আগস্ট মাস। শোকের মাস। এই মাসে ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরিবার পরিজনবর্গ ও স্বজনদের নির্মম নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ড শুধুমাত্র ব্যক্তি নয় মূলত বাংলাদেশকে হত্যা করা হয়েছে। যে আদর্শ, লক্ষ্য ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রের চার মূলনীতি গড়ে উঠেছিল তা ধ্বংস করা হয়েছে। আকস্মিকভাবে পিতা হারানোর ফলে জাতির বুকে যে ক্ষত সৃষ্টি করেছে সেটা অহর্নিশ শোকের নিরবচ্ছিন্ন বেদনাকে আঁকড়ে আছে। এই নিরন্তর শোককে অতিক্রম করে কীভাবে শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করা যায়? শোকের চিরন্তনী বেদনাকে শক্তিতে রূপান্তর করা সহজসাধ্য নয়। আমার মনে হয় কেবলমাত্র অখণ্ড দেশপ্রেম, জনগণের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের শোকাবহ অবস্থান থেকে আমাদের পরিত্রাণের পথে নিয়ে যেতে পারে। দেশপ্রেম বলতে আমি বুঝাতে চাই দেশের জন্য ভালোবাসা। দেশের মানুষের জন্য বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর ভাষায় দুঃখী মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা, যে ভালোবাসা তাদের সার্বিক মুক্তির পথে এগিয়ে নিতে পারবে। অর্থাৎ শোষিত, বঞ্চিত, গরিব, দুঃখী মানুষকে ভালোবাসায় ঐক্যবদ্ধ করে তাদের জন্য রাষ্ট্র নির্মাণের পথে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। যে পদক্ষেপে থাকবে গণআকাক্সক্ষার বাস্তব প্রতিফলন। অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং ব্যাপক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। এ সব কার্যক্রম সম্পাদন করতে গেলে প্রচলিত আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা পাল্টিয়ে ফেলতে হবে। নতুন সমাজ ব্যবস্থায় এগিয়ে যেতে হবে যেখানে সমাজের সুবিধাবাদী দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের স্থান হবে না। একইসঙ্গে প্রচলিত প্রশাসন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে বিচার ব্যবস্থায় জনগণ যাতে দ্রুত সুফল পায় তার কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। এসব প্রচলিত রাষ্ট্রযন্ত্র ও রাষ্ট্র কাঠামোর আমূল পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন ত্যাগী, নিবেদিতপ্রাণ ও আদর্শবান নেতৃত্ব ও কর্মী বাহিনী। যে কর্মী বাহিনী সততা, নিষ্ঠা, মেধা ও প্রজ্ঞা দ্বারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সারা জীবনের লালিত আদর্শকে নিঃস্বার্থভাবে বাস্তবায়ন করবে। অর্থাৎ আর্থ-সামাজিক মুক্তি ব্যতীত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন এবং সাধনা বাস্তবায়িত হবে না। বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেছেন, ‘কঠোর পরিশ্রমের প্রয়োজন রয়েছে। কাজ করব না, ফাঁকি দিব, অফিসে যাব না, ফাঁকি দেব। ফ্রি স্টাইল। ফ্রি স্টাইল মানে গণতন্ত্র নয়। অফিসে ১০টার সময় যাবার কথা বলে ১২টার আগে যাব না। ৫টায় ছুটি হলে ৩টায় ফিরে আসতে হবে। কারখানায় কাজ করব না। পয়সা দিতে হবে। আমার শ্রমিকরা খারাপ না। আমার শ্রমিকরা কাজ করতে চায়। আমার কৃষকরা আজ কাজ করতেছে। খাদ্য উৎপাদন এগিয়ে গেছে। আমরা ব্যাঘাত সৃষ্টি করি। আমরাই ষড়যন্ত্র করি। আমরাই ধোঁকা দিই। আমরাই লুট করে খাই। জমি দখল করে নিয়ে যাই। এ সব কাজ করে কারা? আমরা এই দেশের তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ, এই দেশের তথাকথিত লেখাপড়া জানা মানুষ। যাদের পেটের মধ্যে দুই অক্ষর বুদ্ধি বাংলার ওইসব দুঃখী মানুষের পয়সায় এসেছে- তারা আজকে এ কথা ভুলে যায়। কথা হলো আমি কী পেলাম আর আমি কী দিলাম।’ অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু আত্মত্যাগের রাজনীতির কথা উচ্চারণ করেছেন। আত্মস্বার্থের কথা বলেননি। যে নেতা, যে কর্মী আত্মত্যাগের মাধ্যমে মানুষের সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন সেই নেতা, সেই কর্মী কেবলমাত্র জনগণের শ্রদ্ধা অর্জন করেন এবং তারাই আদর্শের পতাকা হাতে নিয়ে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেন।
দুই. ষাটের দশকের রাজনীতিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু একদিকে যেমন ত্যাগী নেতাকর্মীদের নিয়ে আওয়ামী লীগ সুসংগঠিত করেছিলেন, তেমনি অগ্রবাহিনী হিসেবে ছাত্রদের দেশের মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। সেদিন ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শ সর্বাত্মক প্রচার করেছিলেন যে, জাতীয়তাবাদ অসম্প্রদায়িক ও সমাজ প্রগতির ধারায় অগ্রসরমান ছিল। সেদিনের ছাত্রসমাজে সে মহান গৌরবদীপ্ত আত্মত্যাগের অধ্যায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার দিকে ধাবিত করে। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশে জ্ঞান অর্জনের বিকল্প নেই।’ তিনি বলেন, ‘ছাত্র সমাজের লেখাপড়া করতে হবে। লেখাপড়া করে মানুষ হতে হবে। জনগণ টাকা দেয় ছাত্রদের মানুষ হওয়ার জন্য। সে মানুষ হতে হবে, আমরা যেন পশু না হই। লেখাপড়া শিখে আমরা যেন মানুষ হই। কী পার্থক্য আছে জানোয়ারের সঙ্গে আর আমাদের সঙ্গে? যে জানোয়ার একটি মানুষের বাচ্চাকে কামড়িয়ে ধরে, খেয়ে ফেলে দেয় আর একটি মানুষ বুদ্ধিবলে এখানে থেকে পয়সা নিয়ে তাকে না খাইয়ে মারে? কী পার্থক্য আছে জানোয়ার আর মানুষের মধ্যে? যদি মনুষ্যত্ব আমি হারিয়ে ফেলি তাহলে মানুষ কোথায়? প্রথমেই আমাকে মনুষ্যত্ব আনতে হবে, তবে আমি মানুষ হব। না হলে মানুষ আমাকে কেন বলা হয়। কারণ আমার মধ্যে মনুষ্যত্ব আছে। যখন মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলি তখন তো আমি মানুষ থাকি না। আমরা মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলছি।’ আজকের প্রেক্ষিতে জাতির পিতার এই কথা আমাদের প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়। কিন্তু প্রশ্নের জবাব নেই। জবাবদিহিতা কে করবে?
তিন. জাতির পিতা মানবিক গুণাবলি ও মূল্যবোধের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। আজ সমাজ ও রাষ্ট্রে মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধ অবক্ষয়িত। মানুষকে মানুষ হিসেবে বিচার না করে অর্থের মানদণ্ডে মানুষকে বিচার করা হচ্ছে। অর্থই যেখানে বিচারের মানদণ্ড সেখানে আদর্শ তিরোহিত হয়। আদর্শহীন মানুষ সমাজ ও রাষ্ট্রকে গ্রাস করে তারাই আজ রাষ্ট্রের কর্ণধার। তারা দেশটাকে লুটপাটের ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করে। সে জন্য দেখা যায়, লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যায়। যারা এসব দেশদ্রোহী কার্মকাণ্ডে লিপ্ত তাদের বিচার হয় না। বিচার হয় না এ কারণে বিচার পদ্ধতির নানা ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে অর্থ-বিত্তের অশুভ প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে। যার টাকা নেই তার বিচার নেই। সে বিচারের দোড়াগোড়ায় যেতে পারবে না। আইনজীবীদের অনেকেই আইনের মারপ্যাঁচে মক্কেলদের চুষে খাওয়ার পথ বেছে নিয়েছে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, অর্থনৈতিক লুটপাট, দুর্নীতির কালো থাবা রাষ্ট্র ও সমাজকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গেছে যেখান থেকে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা নির্মাণের পথে ফিরে আসতে গেলে প্রয়োজন আদর্শিক লড়াই, গণসচেতনা, গণজাগরণ এবং সর্বোপরি গণআন্দোলন।
এই অবস্থায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা কী করবেন? দীর্ঘ সামরিক শাসন, স্বাধীনতাবিরোধী জঙ্গিবাদের উত্থান, দুর্নীতি, সামাজিক ও মানবিক অবক্ষয় যেখানে রাষ্ট্র ও সমাজকে চেপে বসে আছে। সে ক্ষেত্রে যত কঠিনই হোক না কেন তাকে ‘শুদ্ধি’ অভিযানে যেতে হবে, শক্ত হাতে দলের অভ্যন্তরে ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোয়। জানি, যারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে সেই ঘাতক, খুনি, স্বাধীনতা বিরোধী চক্র ও বঙ্গবন্ধু কন্যাকে সরিয়ে দিতে চায়। কিন্তু শেখ হাসিনার অমিত সাহস, দেশপ্রেম, দেশের জনগণের প্রতি মমত্ববোধ, দুঃখী মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রত্যয় তাকে জোগাবে শক্তি, কোটি মানুষের আরাধনা তাকে কাক্সিক্ষত পথে নিয়ে যাবে। একই সঙ্গে এই আদর্শিক লড়াইয়ে নেতাকর্মীদের আত্মসংশোধন অপরিহার্য।
অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ : ১৯৭২ সালের খসড়া সংবিধান প্রণেতা ও সাবেক তথ্যপ্রতিমন্ত্রী।