জটিল আবর্তে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড


অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ

১. জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন, রাষ্ট্রচিন্তা এবং সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ভাবনা ও পরিকল্পনা ছিল সুদূরপ্রসারী, তাৎপর্যময়, দুঃখী মানুষ-মানব মুক্তি ছিল তার স্বপ্ন-সাধনা। তিনি শুধু বাঙালি জাতির পিতা নন, জাতির ঊর্ধ্বে বিশ্বনেতা। বিশ্বের নিপীড়িত সংগ্রামী মানুষের দুর্দমনীয় কণ্ঠস্বর। ‘দুই বিশ্ব-তত্ত্ব’ শোষক আর শোষিত। তিনি ছিলেন শোষিতের পক্ষে। তাঁর বক্তব্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পদক্ষেপে এ বিষয়ে কোনো সংশয় বা দ্বিধা ছিল না। শোষক চক্রের হিংস নিষ্ঠুর থাবা তাঁর দিকে ধাবিত ছিল সর্বদা। সে কারণে এই মহামানবের হত্যার ক্যানভাস বিশাল এবং জটিল কূটকৌশলে আবর্তিত।

আমরা বলে থাকি, শোষক চক্রের মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। কীভাবে জড়িত তার দালিলিক প্রমাণ সরাসরি পাওয়া যায়নি এখনো। যেমনটি চিলির আলেন্দে বা দক্ষিণ ভিয়েতনামের থিউয়ের হত্যার সঙ্গে পেন্টাগন জড়িত এ কথার দালিলিক প্রমাণ মেলে, কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সরাসরি দালিলিক স্বীকারোক্তি এখনো পাওয়া যায়নি। তা হলে আমরা যে বলে থাকি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, সেটি কীভাবে প্রমাণিত হবে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিপ্লোমেসির দুটি প্রধানতম ধারা ও প্রক্রিয়া রয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার ক্ষেত্রে ‘ওভার্ট ডিপ্লোমেসির’ পরিবর্তে ‘কভার্ট ডিপ্লোমেসির’ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছিল, সে পথেই এগোতে হবে।

২. ১৯৭৫ সালে মার্কিন দূতাবাসে ‘ব্যুরো অব ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিসার্চ’ বাংলাদেশ ডেস্কের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন স্টিফেন হাইসেন ব্রাউন। তার ভাষ্য মতে, বাংলাদেশে ’৭৪ সালের শেষ দিকে খাদ্য সংকট পরবর্তী সময়ে সামরিক অভ্যুত্থানের গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। যার সঙ্গে ছিল শেখ মুজিবের প্রাণনাশের হুমকিটিও। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ যারা দূতাবাসে আসতেন তারাও এই নিয়ে কানাকানি করছিলেন। এ ধরনের গুজবের বিষয়টি দ্রুততার সঙ্গে ওয়াশিংটনকে জানানো হয় এবং ‘বলা হয় এটা শুধু অলস গালগল্প নয়।’ এও বলা হয়, শেখ মুজিবের জীবন হুমকির সম্মুখীন।’ বিষয়টি নিয়ে ওয়াশিংটন থেকে কোনো নির্দেশ পাওয়া গিয়েছিল কিনা তা জানা যায়নি। তবে মার্কিন দূতাবাসে যারা কর্মকর্তা ছিলেন তাদের মধ্যে প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছিল, ‘প্রাণনাশের’ বিষয়টি শেখ মুজিবকে জানানো দূতাবাসের নৈতিক দায়িত্ব বর্তায় কিনা? দূতাবাসের ক্যামেরা বৈঠকে আলোচনার পরে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, ‘হত্যার থ্রেট’ সম্পর্কে শেখ মুজিবকে জানানোর একটি দায়িত্ব রয়েছে। সেই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন অ্যাম্বাসেডর ইউজেন বোস্টার ১৯৭৫ সালে জুলাই মাসের শেষ অথবা আগস্টের প্রথম দিকে প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করেন।
স্টিফেন ব্রাউন বলছেন, বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে রাষ্ট্রদূত বোস্টারের টকিং পয়েন্ট কী হবে সেগুলো তাকে ড্রাফট করতে হয়। সব কিছু মনে না থাকলেও এটুকু তার মনে আছে যে, ওই ড্রাফটের একটি পয়েন্ট ছিল ‘আমরা সরকার উত্খাত ও কু-এর হুমকি শুনছি’ যা শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে পরিচালিত। কিন্তু কারা এ ধরনের কর্মকাণ্ডে লিপ্ত তার নাম বলা হয়নি। রাষ্ট্রদূতের এই কথায় বার্তা ছিল, ঘটনা সম্পর্কে ‘তাঁকে সাবধানতা ও সতর্ক করা।’ তিনি লিখেছেন, ‘বিষয়টি শোনার পর বঙ্গবন্ধু এটাকে সাধারণভাবে গ্রহণ করলেন। বোস্টার তাকে বলেন শেখ মুজিব তার কথা শুনে বলেছিলেন, ‘everything under control’. কিন্তু নাটকীয় ঘটনা হলো ১৫ আগস্টের দুঃখজনক ঘটনার পূর্বেই ওই ডেস্ক থেকে স্টিফেন ব্রাউনকে সরিয়ে দেওয়া হয় এবং জর্জ গ্রিফিন ওই পদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

