অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিরোধিতাকে পরাজিত করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এ জাতি বিজয় অর্জন করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। পরাজিত হয় ৫২, ৫৪, ৬১, ৬৬, ৬৯, ৭০-এর বাঙালি চেতনার বিরুদ্ধাবলম্বনকারী শক্তি। কিছুদিনের জন্য পরাজিত শক্তি চুপচাপই ছিল, কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনককে হত্যার মধ্য দিয়ে পুনরায় ক্ষমতাসীন হয় দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের বিরোধীপক্ষ ৭১-এর পরাজিত শক্তি। আসলে ওই দিন যারা রাষ্ট্রক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে তারা মূলত আবার পূর্ব পাকিস্তানকেই কায়েম করে।
মোশতাক, জিয়ার নেতৃত্বে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন হয় আজীবন বাঙালিত্বের বিরোধিতাকারী অপশক্তি। ইতিহাসের চাকা ঘুরতে থাকে পেছনের দিকে। ১৯৭৬ সালের ৩ মে এক ফরমান জারি করে জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু কর্তৃক নিষিদ্ধকৃত সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলোকে পুনর্বাসিত করেন। রাজনীতিতে নিয়ে আসা হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রধান বিরোধিতাকারী জামায়াতে ইসলামীকে। ১৯৭৬ সালের ২১ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সায়েমের কাছ থেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ কেড়ে নিয়ে কিছুদিন পর স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৭৭ সালের ৩০ মে আইয়ুবীয় কায়দায় হ্যাঁ-না ভোটে ৮৮.৫ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতিতে ৯৮.৮৮ শতাংশ ভোট তার পক্ষে দিয়েছে বলে প্রচার করেন। ১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই পিপিআর ঘোষিত হওয়ার পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হয়। যদিও সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় আরও দুটি আওয়ামী লীগ তৈরির চেষ্টা করা হয়। আওয়ামী লীগে একাধিক বিভাজন সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু সময়ের পরীক্ষায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শের মূল আওয়ামী লীগই টিকে যায়।
সামরিক শাসনের মধ্যে সেনানিবাসে বসে রাষ্ট্রীয় অর্থে উচ্চাভিলাষী ও ক্ষমতালিপ্সু সামরিক-বেসামরিক পাকিস্তানপন্থী দালাল ও সুবিধাবাদী দলছুট রাজনীতিকদের নিয়ে প্রথমে ‘জাগো দল’ পরে ‘বিএনপি’ গঠন করা হয়। ১৯৭৭ সালের ৯ এপ্রিল সেনাপ্রধান ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক থাকা অবস্থায় জিয়াউর রহমান জাগো দলে যোগ দেন। ১৯৭৮ সালের ১ মে থেকে উন্মুক্ত রাজনীতি শুরু হয়। জিয়া নির্বাচন সংক্রান্ত আইন সংশোধন করে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে কেবল সেনাবাহিনী প্রধানের রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ব্যবস্থা করেন। ১৯৭৮ সালের ৩ জুন ব্যাপক কারচুপিমূলক নির্বাচনে ৭৮.৭ শতাংশ ভোট পেয়ে জিয়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
‘রাজনীতি রাজনীতিকদের জন্য ডিফিকাল্ট’ করার রাজনীতির প্রবর্তক ও ‘মানি ইজ নো প্রোবলেম’ অর্থনীতির জনক জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদের ব্যাপক জালিয়াতিপূর্ণ নির্বাচনে ২০৭টি আসন পেয়ে ১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বরে গঠিত বিএনপি সংসদ দখল করে। প্রথমে মশিউর রহমান যাদু মিয়াকে সিনিয়র মন্ত্রী এবং পরে ১৯৭৯ সালের ১২ মার্চ তিনি মারা গেলে পাকিস্তানপন্থী মুসলিম লীগ নেতা শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। বাংলাদেশকে পাকিস্তানিকরণের ষোলোকলা পূর্ণ করলেন জিয়াউর রহমান। পুরো দেশ চলে গেল পাকিস্তানি ভাবধারার লোকদের দখলে। বাকি থাকল কেবল পতাকা আর মানচিত্রটি, জাতীয় সংগীতটি বদলানোর চেষ্টার ধৃষ্টতাও দেখালেন তারা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বলবৎ হওয়া সামরিক আইন ও রাত্রিকালীন সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করা হয় ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল।
১৯৮১ সালের ১৩-১৪ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলে শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সময় ভাগ্যক্রমে বিদেশে অবস্থান করায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া শেখ হাসিনা নির্বাসিত জীবন যাপন করছিলেন দিল্লিতে। সভাপতি পদ গ্রহণে শেখ হাসিনাকে রাজি করানো এবং দেশে ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগের অংশ হিসেবে দিল্লিতে একাধিক বৈঠকে বসেন আওয়ামী লীগের নেতারা। তাদের মধ্যে ছিলেন আব্দুল মালেক উকিল, ড. কামাল হোসেন, জিল্লুর রহমান, আবদুল মান্নান, আবদুস সামাদ আজাদ, এম কোরবান আলী, জোহরা তাজউদ্দীন, সাজেদা চৌধুরী, ডা. এস এ মালেক, আমির হোসেন আমু, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ।
শেখ হাসিনার ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণের মধ্য দিয়ে যে ভিত্তিকে উপড়ে ফেলার চেষ্টাই নড়বড়ে করে ফেলা হয়েছিল তা পুনঃগ্রথিত হওয়ার যাত্রার শুভসূচনা। শেখ হাসিনাকে পেয়ে বাঙালি তার ‘বাঙালিত্ব’ ও ‘বাংলাদেশকে’ ফিরে পাওয়ার আশায় বুক বাঁধল। আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয় ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে। জনস্রোতে কুর্মিটোলা বিমানবন্দরের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছিল। অনেক ঝুঁকি নিয়েই অবতরণ করেছিল শেখ হাসিনাকে বহনকারী ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ৭০৭ বোয়িং বিমানটি। লাখ লাখ মানুষ রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়েছিল। গগনবিদারী স্লোগানের মধ্যে বেরিয়ে আসেন সাদা রঙের ওপর কালো ডোরাকাটা তাঁতের মোটা শাড়ি পরা প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি তখন কাঁদছিলেন, প্রকৃতিও একই পথ ধরল। চারদিক অন্ধকার হয়ে বৃষ্টি শুরু হলো, সঙ্গে ঝড়।
এক সময় জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করে এরশাদও হ্যাঁ-না গণভোটের খেলা আয়োজন করেছিলেন এই দেশে। এবার ভোটার উপস্থিতি দেখানো হয় ৯৫ শতাংশ, যার ৭১ শতাংশ এরশাদের ১৮ দফা কর্মসূচির পক্ষে। সামরিক শাসন চলতে থাকে। ১৯৮৩ সালের শুরুতে আওয়ামী লীগের ১৫ দলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয়। ৯ এপ্রিল হোটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত ১৫ দলীয় ঐক্যজোটের এক সম্মেলনে শেখ হাসিনা সামরিক শাসনবিরোধী ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ১৯৮৬ সালের মার্চে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এরশাদবিরোধী আন্দোলন তুমুল আকার ধারণ করে। ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনাকে কয়েকবার গৃহবন্দি করা হয়। ১৯৮৮ সালে চট্টগ্রামে শেখ হাসিনার সমাবেশমুখী মিছিলে গুলি চালিয়ে এরশাদের পেটুয়া বাহিনী ৩৮ জন নেতাকর্মীকে হত্যা করে। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান শেখ হাসিনা। শুরু হলো শেখ হাসিনাকে হত্যার আনুষ্ঠানিক মহড়া, যা ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ‘ভাঙা সুটকেস’ বাহিনীর অন্যতম কর্ণধার তারেক রহমানের নেতৃত্বে গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে চূড়ান্ত রূপ পায়।
এ দেশে শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য গ্রেনেড হামলাসহ পরিচালনা করা হয় একাধিক হত্যাপ্রচেষ্টা। একই ধারায় দেশ চলে ২০০৯ সালের আগ পর্যন্ত। এমনকি ২০০৭-০৮ সালে আবারও দেশকে দখলে নেয় পাকিস্তানি মানসিকতার সামরিক গোয়েন্দা ব্রিগেডিয়ার বারী ও আমিনরা। একমাত্র শেখ হাসিনার নেতৃত্বের দৃঢ়তার কারণেই ২০০৯-পরবর্তী বাংলাদেশ সেনা বা সেনাসমর্থিত শাসনের অবসান হয়। বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উন্নয়নের মহাসড়কে।
অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান : উপাচার্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়