকে তারা কন্ট্রোল করে ৪৬ ব্রিগেডে আর্মারে নিয়ে যায়। ওইখানে গিয়ে আমি কাউকে পাই না। তারা আমাকে বসিয়ে রেখে নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী প্রধানকে নিয়ে আসে। সেখান থেকে আমাদের তিনজনকে অস্ত্রের মুখে বেতার কেন্দ্রে নিয়ে যায়। ওখানে গিয়ে দেখি একটা খামরার মধ্যে একটা গোল কাচের টেবিলে একটা মাইক্রোফোন লাগানো আর এর সামনে খন্দকার মোশতাক বসে আছেন, তার পাশে দাঁড়িয়ে তাহের উদ্দিন ঠাকুর। আমাকে দেখেই মোশতাক বলল, ‘সফিউল্লাহ, কংগ্রাচুলেশনস। ইয়োর ট্রুপস ডান আ ওয়ান্ডারফুল জবস। নাউ ডু দ্য রেস্ট।’ আমি বললাম, হোয়াট রেস্ট? আমাকে বলে, ‘ইউ সোড নো ইট বেটার।’ আমি বললাম, ইন দ্যাট কেস লিভ ইট টু মি। বলে বেরিয়ে যাব, কিন্তু দরজার সামনে লোকেরা আমাকে বের হতে দেয়নি। তারা আমাকে পাশের একটি কামরায় নিয়ে যায়। ওইখানে তাহের উদ্দিন ঠাকুর এসে সরকারকে সমর্থন দিয়েছি এরকম একটা লেখা নিয়ে এসে পড়তে বলে। এরপর সেটা আমাদের পড়তে হয়েছে, যা তারা রেকর্ড করে প্রচার করেছে।
সেখান থেকে তারা আমাদের (তিনবাহিনী প্রধানকে) বঙ্গভবনে নিয়ে যায়। ওখানে গিয়ে আমাদের ড্রইং রুমে বসায়। তখন খন্দকার মোশতাককে জিজ্ঞেস করি, বঙ্গবন্ধুকে কোথায় শেষকৃত্য করা হবে। আমার উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় সংসদ ভবনের কোথাও বঙ্গবন্ধুকে সমাহিত করা হোক। উনি আমাকে উত্তর দিলেন, ‘রাস্তাঘাটে তো কত লোক মইরা পইড়া থাকে, আমার কি সবার কথা চিন্তা করতে হবে? যেখানে খুশি সেখানে হোক, তবে ঢাকায় নয়।’ এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার তখন আমার পাশেই দাঁড়ানো। তিনি আমাকে কথা না বলার জন্য ইশারা করলেন। এরপর মোশতাক জানাল, হেলিকপ্টার দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে টুঙ্গিপাড়া পাঠানো হবে। এদের সিদ্ধান্তেই একটি আর্মি কন্টিনজেন্টে করে বঙ্গবন্ধুকে তার গ্রামের বাড়ি পাঠানো হয়।
১৫ থেকে ১৮ আগস্ট পর্যন্ত ৪ দিন এক কাপড়েই আমাকে বঙ্গভবনে আটকে রাখা হয়েছিল। আমাকে আসতে দেয়নি। আমার পরিবারের কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। মার্শাল ল’ হবে কি হবে না, এ নিয়ে কনফারেন্স করার কথা বলে কার্যত আমাকে ওখানে আটকে রাখা হয়। এজন্য গেজেট নোটিফিকেশন করার চাপ দেয় মোশতাক। আমি তখন বললাম, এত চিন্তা করার দরকার কি, গেজেট যা হওয়ার তা আপনারা নোটিফিকেশন করে ফেলেন। আর আমাকেই বা এখানে রাখার দরকার কী? তখন আমাকে মোশতাক বলে, আমি কেন গেজেট নোটিফিকেশন করব? মার্শাল ল’ ডিক্লেয়ার করেছে তোমার সোলজার। আমি তাকে পাল্টা জিজ্ঞেস করি, তোমার সোলজার মানে? এরা আমার সোলজার হলে আমার নাম বলত। ওরা আপনার, তাই আপনার নাম বলেছে। মার্শাল ল’ আপনার নামেই হবে।
