১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়৷ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত কিছু কর্মকর্তা ও জওয়ান এই হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন৷
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের পুরো রাজনীতির মোড় পরিবর্তিত হয়ে যায় এ হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে৷ এ ঘটনার পর প্রায় দেড়দশকজুড়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সেনাশাসন চলে দেশটিতে৷
প্রায় দশকব্যাপী সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে ১৯৯০ সালে জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সরকার পতনের মধ্য দিয়ে পুনরায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু হয়৷ কিন্তু জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) তখন নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসে এবং তারা মুজিব হত্যাকাণ্ডের বিচারের বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি৷
এ ঘটনার দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে জিতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে এবং এ হত্যাকাণ্ডের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করে৷ অবশেষে হত্যাকাণ্ডের ৩৪ বছর পর বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ মামলাটির চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করল৷
মামলার ঘটনাক্রম:
১৫ আগস্ট , ১৯৭৫: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার স্ত্রী বেগম ফজিলতুন্নেছা মুজিব এবং তিন ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেলকেও হত্যা করা হয়৷ দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান মুজিবের দু'কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা৷ সেদিনের নারকীয় হত্যাযজ্ঞে তাঁর দুই পুত্রবধূ, ছোটভাই, বোনের ছেলেমেয়ে ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন এবং তাঁর প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তাসহ নিহত হন ২৬ জন৷
২৬ সেপ্টেম্বর , ১৯৭৫: এ হত্যাকাণ্ডের বিচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে খন্দকার মোশতাক সরকার ইমডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করে৷
২ অক্টোবর , ১৯৯৬: হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকার সময় তাঁর রিসেপসনিস্ট কাম রেসিডেন্ট পিএ আ ফ ম মুহিতুল ইসলাম ধানমন্ডি থানায় ২৪ আসামির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন৷
১২ নভেম্বর , ১৯৯৬: আওয়ামী লীগ সরকার দায়মুক্তি অধ্যাদেশটি বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ উন্মুক্ত করে৷
১৫ জানুয়ারি , ১৯৯৭: তদন্ত শেষে পুলিশ ২৪ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করে৷
১২ মার্চ , ১৯৯৭: চার আসামি মারা যাওয়ায় ২০ জনের বিরুদ্ধে ঢাকায় দায়রা জজ আদালতে বিচার শুরু৷
৮ নভেম্বর , ১৯৯৮: ঢাকার দায়রা জজ গোলাম রসুল ২০ আসামির মধ্যে ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন৷ এর বিরুদ্ধে কারাবন্দি চার আসামি বজলুল হুদা, সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও মহিউদ্দিন আহমেদ হাইকোর্টে আপিল করেন৷
২৮ জুন , ২০০০: হাইকোর্টের বিচারপতিরা কয়েক দফা বিব্রত হওয়ার পর ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শুরু৷
১৪ ডিসেম্বর , ২০০০: হাইকোর্ট এ মামলায় বিভক্ত রায় দেয়৷ বিচারপতি মো. রুহুল আমিন ১০ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন৷ অপর বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ১৫ আসামির ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন৷
১২ ফেব্রুয়ারি , ২০০১: হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চের বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিমের আদালতে মামলার শুনানি শুরু৷
৩০ এপ্রিল , ২০০১: তৃতীয় বেঞ্চ ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে তিনজনকে খালাস দেয়৷
১৩ র্মাচ , ২০০৭: মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ল্যান্সার এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেপ্তার৷ একই বছরেরর ১৮ জুন তাকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়৷
২ আগস্ট , ২০০৭: হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের দায়ের করা লিভ টু আপিলের ওপর শুনানির জন্য বেঞ্চ গঠন এবং শুনানির প্রক্রিয়া শুরু৷
৩০ অক্টোবর , ২০০৭: পেপারবুক তৈরি করে জমা দিতে আসামি পক্ষের শেষ সময়৷ তারা পেপারবুক ও যুক্তির সংক্ষিপ্তসার আদালতে জমা দেয়৷
২৩ আগস্ট , ২০০৯: রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তির সংক্ষিপ্তসার আপিল বিভাগে জমা দেওয়া হয়৷
২৪ আগস্ট , ২০০৯: আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি মোহাম্মদ মোজাম্মেল হোসেন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আপিল শুনানির জন্য ৫ অক্টোবর তারিখ ধার্য করে দেন৷
৪ অক্টোবর , ২০০৯: মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তিতে শুনানির জন্য আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতিকে নিয়ে একটি বেঞ্চ গঠন৷
৫ অক্টোবর ২০০৯: মামলার আপিল শুনানি শুরু৷
১৯ নভেম্বর ২০০৯: মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামির আপিল আবেদন খারিজ করে দেয় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ৷ ফলে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মোট ১২ আসামিরই মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে৷
প্রতিবদেক: মুনীর উদ্দিন আহমেদ
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক