তখন আমি ঝালকাঠি জেলার গভর্নর। বঙ্গবন্ধু সমস্ত মহকুমাকে আগেই জেলায় রূপান্তরিত করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি প্রত্যেকটি জেলায় একজন করে গভর্নর নিয়োগ করেন। পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ নামে নতুন একটি দল গঠন করেন। সেই লক্ষ্যেই আমাকে তিনি ঝালকাঠি জেলার গভর্নর নিয়োগ করেছিলেন। তখন আমাদের গভর্নরদের এডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রেনিং দেয়ার জন্য ঢাকায় আনা হয়েছিল। পাশাপাশি বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগে যাদের জেলাভিত্তিক নেতা তৈরি করা হয়েছিল, সম্পাদক এবং যুগ্ম সম্পাদক এদের ৫ জন করে ঢাকায় আনা হয়েছিল রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের জন্য। অর্থাৎ একটি জেলার সব রাজনৈতিক নেতারা এবং প্রশাসনিক প্রধান যে এমপিরা ছিলেন, তারা প্রত্যেকেই ঢাকায় ছিলেন।
আমি ঢাকায় থাকলে প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাসভবনে যেতাম এবং কিছুক্ষণ সেখানে থাকতাম। বঙ্গবন্ধু আলোচনা করতেন, শুনতাম, চলে আসতাম। কিন্তু ১৪ আগস্ট আমাদের গভর্নরদের দুটি সংবর্ধনা ছিল। একটি রেজিস্ট্র্রেশনভিত্তিক ময়মনসিংহ রোডে, এডিও কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে। দ্বিতীয়টি পুরান ঢাকায় মুক্তধারা পাবলিকেশন থেকে আমাদের সংবর্ধনা দিয়েছিল। আমরা সন্ধ্যায় যখন পুরান ঢাকায় মুক্তধারা পাবলিকেশন্সে গেলাম তখন প্রোগ্রামটা শেষ হতে প্রায় ১০টার বেশি বেজে গেল। সুতরাং সে দিন আমার আর বঙ্গবন্ধুর বাসায় যাওয়া হলো না। অনুষ্ঠান শেষে আমি ২৫ নম্বর হাজি ওসমান গণি রোডে আমার খালার বাসায় চলে এলাম।
ভোর আনুমানিক ৫টা হবে, আমার খালা দরজায় কড়া নেড়ে আমার ঘুম ভাঙালেন। খালা আমাকে রেডিও শুনতে বললেন। রেডিওর কাছে আসতেই শুনতে পেলাম, ‘আমি মেজর ডালিম বলছি। খুনি শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।’ এই একটা কথাই বারবার বলছে। তো এর আগে একটা রিউমার ছিল, পাকিস্তানিরা হিলট্যাক্স দিয়ে একটা ঘোষণা দিতে পারে, ইত্যাদি ইত্যাদি। এমনো শোনা যাচ্ছিল যে, যারা কারাবন্দি ছিল তারা প্রতিদিনই লকআপ খোলার পরে বাইরে উঁকি দিয়ে দেখত বাইরে পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে কিনা। ফিসফাসের এ বিষয়টা বঙ্গবন্ধুর কানেও এসেছিল। তিনি আমাদের বারবার সাবধান করেছেন। তবে তাঁর ওপর যে হামলা হতে পারে এ ধরনের ধারণা কখনোই ছিল না বা তিনি কখনো বিশ্বাস করেননি। সে দিন রেডিওর ওই খবর শুনে আমি ভাবলাম, এটা হয়তো তেমনই একটা রিউমার। হয়তো দশ মিনিট পরেই ঠিক হয়ে যাবে। খালাকে এ কথা বলে আমি বাথরুমে চলে গেলাম। কিন্তু বাথরুমে যতক্ষণ ছিলাম, ওই একই কথা রেডিওতে বেজে যাচ্ছিল। আমার মধ্যে একটা সন্দেহ কাজ করতে লাগল। বাথরুম থেকে বেরিয়ে ওজু করে নামাজ পড়লাম। এরপর মোশতাকের বিষয়টা জানতে পারলাম। একজন গভর্নর হিসেবে আমার বাসায় সব সময় পুলিশ প্রোটেকশন ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে নানক, কাশেম এবং সালাম (বর্তমানে কানাডা প্রবাসী) এরা রাস্তায় এসে আমাকে ডাকল। আমি বারান্দায় গিয়ে তাদের দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম- ‘কী খবর’। ওরা বলল- চলে আসেন। আমি চিন্তা করলাম, আমার বের হওয়ার একটাই রাস্তা। এখন যদি আমি বের হই, তবে পুলিশের মধ্যে রিঅ্যাকশন কী হতে পারে। নানককে বিষয়টা দেখতে বললাম। ওরা বাড়ির ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখল, বেশির ভাগ পুলিশ ঘুমানো। বলল, ‘অসুবিধা নেই, চলে আসেন।’ আমি তাড়াতাড়ি করে একটি ব্রিফকেস গোছালাম। এরপর শেখ মণির বাসায় ফোন করলাম। রিং হচ্ছে, নো রেসপন্স। তারপর ফোন করলাম আব্দুর রব সেরনিয়াবাত বাসায়। রিং হচ্ছে, বাট নো রেসপন্স। সবশেষ ফোন করলাম বঙ্গবন্ধুর বাসায়। কিন্তু নো রেসপন্স। আমি কন্টিনিউ এই তিন বাসায় বেশ কয়েকবার ফোন দিলাম। অবশেষে ফোন করা বন্ধ করে দিয়ে নিচে নেমে এলাম। এক হাবিলদার তাড়াতাড়ি শার্ট গায়ে দিয়ে আমার পেছন পেছন এল নাজিরাবাজার পর্যন্ত। আমি বললাম, তুমি থাকো। আমার খেয়াল ছিল না যে মোশতাকের বাসা আগামসি লেন। ওই রোডে ঢুকতেই মনে হলো কারফিউ, অন্ধকার, আর্মির গাড়ি ভর্তি। আমি কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। কারণ আমার ব্রিফকেসে তখন একটা স্টেনগান আর একটা রিভলবার। নানক বলল, কী করবেন। আমি বললাম, বিসমিল্লাহ বলে হাঁটা শুরু করো। সাধারণ পথচারীর মতো আমরা হেঁটে আগামসি লেন পার হলাম। হাঁটতে হাঁটতে বললাম, একটা কাজ করি, কোনো ধরনের গ্যাঞ্জাম হলে আমরা তো সব সময় কেরানীগঞ্জ চলে যাই। এখন সেখানে গেলে সবাইকে পাব। নানক বলল, ‘সেখানে তো কেউ নেই। সবাইকে শেষ করে ফেলেছে।’ এতক্ষণ যাই হোক বিষয়টা বিশ্বাস হচ্ছিল না। কিন্তু নানকের কথায় এবার যেন গায়ের রক্ত সব ঠাণ্ডা হয়ে এল। হাত-পা কিছুটা কাঁপতে শুরু করল। বললাম, কী করব এখন। নানক বলল- ‘আপনি এখন আপাতত কোনো শেল্টারে চলেন। পরে খোঁজখবর নিয়ে আপনাকে সব জানাব।’
আমি লালবাগে আমার এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে উঠলাম। সেখানে হঠাৎ আর্মির গাড়ির শব্দ শুনলাম। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি আমি যে বাসায় আছি ঠিক উল্টাপাশের বাসায় দুটি আর্মির গাড়ি দাঁড়ানো। পরে জানতে পারলাম, ওটা মেজর ডালিমের শ্বশুরবাড়ি। ভয় পেয়ে সেখান থেকে ভোর রাতে বেরিয়ে গেলাম। তোপখানা রোডে আরেকজনের বাসায় এলাম। ওখানে দুই রাত্রি ছিলাম। ওখানে মুসলিম লীগের এক এমপির ছেলে থাকে শুনে নিরাপদ মনে হলো না। ওখান থেকে চলে এলাম তোপখানা রোডে আমাদের আজিজ কন্ট্রাক্টর ছিল, তার বাসায়। সেখানেও দুদিন ছিলাম।
লুকিয়ে থেকে ফাঁকে ফাঁকে আমি সবার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। এর মধ্যে খবর পেলাম, আবদুর রাজ্জাক, ডা. সেলিম এরা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের ওখানে বসে। আমি সেখানে দেখা করতে যাব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু ওদের নাকি সন্দেহ করা শুরু করেছে। তাই সেখান থেকে ওইদিনই ওরা সরে যায়। এরপর ফণী দা’র বাসায় গেলাম একদিন। সেখানে জানাশোনা কয়েকজনের সঙ্গে দেখা হলো। আমি মূলত ওই পারে যাওয়ার কী ব্যবস্থা সেই বিষয়ে জানতে গিয়েছিলাম। ফণী দা বললেন, এখন আমার কাছে কোনো খবর নেই। তোমরা আপাতত গা ঢাকা দিয়ে থাক। যদি কোনো খবর হয়, আমি জানাব। ওখান থেকে চলে এলাম। এরপর আমার এক দুলাভাইয়ের বাসায় গেলাম। সেখান থেকেই আমি গ্রেপ্তার হলাম। গ্রেপ্তার করেই আমাকে রেডিও স্টেশনে নিয়ে গেল। সেখানে তারা ৬ জনে মিলে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করল সারারাত। আর্মস আছে কার কার কাছে। আমার কাছে কী পরিমাণ আর্মস আছে। বিভিন্নজনের সম্পর্কে তারা জানতে চাইল। আমি বলেছি, দেখেন আমি মফস্বলে রাজনীতি করি। পার্লামেন্ট যখন থাকে আসি। আমি এতসব ঢাকার খবর জানি না।
সকালে আমাকে কন্ট্রোলরুমে হ্যান্ডওভার করা হলো। কন্ট্রোলরুমে ঢুকেই কেঁপে গেলাম। দেয়ালে রক্তের দাগ। একটি ইলেকট্রিক চেয়ার। কন্ট্রোলরুমে আমার নাম লিস্ট করে দিয়ে ওরা চলে যায়। এর মধ্যে ওখানে যে পুলিশের ইন্সপেক্টর ছিলেন, ওর বাড়ি ছিল পটুয়াখালী। সে হয়তো আমাকে দেখে চিনেছে। তাই তাড়াতাড়ি করে আমার কাছে এসে বলল, ‘স্যার, যদি আপনার কোনো সোর্স থাকে তাহলে আপনি ফোন করেন। এখান থেকে বের করে নিয়ে যেতে বলেন। আপনার আয়ু বিকেল পর্যন্ত। বিকেলের পরে আপনাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই আমার এখান থেকে টেলিফোন করেন। আমি রিস্ক নিয়ে আমার টেলিফোন ব্যবহার করতে দিলাম।’ লোকটার কথা শুনে কিছুটা ভড়কে গেলাম। তাড়াতাড়ি আইজি নুরুল ইসলামকে ফোন দিলাম। উনি বললেন, আমি জানি। রাত থেকে আমার কাছে খবর আছে। আমরা চেষ্টা করছি যাতে আপনাকে নিরাপদে জেলখানায় নেয়া যায়। এরপর গোলাম মোর্শেদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। সেও একই কথা বলল- আমরা সতর্ক আছি। আমরা এনএসআইয়ের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছি। তবে আপনাকে জেলখানায় পাঠাতে পারি তাহলে বের হতে অনেক সময় লাগবে। তখন আমাদের গালাগালি করবেন না। আমি বললাম, সমস্যা নেই আমাকে জেলখানায় দেন। এরপর বরিশালের এসপি, কিছু আর্মির লোকজনের কাছেও সে সময় ফোন দিয়ে বিষয়টা জানালাম। ফোন শেষ করে এসে নামাজে দাঁড়ালাম। একটানা নামাজ পড়লাম। জোহরের নামাজ শেষ করে আসর নামাজে যখন সিজদায় গেলাম, তখন খসখস শব্দ শুনতে পেলাম। আমি ভয় পেয়ে আর সিজদা থেকে উঠছি না। এমন সময় পেছন থেকে স্যার, স্যার বলে কেউ ডাকল। আমি সিজদা থেকে উঠতেই রমনা থানার ওসি আনোয়ার বলল, স্যার তাড়াতাড়ি ওঠেন। ৩টা বাজে। আপনি তাড়াতাড়ি ওঠেন। আপনার সময় বিকেল ৪টা পর্যন্ত। ৪টার মধ্যে আপনাকে থানায় হ্যান্ডওভার করতে হবে। এটা আমাদের নির্দেশ। আমি কিছুটা আশ্বস্ত হলাম যে, আমাকে সেফ করার চেষ্টা চলছে। এরপর আমাকে তার গাড়িতে করে রমনা থানায় নিয়ে গিয়ে ফরম পূরণ করে নিয়ে গেল সেন্ট্রাল জেলে। বাইরে বসে আমরা শুনেছি যে, সেন্ট্রাল জেলে কিছু গোলমাল হয়। আমি ওসিকে বললাম, মন্ত্রীদের যেখানে রাখা হয়েছে সেখানে আমাকে রেখ। অন্য কোথাও রেখ না। সে বলল, সেখানেই রাখা হবে। সে দিন ছিল প্রথম রোজা। ইফতার শেষে কাগজপত্র সব ঠিকঠাক করে আমাকে নিয়ে গেল তিন নম্বর রুমে। এক নম্বর রুমে ছিলেন নজরুল ইসলাম সাহেব, তাজউদ্দীন সাহেব, দুই নম্বর রুমে ছিলেন কামরুজ্জামান, শেখ আজিজ ওনারা। তিন নম্বর রুমে ছিলাম ইউনুস আলী সাহেব, সামাদ সাহেব, আমি।