এদিকে ১৫ আগস্টেই মন্ত্রীদের শপথ হয়। বঙ্গবন্ধুর চার সহযোগী ছাড়া প্রায় সবাই শপথ নেন। শপথের পরে জেনারেল ওসমানীর কাছ থেকে একটা টেলিফোন আসে। আমিন আহমেদ চৌধুরী (যিনি নিজে থেকেই প্রেসিডেন্টের সামরিক সচিব পদ দখল করেন) এসে বলেন, জেনারেল ওসমানী আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। টেলিফোন ধরার সঙ্গে সঙ্গেই মোশতাকের মতো ওসমানীও বলে উঠলেন, অভিনন্দন সফিউল্লাহ। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্যার, ডু আই ডিজার্ভ দিস কংগ্রাচুলেশনস?’ তিনি বললেন, ‘ইউ ডোন্ট নো হোয়াট আ ওয়ান্ডারফুল জব ইউ হ্যাভ ডান।’ আমি বললাম, ‘আই ডোন্ট নো এন্ড আই কান্ট টেক ইট।’
১৭ আগস্ট আমি তখনো বঙ্গভবনে, সকালে প্রথমে খালেদ মোশাররফ এসে আমাকে জানায় ১৫ আগস্ট এমুনেশন ছাড়াই ট্যাংকগুলো ক্যান্টেনমেন্ট থেকে বেরিয়েছিল। আমি হতবাক। খালেদ বলে আমিই তো গতকাল (১৬ আগস্ট) তাদের এমুনেশন দিলাম। আমি ক্ষুব্ধ হয়ে বলি, তুমি দিলে অথচ আমাকে জানালে না কেন? সে বলল, আই থিংক ইউ ডোন্ট লাইক দিস। কাজটা ঠিক হয়নি খালেদ, এখন তারা অনেক বেশি শক্তিশালী। এরপর সে অনুতপ্ত হয়। খালেদ যাওয়ার কিছু পরে ১০টার দিকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশগ্রহণকারী মেজর রশিদ আমার কাছে এসে বসে। আমি তাকে বলি, আচ্ছা রশিদ, বঙ্গবন্ধুর হত্যার এই পরিকল্পনা আমি ছাড়া আর কে কে জানে? তখন রশিদ বলে, ‘স্যার, আপনি ছাড়া সবাই জানেন। আমরা প্রথম খালেদ মোশাররফ স্যারকে তার অফিসে গিয়ে বলেছিলাম। তিনি আমাদের গালিগালাজ করে অফিস থেকে বের করে দেন।’ এরপর আমরা যাই জেনারেলের জিয়ার কাছে। তাকেও আমরা এই প্রস্তাব দেই যে, আমরা এই সরকারকে উৎখাত করতে চাই। আমরা আপনার সহযোগিতা চাই। তখন জিয়া বলে, লিসেন, আই এম আ ভেরি সিনিয়র অফিসার। আই কান্ট বি ওভার্টলি এসোশিয়েটেড উইথ ইউ। হোয়াট এভার ইউ আর ডুয়িং গোহেড, আই উইল হেলপ ইউ, হোয়েন ইউ নিড মাই হেলপ।’ তাহলে আমায় বলনি কেন- আমি এ কথা জিজ্ঞেস করলে সে বলে, ‘স্যার, রোজার ঈদের দিন আপনার বাসায় সব সেনাসদস্যদের সঙ্গে আমিও সস্ত্রীক দেখা করতে গিয়েছিলাম। সেদিন আপনাকে বলতে চেয়েছি। কিন্তু সাহস পাইনি।’ সফিউল্লাহ বলেন, খালেদ মোশাররফের অফিস আর আমার অফিসের দূরত্ব ২০ গজেরও কম। অথচ তিনি আমায় কিছুই জানালেন না।
১৮ আগস্ট সকালে বঙ্গভবন থেকে আমি ছাড়া পাই। পরদিন (১৯ আগস্ট) আমি রেডিওতে একটি সংবাদ শুনি- জেনারেল ওসমানী খন্দকার মোশাররফের সামরিক উপদেষ্টা হচ্ছেন। এর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই মোশতাক আমাকে রেড টেলিফোন করে বলল, আমি খবরটা শুনেছি কি না এবং আমার কোনো আপত্তি আছে কি না? আমি কি তাকে বলব যে আমি এটি পছন্দ করিনি? আমি চুপ করে গেছি দেখে সে আমাকে বলল, ‘আই নিড ইউ এট ফাইভ ও’ক্লক।’ মোশতাকের টেলিফোনের পরেই ওসমানীর লোক এসে আমাকে জানায়, মোশতাকের কাছে যাওয়ার আগে আপনি ওসমানীর অফিসে যান। আমি তাই করলাম। ওসমানীর অফিসে ঢুকতেই তিনি অভিনন্দন জানিয়ে বললেন, তোমাকে আমরা রাষ্ট্রদূত করতে চাই। তুমি তোমার পছন্দ মতো যেকোনো দেশে যেতে পারো। তোমার ভালোর জন্যই তুমি যাও। তিনি আমাকে অনেক শাসালেন।
আমি ৫টার আগেই বঙ্গভবনে পৌঁছে দেখি জেনারেল জিয়া আর জেনারেল খলিল খুব দ্রুত বঙ্গভবন ত্যাগ করছে। পরে শোনলাম ওইদিনই জেনারেল জিয়া সেনাপ্রধান হয়েছে। এরপর মোশতাক আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, জেনারেল ওসমানী আমাকে কিছু জানিয়েছেন কি না? মোশতাকও আমাকে রাষ্ট্রদূত হওয়ার প্রস্তাব দিলেন। এরপর আমি আমার অফিসে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের সঙ্গে শেষ বৈঠক করলাম। তাদের সবকিছু জানালাম, ‘ইটস মাই লাস্ট মিটিং উইথ ইউ এন্ড দিস ইজ ইন্ড মাই মিলিটারি ক্যারিয়ার।’ আর্মি হেড কোয়ার্টার থেকে বের হয়ে বাসায় আসার পর জানলাম মোশতাক আমাকে দেশের বাইরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর মালয়েশিয়া আমাকে নিতে চাইছিল না কারণ তারাও ভেবে নিয়েছিল ভয়ঙ্কর ওই ক্যুয়ের জন্য আমি দায়ী। পরে মালয়েশিয়া হাইকমিশনার তাদের সত্যিটা জানায়, আই এম নট বিহাইন্ড দিস। তখন তারা আমাকে একসেপ্ট করে। আমি দায়িত্বে থাকলে পাল্টা ক্যু করে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নেব। এ নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন ছিল। তাই তারা তাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই আমাকে দেশে রাখেনি। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু হত্যার পুরস্কারস্বরূপ জিয়াকে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব দেয়াও অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। আমি ৩ জানুয়ারি মালয়েশিয়া যাই। এতদিন আমাকে সেনাভবনেই দায়িত্বহীন অবস্থায় কার্যত গৃহবন্দি করে রাখে।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি। আমি গার্ড অব অনার দিয়েছিলাম। তখন আমি বলেছি, আমি সফিউল্লাহ। তিনদিন পর আমি একটা কাজে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি যাই। তিনি আমাকে দেখেই বললেন, কেমন আছ সফিউল্লাহ? আমি নিজেকে গর্বিত মনে করি পাশাপাশি খুব অবাক হয়েছিলাম, যাকে আমি সরাসরি মাত্র একদিন দেখেছি, তিনি কেমন করে তিনদিন পরেও আমার নাম মনে রাখলেন? এত স্মরণশক্তি ছিল তার?
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময় সেনাপ্রধান সত্ত্বেও আমি ষড়যন্ত্রের শিকার ছিলাম। আমার অধীস্থরা জানত, কিন্তু আমাকে অন্ধকারে রেখেছিল। এছাড়া আমি যখন জানলাম বঙ্গবন্ধুর বাড়ি অ্যাটাক হয়েছে, আমি তাৎক্ষণিক নির্দেশ দিয়েছি। তখন অনেক অফিসারই ছিল ষড়যন্ত্রের হোতা। তারা তো কেউ আমার কথা শোনেনি! কিন্তু পরে অনেকেই আমাকে ভুল বুঝেছিল। আমারও অভিমানের মতোই হয়েছিল- এজন্য কাউকে কিছু বলি না। আমার লেখা ‘ফিফটিনথ আগস্ট আ ন্যাশনাল ট্র্যাজেডি’ বইতে আমি এসব তুলে ধরেছি। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে। আমি একজন সাক্ষী ছিলাম। আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছে। আমার উত্তরে যদি কোনো ধরনের সমস্যা থাকতো, তাহলে তারা নিশ্চয়ই সেটি মেনশন করত। আদালতের রায়েই আমি নির্দোষ। আমি আমার বিবেকের কাছে ক্লিয়ার। আমি জানি, আমি কোনো অন্যায় করিনি। অন্যায় করলে সৃষ্টিকর্তা অবশ্যই আমার বিচার করবেন।
কে এম সফিউল্লাহ : মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সেনাপ্রধান।
অনুলিখন: ঝর্ণা মনি