৩. মি. স্টিফেন হাইসেন ব্রাউন ১৯৯৬ সালে দ্বিতীয়বার বাংলাদেশে আসেন। তিনি বলেছেন, সে সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যিনি বিদেশে থাকায় জীবিত ছিলেন, তিনি বিশ্বাস করতেন, তাঁর পিতার হত্যার চক্রান্তের বিষয়ে মার্কিনিরা পূর্বেই জ্ঞাত ছিল। কিন্তু তারা এটা থামানোর জন্য কিছুই করেনি। এমনকি তাঁর ধারণা ছিল এর পেছনে মার্কিনিদের হাত ছিল। এ কথা পরিষ্কার যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানাভাবে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক সাহায্য ও সহযোগিতা করেছে। কিন্তু এটাও ঠিক যে, অর্থনৈতিক ‘অ্যাসিসটেন্স’ এবং ‘পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার’ দুটি ছিল পৃথক। বাংলাদেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিকভাবে সম্পর্ক ছিল খুব শীতল।

৪. প্রশ্ন থেকে যায়, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে মার্কিনিরা জড়িত বা কলকাঠি নাড়িয়েছিল কি না? মার্কিন তথ্যে বলা হয়, ১৯৭৫ সালের ২১ মে প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার অপচেষ্টা চলে। তিনি যখন ঢাকার বাইরে একটি টিভি স্টেশন পরিদর্শন করে ফিরছিলেন সে সময় তাঁকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছোড়া হয়, এতে অপরিচিত দুজন নাগরিক আহত হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বেঁচে যান। সংবাদটির সূত্র ছিল, প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা বিভাগের ডেপুটি সুপারিন্টেনডেন্ট অব পুলিশ এবং একজন সাংবাদিক। হত্যা প্রচেষ্টার পেছনে তদানীন্তন সিআইএর ঢাকাস্থ স্টেশন চিফ ফিলিপ চেরি এ ধরনের ষড়যন্ত্রের ফাঁদ আগে থেকেই পেতেছিলেন বলে ধারণা করা হয়।

৫. বঙ্গবন্ধু হত্যার কয়েক মাস পর মার্কিন দূতাবাসের মধ্যম স্তরের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ১৫ আগস্টের পূর্ব থেকেই দূতাবাসের মধ্যে বড় ধরনের টেনশন বিরাজ করছিল এবং সে সময় দূতাবাসে এ কথাটি মৃদুভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে, সিআইএর স্টেশন চিফ ফিলিপ চেরি এবং রাষ্ট্রদূত ইউজেন বোস্টারের মধ্যে বিরোধ এবং উত্তেজনা চলছে। ওই কর্মকর্তা সুনির্দিষ্টভাবে কোন বিষয়ে গভীর উত্তেজনা ও বিরোধ চলছিল তা না বললেও তিনি বলেছেন, ‘Something happened that should not have happened’.