বঙ্গবন্ধু হত্যার আগে এবং পরে বেশ কিছু রিউমার ছড়ানো হয়। বঙ্গবন্ধুর পরিবার অনেক সম্পদের মালিক। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক, দেশ বিকিয়ে যাচ্ছে, দুর্ভিক্ষ নিয়ে নানা নেগেটিভ আলোচনা হয়েছে। ওই সময়ে জাসদের ‘গণকণ্ঠ’ নামে পত্রিকা সবচেয়ে বেশি এই বিষয়গুলো হাইলাইট করেছে। তবে এটা মূলত একটা আন্তর্জাতিক প্রচারণা ছিল। পাকিস্তান-আমেরিকা মিলিতভাবে চেষ্টা করেছে বঙ্গবন্ধুর সুনামহানি করতে, এ দেশকে আবার তাদের করায়ত্ত করতে। এটা তারা বহুবার করার চেষ্টা করেছে। এরপর ১৯৭৪-এ তারা খাদ্যের জাহাজ ঘুরিয়ে দিয়েছে। দেশে দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি করেছে। এগুলো ছিল মূলত একটা প্লট তৈরি করা ‘১৫ আগস্ট’ সংঘটিত করার জন্য। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে দেখা গেল, এসব কোনো কিছুই সত্য ছিল না। ব্যাংকেও কোনো টাকা ছিল না, সোনা-দানাও ছিল না, এমনকি তার বাসা সার্চ করেও তেমন কিছু পাওয়া গেল না। ফলে এগুলো যে তার বিরুদ্ধে এক ধরনের অপপ্রচার ছিল তা প্রমাণিত হয়।
বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিষয়টি সে সময় আওয়ামী লীগ প্রতিরোধ করতে পারল না। কারণ বঙ্গবন্ধুর হত্যার খবরে সবাই একটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। বজ্রপাতের মতোই ঘটনা ঘটেছে। কল্পনাতীত। তাছাড়া জেলাগুলো তো খালি ছিল। না হলে জেলাগুলো থেকে দুএকজন নেতাও যদি আওয়াজ দিত তাহলেই কিন্তু সারাদেশে আগুন লেগে যেত। এছাড়া রক্ষীবাহিনী যারা জেলায় জেলায় ছিলেন তারা কিন্তু চেষ্টা করেছেন অন্য নেতাদের দিয়ে কিছু করানোর জন্য। কিন্তু কেউ কোনো জেলায় উপস্থিত ছিলেন না। রক্ষীবাহিনীর লিডার বিদেশে। সুতরাং এটা যে একটি সুপরিকল্পিত ঘটনা, তা স্পষ্ট।
একটা হত্যাকাণ্ড যখন সংঘটিত হয়, তখন বিচার্যের বিষয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায় যে, এতে লাভবান হয়েছে কারা। এটা বের করতে পারলেই হত্যাকারীদের বের করা সম্ভব হয় এবং তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বোঝা যায়। আমরা যদি দেখি ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে খুনিরা লাভবান ছিল কীভাবে? একটা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী যিনি, একটি দেশকে যিনি সৃষ্টি করেছেন, যে কিনা এ দেশকে স্বাধীন করেছেন, সে জাতির জনককে হত্যা করা হলো। বঙ্গবন্ধুর হত্যার মধ্য দিয়ে ষড়যন্ত্রকারীরা দেশকে আবার পঞ্চাশের দশকে নিয়ে যায়। অর্থাৎ যে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছিল সেটা আবার সৃষ্টি করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর। কারণ সাম্প্রদায়িক রাজনীতি তো নিষিদ্ধ ছিল। সেটা আবার চালু করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়াও প্রধান আরো কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়। যেমন, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড যখন সংঘটিত হয়, তখন জাতীয় সংবিধান যে ৪ মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে ছিল, হত্যার পরে সে চার মূলনীতি ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়। দ্বিতীয়ত, যে বাংলাদেশ বেতারের মাধ্যমে সারা দুনিয়ার মানুষ মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের খবর শুনেছিল, সে