মুজিব হত্যাকাণ্ড: কী চেয়েছিল ভুট্টোর পাকিস্তান?

রাহাত মিনহাজ

১৯৭৪ সালের জুনের শেষ সপ্তাহে ঢাকায় এসেছিলেন পাকিস্তানের তত্কালীন উজির-এ-আলা জুলফিকার আলী ভুট্টো। সে সময় তিনি সাভার স্মৃতিসৌধে যেতে অপারগতা প্রকাশ করেন। শুরু করেন গড়িমসি। বঙ্গবন্ধুর তরফ থেকে সাফ জানানো হয়, সাভারে শহীদ মিনারে ১৯৭১ সালের শহীদদের শ্রদ্ধা না জানালে বাকি সব কাজ বাদ রেখেই পাকিস্তানে ফিরতে হবে ভুট্টোকে। শেষ পর্যন্ত শেখ মুজিবের এমন কঠোর অবস্থানে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে সাভারে যেতে বাধ্য হন ভুট্টো। তবে চতুর ভুট্টো সেখানে যান টি-শার্ট আর গলফ টুপি পরে। একেবারেই আটপৌরে পোশাকে। তার আপত্তি ছিল— সেখানে কোনো বিউগল বাজবে না, পুষ্পমাল্য অর্পণ করতে হবে না, থাকবে না কোনো গান স্যালুট! এই ছিলেন ভুট্টো। বাঙালি জাতি আর বীর শহীদদের প্রতি তার ঘৃণা, অবজ্ঞা ছিল আজন্মের। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতি তার ছিল সীমাহীন ঘৃণা। পাঞ্জাবি ভুট্টো বাঙালি মুজিবকে সবসময়ই শত্রু হিসেবে দেখতেন। কারণ পাকিস্তান কাঠামোতেও ভুট্টোর চেয়ে অধিকতর জনপ্রিয় ও যোগ্য নেতা ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

সপরিবারে নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের শিকার জাতির জনকের প্রতি ভুট্টোর মনোভাব বা প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া কী ছিল, এর বর্ণনা পাওয়া যায় তার কন্যা বেনজির ভুট্টোর জবানিতে। গবেষক মুনতাসীর মামুন ও মহিউদ্দিন আহমেদ সম্পাদিত ‘পাকিস্তানিদের দৃষ্টিতে একাত্তর’ বইয়ে এক সাক্ষাত্কারে বেনজির ভুট্টো বলেছেন, ‘সেই রাতে (১৯৭৫, ১৫ আগস্ট) আমরা রাওয়ালপিন্ডির প্রধানমন্ত্রী ভবনে ছিলাম। বাবা (জুলফিকার আলী ভুট্টো) আমার দরজায় নক করলেন, আমাকে তার ঘরে যেতে বললেন। বাবা বললেন, ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে গেছে। বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট তাদের লোকের হাতেই নিহত হয়েছেন। ঘটনাটা আমাদের কাছে খুবই মর্মান্তিক ও ভয়ঙ্কর মনে হলো। জানা গেল, তার স্ত্রীকেও হত্যা করা হয়েছে। আস্তে আস্তে আমরা জানতে পারলাম তার শিশুসন্তানকেও খাটের নিচ থেকে বের করে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আমরা খুবই শ্রদ্ধাভরে প্রবল আত্মবিশ্বাসী এক রাজনীতিক শেখ মুজিবকে স্মরণ করলাম।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ড নিয়ে বেনজিরের এ বয়ানের সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের কোনো সুযোগ নেই। সাদামনে এ বর্ণনাকে সত্য বলে ধরলেও সেই রাত পোহাতেই জুলফিকার আলী ভুট্টো যেসব পদক্ষেপ নেয়া শুরু করেন, তা ছিল শোকগ্রস্ত হওয়ার সম্পূর্ণ বিপরীত। বরং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্তিত্ববিনাশী। নতুন করে কনফেডারেশন গঠনের পাঁয়তারা। আসুন দৃষ্টি দিই সেই দিকে।