১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি সময় ফিলিপ চেরি ঢাকায় বদলি হয়ে সিআইএ প্রধানের পদে বসেন। মার্কিন তথ্য সূত্রে দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় মার্কিন কনস্যুলার হ্যারল্ড সেন্ডার্সকে ৭৪ সালে প্রমোশন দিয়ে হেনরি কিসিঞ্জার তাঁকে গোয়েন্দা ও গবেষণা ডিপার্টমেন্টের ডাইরেক্টর নিযুক্ত করেন। গ্রিফিনকে দক্ষিণ এশিয়া ডেস্কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। উল্লেখ্য যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় এরা দুজনই খন্দকার মোশতাক ও তার সঙ্গীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। এ দুজনই ছিলেন হেনরি কিসিঞ্জারের একান্ত বিশ্বস্ত লোক। হেনরি কিসিঞ্জার প্রথম থেকেই স্বাধীন বাংলাদেশ চাননি, বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে মনে করতেন মার্কিন নীতি ও তাঁর ব্যক্তিগত পরাজয়। তিনি এও মনে করতেন, বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের ফলে মার্কিন স্বার্থ বিঘ্নিত হবে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় নিরাপত্তা নীতি বাস্তবায়ন দুরূহ হয়ে পড়বে। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির মূল টার্গেট ছিল চীনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন এবং সম্পর্ক উন্নয়ন। এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জোটনিরপেক্ষ নীতি তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন পথে বাধা সৃষ্টি করছে। মার্কিন নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু কম্বোডিয়াকে স্বীকৃতি দেন। এটি ছিল কিসিঞ্জারের জন্য বড় ধরনের ধাক্কা। কিসিঞ্জারের মতো একজন ধুরন্ধর কূটনৈতিক ব্যক্তিত্ব এটাকে সহজভাবে নেননি। প্রতিশোধ গ্রহণের পথ ধরেন। এর প্রমাণ পাওয়া যায়, কিসিঞ্জারের সাবেক সহযোগী রজার্স মরিচের বইতে। বইটির নাম ‘আনসারটেইন গ্রেটনেস-হেনরি কিসিঞ্জার ইয়ার্স।’ তিনি লিখেছেন, ‘কিসিঞ্জারের ব্যক্তিগত ডায়েরিতে শত্রু হিসেবে তিনজনকে চিহ্নিত করা হয়েছিল, ‘চিলির আলেন্দে, দক্ষিণ ভিয়েতনামের থিউ এবং বাংলাদেশের শেখ মুজিব।’

৬. বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের দুই দিন আগে গ্রিফিন ঢাকায় আসেন এবং স্টিফেন ব্রাউনকে সরিয়ে ওই পদে বসেন। জর্জ গ্রিফিন নিজেই স্বীকার করেছেন, ‘তাঁর সঙ্গে খন্দকার মোশতাক এবং জিয়ার লোকজন যোগাযোগ রাখতেন।’ তারা ছিলেন মূল খলনায়ক। দৃশ্যমান খুনিরা ছিল হাতিয়ার। একই সঙ্গে ফিলিপ চেরিও স্বীকার করেন যে, ‘আমাদের যোগাযোগটা এত ভালো ছিল যে, অভ্যুত্থানের খবর পেয়ে আমরা খুব শিগগিরই তা যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাতে পেরেছিলাম।’ তিনি স্বীকার করেন যে, ‘তিনি যখন যুক্তরাষ্ট্রে খবর পাঠান, তখনো অভ্যুত্থান চলছিল।’

এসব জটিলতাপূর্ণ নাট্যমঞ্চের পর্দা উঠালে সহজেই দেখা যাবে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হেনরি কিসিঞ্জার, সিআইএ প্রধান হেলম্স, জর্জ গ্রিফিন এবং ফিলিপ চেরির সমন্বয়ে যে চক্রটি গড়ে উঠেছিল বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে তাদের ভূমিকা ছিল স্পষ্ট। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল জাতীয়ভাবে খন্দকার মোশতাক ও জিয়া চক্র। সে এক ভিন্ন অধ্যায়।

লেখক : ৭২ সালের খসড়া সংবিধান প্রণেতা, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী।

SUMMARY

1527-1.jpg