বাংলাদেশ বেতারের নাম পরিবর্তন করে রেডিও পাকিস্তানের মতো রেডিও বাংলাদেশ নাম রাখা হয়। তৃতীয়ত, একাত্তরের পরাজিত শক্তিদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিকভাবে পুনর্বাসিত করা হলো। চতুর্থত, বাংলাদেশের সংবিধানে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কোনো স্থান ছিল না। কিন্তু সে অনুচ্ছেদ তুলে দিয়ে এ দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রবর্তন করা হলো। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মূল্যবোধকে হত্যা করা হলো। গোলাম আযমের নাগরিকত্ব না থাকার পরও তাকে দেশে এসে রাজনীতি করার সুযোগ তৈরি করে দেয়া হলো। এই কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে আমরা বুঝতে পারব যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড কোনো ব্যক্তির হত্যাকাণ্ড নয়, কোনো পরিবারের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ড ছিল না, একাত্তরের পরাজিত শক্তির প্রতিহিংসা এবং তাদের সেই স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধকে বিলুপ্ত করে দিয়ে এ দেশকে আবার একটি নব্য পাকিস্তানি দেশে রূপান্তরিত করার মূল প্রেক্ষাপটই ছিল একাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যায় খন্দকার মোশতাক একটি বড় ভূমিকা পালন করেছেন। খন্দকার মোশতাকের রাজনৈতিক চরিত্র এবং রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা বিশ্লেষণ করলে দেখব, তিনি কোনো সময়ই একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বা প্রগতিশীল রাজনীতির পক্ষের ব্যক্তি ছিলেন না। তারপরও তিনি আওয়ামী লীগে ছিলেন এটাই বাস্তব এবং সিনিয়র নেতৃত্বের মধ্যেই তার অবস্থানটাই ছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রাথমিক পর্যায়ে যে সরকার গঠন হয়েছিল, সেই সরকারে তিনি পররাষ্ট্রের দায়িত্বে ছিলেন। যেহেতু তখন বাংলার, এমনকি প্রত্যেকটি বাঙালির কাছে বঙ্গবন্ধু অন্যরকম একটি সেন্টিমেন্ট। বঙ্গবন্ধুকে ফিরে পেতে হবে, তিনি বেঁচে আছেন কিনা, এ প্রশ্নই সারাক্ষণ সবার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে, খন্দকার মোশতাক তখন একটি সূ² চাল চেলেছিল। তিনি বক্তব্যের শুরুতেই বললেন যে, ‘তোমরা বঙ্গবন্ধুকে চাও না স্বাধীনতা চাও?’ অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুকে যদি চাও তবে স্বাধীনতা পাবে না। তার মানে হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধ থেকে সরিয়ে আনা। তখন আমরা এর পাল্টা বলেছিলাম যে, বঙ্গবন্ধু এবং স্বাধীনতা এক এবং অভিন্ন। আমরা একসঙ্গেই দুটো চাই। তখন থেকেই কিন্তু তার পোস্ট সাসপেন্ডেড। এন্ড হি ওয়াজ নট এট অল টু মুভ এনি হোয়ার এজ এ ফরেন মিনিস্টার। তিনি তখন অন্তরীণ ছিলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তার কোনো মুভমেন্ট ছিল না। আমাদের আবদুস সামাদ আজাদ সাহেবকে আন অফিসিয়ালি দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আমাদের বিভিন্ন কমিটি ছিল, তিনি তখন তাদের সঙ্গে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় লবিংয়ে গিয়েছিলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রচারণা চালিয়েছেন। কিন্তু মোশতাক কোথাও যেতে পারেননি। তাকে যেতে দেয়া হয়নি। ওই সময় থেকেই তার কর্মকাণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। পরবর্তীকালে আমরা ১৫ আগস্টের সকালে যখন শুনলাম যে খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে এবং তিনি রাষ্ট্রপতি হয়েছেন, তখন তার সম্পৃক্ততা পরিষ্কার হয়ে গেল। তার কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়েই তিনি প্রমাণ করেছেন, তিনি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। কলাকুশলীদের মধ্যেও ছিলেন। প্রত্যেকটি পদক্ষেপের মধ্যেই তার উপস্থিতি ছিল। ফলে তিনি আর অস্বীকার করেননি। সরাসরি রাষ্ট্রপতি হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা শুরু করলেন।
হত্যাকারীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে নিশ্চয়ই সফল হয়েছে, বলেই ২১ বছর ক্ষমতায় তারাই ছিল। ফলে ১৯৭৫-এর ১৪ আগস্ট আমরা যে পর্যায়ে ছিলাম, সেখানে আনা সম্ভব হয়নি রাজনৈতিকভাবে। অর্থাৎ ২১ বছরে যারা দেশটিকে পরিচালনা করেছিল তারা প্রকৃত অর্থে ওই হত্যাকাণ্ডের যে মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সে দিকে ধাবিত ছিল। এবং তাদের মাধ্যমেই একদিকে যেমন মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তিরা রাজনৈতিক, সামাজিকসহ সব ধরনের মর্যাদা পেয়েছে, ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরাও ওই সরকারগুলোর আমলেই বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি পেয়েছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নির্বাচিত হয়েছে। সুতরাং যারা ২১টি বছর এই রাষ্ট্র পরিচালনা করেছিল, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর তাদের সব কর্মকাণ্ড মূলত প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে তাদের সহায়ক ছিল। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে প্রথমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আমরা আবার সেই ১৯৭৫-এর ১৪ আগস্টের অবস্থানে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা শুরু করি। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের বিচার নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছিল ইনডেমনিটি এক্টের মাধ্যমে। আমরা সেটা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পার্লামেন্টে ওভার রুল করে দিয়ে হত্যার বিচারকার্য পরিচালনা করি। হত্যার রায় হয়। কিন্তু তারপরও ষড়যন্ত্র এত প্রকট ছিল যে, সেই রায় সে সময়ে কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তী সময়ে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর সেই রায় কার্যকর করা সম্ভব হয়েছিল এবং ২০০৯ সাল থেকেই মূলত আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মূল্যবোধ, জাতীয় চার নীতি ফিরিয়ে আনা এবং বঙ্গবন্ধুর যে স্বপ্ন সোনার বাংলা, অর্থনৈতিক মুক্তি- সেই কাজগুলো শেখ হাসিনার নেতৃত্বে শুরু করি। এখনো সেই কাজ অব্যাহত রয়েছে এবং আজকে আমরা বিশ্ব দরবারে মর্যাদাশীল বাঙালি জাতি। যে বাঙালিকে মনে করত ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দেশে দেশে ঘুরে বেড়ায়। সেই আমরা এখন বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি হিসেবে বিদেশে যাই। আমাদের মর্যাদার আসনে বসানো হয়। আমরা অনেক সময় কী-নোট স্পিকার হই, আমরা মূল স্পিকার হই, আমরা প্রিজাইড করি, বিভিন্ন অনুষ্ঠান এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় আমাদের দেশ বিজয় লাভ করে। ইন্টারন্যাশনাল পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) মতো ফোরমের প্রেসিডেন্ট আমাদের দেশ থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। কমনওয়েলথে আমাদের স্পিকার নির্বাচিত হয়েছে। সুতরাং সারাদেশ, দুনিয়ার মানুষ আজকে এই পার্লামেন্টকে স্বীকৃতি দেয় বলেই এই পার্লামেন্টের সদস্যরা আইপিইউর প্রেসিডেন্ট হয়। এই পার্লামেন্টের স্পিকারই কমনওয়েলথের প্রেসিডেন্ট হয়। যেহেতু এরা সারা দুনিয়ার কাছে স্বীকৃত প্রেসিডেন্ট।
বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে ধারণ করেই আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। তাঁর রাজনৈতিক চেতনার যে মূল বিষয় ছিল- অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, অর্থনীতির ভিত্তি এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ। আমরা সেই চেতনাগুলোকে অন্তরে লালন করছি। তিনি যেটা চেয়েছিলেন, অর্থনৈতিক মুক্তি। সেই অর্থনৈতিক মুক্তির দিকেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আজকে আমরা ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের রেটিং অনুযায়ী নিম্ন মধ্যম আয়ে প্রবেশ করেছি। ওখান থেকে আমরা কিন্তু মধ্যম আয়ের দেশে পদার্পণ করছি এবং ২০২১ সালের আগে আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পদার্পণ করব। এরপর ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা উন্নত দেশে পদার্পণ করব। সুতরাং বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক মুক্তির যে লক্ষ্য ছিল সেটা বাস্তবায়িত হচ্ছে।
আমরা অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছি। তবে ব্যক্তিগতভাবে কারো জমিজমা নিয়ে বিরোধ থাকলে তাকে রাজনৈতিক বিষয়ে না আনাই ভালো। যেমন দাঙ্গা বলতে আমাদের দেশের মানুষ ১৯৫০ সাল পর্যন্ত বুঝত, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যকার যে মারামারি। কিন্তু আমরা দেখলাম ১৯৫৪ সালে যখন যুক্তফ্রন্ট নির্বাচিত হলো, সেই যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভাঙার জন্য বাঙালি-বিহারি দাঙ্গা বাধলো। কর্ণফুলী পেপার মিল এবং আদমজী জুট মিলে বাঙালি-বিহারি দাঙ্গা করে সে দিন সেরে বাংলা মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়া হলো।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী যারা পালিয়ে আছে তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি। কারণ তারা যেসব দেশে আছে, সেসব দেশের একটা আইনকানুন আছে। সে সব আইনকানুনের কারণে কিছু বেরিকেড আছে। আমাদের পক্ষ থেকে চেষ্টা হচ্ছে, এগুলো উত্তরণ করে তাদের ফিরিয়ে আনা।
আমির হোসেন আমু : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য, শিল্পমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।
অনুলিখন : মরিয়ম সেঁজুতি।