মুজিব হত্যাকাণ্ডে উচ্ছ্বসিত ভুট্টো মোশতাক গংদের প্রতি দ্রুত পদক্ষেপ নিতে কোনো ভাবনা-চিন্তায় যাননি। তিনি ধরেই নেন, এটাই সেই সুবর্ণ সুযোগ। ১৬ আগস্ট পাকিস্তান সরকার নতুন সরকারকে সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি দেয়। যাতে এ পরিবর্তনকে ঐতিহাসিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ওই বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়—

‘বাংলাদেশের ভ্রাতৃপ্রতিম জনগণের প্রতি আমাদের প্রথম ও স্বতঃস্ফূর্ত শুভেচ্ছার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আমি (ভুট্টো) পাকিস্তানের জনগণের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টন চাল, ১ কোটি গজ কাপড় ও ৫০ লাখ গজ সূতি কাপড় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ...বিশ্ববাসী জানুক আমরা সুখে-দুঃখে ঐক্যবদ্ধ। আমরা ইসলামী সম্মেলনের সব সদস্যকে এবং তৃতীয় বিশ্বের সদস্যদের নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার অনুরোধ করছি। ...’

এই ছিল ভুট্টো সরকারের প্রথম আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া। তবে চতুর ভুট্টো শুধু প্রতিক্রিয়া জানিয়েই বসে থাকেননি। তার পরিকল্পনা ছিল আরো সুদূরপ্রসারী। বাসনা ছিল ভাঙা পাকিস্তান আবারো জোড়া লাগানোর। তার সেই স্বপ্নে হাওয়া দিয়েছিলেন খুনি চক্রের হোতা খন্দকার মোশতাক। শেখ মুজিবের মরদেহ দাফনের আগেই বাংলাদেশে নতুন করে পাকিস্তানীকরণ শুরু করেন খন্দকার মোশতাক। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশে প্রধান সচিব ছিলেন শফিউল আজম। পাকিস্তানে থাকা এ আমলাকে মোশতাক ফিরিয়ে আনেন, দায়িত্ব দেন মন্ত্রিপরিষদ সচিবের। একইভাবে একাত্তরে পাকিদের সেবা করা স্বরাষ্ট্র সচিব সালাউদ্দীনকে দেশে ফিরিয়ে এনে দায়িত্ব দেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। পাক গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সফদারকে পাকিস্তান থেকে ফিরিয়ে এনে করা হয় গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইয়ের প্রধান। পাকিস্তান পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তা তবারক হোসেনকে নিয়োগ দেয়া হয় পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে। সেপ্টেম্বরের শুরুতে জার্মানিতে অবসরে থাকা কট্টর ডানপন্থী গ্রুপ ক্যাপ্টেন এম.জি. তাওয়াবকে অবসর থেকে ফিরিয়ে দুটি প্রমোশন দিয়ে সক্রিয় এয়ারভাইস মার্শাল হয়ে বিমান বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। এই তাওয়াব বিমান বাহিনীর পদে থাকা অবস্থাতেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক জনসমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন। তাতে স্লোগান উঠেছিল— ‘তাওয়াব ভাই তাওয়াব ভাই চান-তারা পতাকা চাই।’ চারদিকেই উল্টো রথযাত্রা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীত স্রোতের টান।

’৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর ইয়াহিয়ার কাছ থেকে ক্ষমতা নেয়ার পর বন্দি মুজিবের কাছে ভুট্টো একটাই আকুতি জানিয়েছিলেন। যেকোনোভাবে যেকোনো কাঠামোয় বজায় থাক পাকিস্তান। নামকাওয়াস্তে কনফেডারেশন টিকিয়ে রাখার অনুরোধও ছিল তার। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাকে কোনো আশ্বাস দেননি। সর্বশেষ পাকিস্তান ছাড়ার আগে ৭ জানুয়ারি ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে ৫০ হাজার ডলারের (সে সময়ের হিসাবে অনেক টাকা) একটি বান্ডিল দিয়েছিলেন। কিন্তু জাতির জনক তা প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, ‘তোমার দেশের বিমানে করে লন্ডন যাচ্ছি, এই টাকা তার ভাড়া হিসেবে রেখে দাও।’ এদিকে ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরার আগেই লন্ডনে বিভিন্ন সূত্রে বঙ্গবন্ধু জেনে গেছেন নয় মাসে পাকিস্তানি সেনারা বাংলাদেশের মাটিতে কী করেছে, চতুর ভুট্টো ২৫ মার্চ ক্র্যাকডাউনের পর কী বলেছিলেন, কী ছিল তার ভূমিকা। আর সেজন্যই দেশে ফিরে রেসকোর্স ময়দানে দেয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু পরিষ্কার বলেছেন, ‘তোমরা আমার লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছ, মা-বোনদের বেইজ্জত করেছ, অগণিত বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছ, এক কোটি লোককে ভিটেমাটি ছাড়া করে ভারতে যেতে বাধ্য করেছ, তার পরও মনের মধ্যে কোনো বিদ্বেষ পুষে রাখতে চাই না। তোমরা স্বাধীন থাকো, আমাদের স্বাধীন থাকতে দাও। তোমাদের সাথে সব সম্পর্ক চুকেবুকে গেছে।’ এতে হতাশ হন ভুট্টো। অপেক্ষায় থাকেন সুযোগের।

শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডকে সেই সুযোগের সুবর্ণ সময় মনে করেন ভুট্টো। মুজিব হত্যার পর পরই সেই নীলনকশা নিয়ে অগ্রসর হন, যার জন্য তিনি হেডকোয়ার্টার স্থাপন করেন লন্ডনে। মূল দায়িত্ব দেন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী বর্ষীয়ান পাকিস্তানপন্থী রাজনীতিক মাহমুদ আলীকে। এই মাহমুদ আলী পঞ্চাশের দশকে আলোচিত রাজনীতিক ছিলেন। যা-ই হোক, এ প্রক্রিয়ায় মোশতাক গং-দের ভূমিকাও কম ছিল না, যার প্রমাণ পাওয়া যায় পীর মহসিন আলী দুদু মিয়াকে পাকিস্তানে বিশেষ দূত হিসেবে পাঠানোর মাধ্যমে। পীর মহসিন আলী দুদু মিয়া ছিলেন ডানপন্থী রাজনীতিক। পাকিস্তানের পেয়ারা বন্ধু। এই মহসিন আলীকে মোশতাক পাকিস্তানে পাঠান সম্পর্ক আরো জোরদার করতে। সম্ভব হলে কনফেডারেশন গঠনের প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে, যা সফল করতে লন্ডনে মাহমুদ আলীর মাধ্যমে সব ধরনের চেষ্টাই করেন ভুট্টো।   

ভুট্টো ও মোশতাক গং-দের এই চেষ্টা কেন সফল হয়নি, তা নিয়ে নানা মত আছে। অনেকেই বলেন, খুনি চক্রই এ বিষয়ে পদক্ষেপ না নিতে মোশতাককে শাসিয়েছিল। সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস তার ‘লিগ্যাসি অব ব্লাড’ বইতে লিখেছেন, ‘ফারুক রহমান আমাকে (মাসকারেনহাস) বলেছিলেন মোশতাক যদি এমন কিছু (পাকিস্তানের সঙ্গে পুনঃএকত্রীকরণ) করার চেষ্টা করতেন তাহলে আমি তার মাথা উড়িয়ে দিতাম।’ এ তথ্য ছাড়া এ বিষয়ে খুব একটা জোরালো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে অন্য বেশ কয়েকটি সূত্রে ভারতীয় ভূমিকার কথা জানা যায়। ১৫ আগস্ট বর্বর হত্যাকাণ্ডের সময় ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেন ঢাকায় ছিলেন না। ভারতের স্বাধীনতা দিবসের (১৫ আগস্ট) অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তিনি দিল্লি ছিলেন। বিমান যোগাযোগ বন্ধ থাকায় তিনি সেখান থেকে কলকাতা হয়ে সড়কপথে ঢাকায় পৌঁছেন ১৮ আগস্ট। এরপর জরুরি কিছু বৈঠক সেরে তিনি বঙ্গভবনে খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ওই সাক্ষাতের কিছু কথা বা প্রচ্ছন্ন হুমকির কারণেই মোশতাক বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করতে পারেননি। এগোতে পারেননি বাংলাদেশকে পাকিস্তানি পতাকাতলে আনার পরিকল্পনা নিয়ে। ২০১১ সালের ১৫ অক্টোবর কলকাতার দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকার সম্পাদক মানস ঘোষ এ ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে একটি নিবন্ধ লেখেন। সেই নিবন্ধের কথা সাংবাদিক ও গবেষক মিজানুর রহমান খান তার ‘মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন। সেই বর্ণনা অনুযায়ী তিনি (মানস ঘোষ) উল্লেখ করেন, বঙ্গভবনে গিয়ে সমর সেন মোশতাককে একটি কূটনৈতিক নোট পড়ে শোনান। তাতে লেখা ছিল, ‘যদি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করা হয় এবং কোনো দেশের সাথে কনফেডারেশন গঠনের চেষ্টা করা হয় তাহলে ভারতের কাছে থাকা বৈধ চুক্তির (১৯৭২ সালে স্বাক্ষরিত ২৫ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি) অধীনে ভারতীয় সেনাবাহিনী যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু আপনি যদি নাম পরিবর্তন বা তথাকথিত কনফেডারেশন গঠনের ধারণা থেকে বিরত থাকেন তাহলে ভারত ১৫ আগস্ট যা-ই ঘটে থাকুক না কেন, তাকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনা হিসেবেই বিবেচনা করবে।’

মোশতাকের সরাসরি পাকিস্তানীকরণ বন্ধের পেছনে ভারতের এই প্রচ্ছন্ন হুমকির বিষয়টিকে বেশ প্রাসঙ্গিক মনে হয়। কারণ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ২৫ বছর মেয়াদি বন্ধুত্ব, সহযোগিতা ও শান্তি-বিষয়ক চুক্তি ছিল। চুক্তিটি ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধির মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছিল ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ। যে বৈধ চুক্তির আওতায় ভারত যেকোনো সময় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সেনা অভিযান চালাতে পারত। বলা যায়, ১৯ আগস্ট বঙ্গভবনে মোশতাককে ভারতের উচ্চমহল থেকে ‘এনডোর্স’ করা ওই কূটনৈতিক নোটের বক্তব্য শোনার পরই পেছনে থাকা চেয়ারে খন্দকার মোশতাক ধপ করে বসে পড়েন। আর যার সঙ্গে সঙ্গে দপ করে নিভে যায় ভুট্টোর পুনঃএকত্রীকরণের স্বপ্ন। লন্ডন মিশন গুটিয়ে নতুন পরিকল্পনা শুরু করেন ভুট্টো। কনফেডারেশন গঠন বা পুনঃএকত্রীকরণের স্বপ্ন বাস্তবায়ন না হলেও বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে এই বাংলাদেশে পাকিস্তানীকরণের কাজে কোনো বাধা আসেনি। ১৯৯৬ সালের আগে যতগুলো সরকার ছিল, তারা কোনো না কোনোভাবে তোষণ করেছে স্বাধীনতাবিরোধীদের। বাস্তবায়ন করতে চেয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী চেতনাকে।

লেখক: শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

SUMMARY

1528-1.jpg