এম মতিউর রহমান মামুন
‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল’।
৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর এই উচ্চারণ বাঙালি স্বাধীনতা লাভের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন। কারণ একটা বুলেট যখন এক বা দুই জন’কে হত্যা করতে পারে তখন বঙ্গবন্ধুর কাব্যিক বুলেট ‘ আর যদি একটি গুলি চলে’ পুরো পাকিস্তানকে আহত করেছিলো আর মুক্তিকামী বাঙালিদের শক্তি সঞ্চারিত হয়েছিল। ফলে যুদ্ধের জন্য মানসিক প্রস্তুতি সেদিন থেকেই শুরু হয়েছিল। দীর্ঘ লড়াই, সংগ্রাম, ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্ত, মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আর্জিত স্বাধীনতার উপর আঘাত হানলো কিছু বেঈমান, দালাল পাকিস্তানের দোসররা। তাদের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে প্রাণ দিতে হলো ৭৫ সালের ১৫ আগস্ট।
বাঙালি জাতির ইতিহাসে জঘন্যতম দিন ১৫ আগস্ট, কেননা এই দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাঁর পরিবারের সকল সদস্য কে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। কী আশ্চর্য ইয়াহিয়া-ভুট্টো পাকিস্তানের কারাগারে তাঁকে হত্যা করতে সাহস পায়নি কিন্তু নিজ দেশের কিছু বিশ্বাসঘাতক নরপশু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারলো কী করে সে জিজ্ঞাসা তো থেকেই যায়? নিজের দেশের মানুষের প্রতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মবিশ্বাস এতই দৃঢ় ছিল যে, তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র হচ্ছে এমন পূর্বাভাস পেয়েও তা উড়িয়ে দিয়েছিলেন। বিভিন্ন তথ্যসূত্র ও গণমাধ্যমের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ‘জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আগেই তথ্য ছিল ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স উইং, সংক্ষেপে ‘র’ এবং মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ‘সিআইএ’ সহ একাধিক বিদেশি সংস্থার কাছে। সম্ভাব্য এই অভ্যুত্থানের বিষয়ে ‘র’ এর কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুকে সতর্কও করেছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নিজেই’ কিন্তু বঙ্গবন্ধু তা বিশ্বাস করতে নারাজ ছিলেন। অপর এক গবেষণাতে বলা হয়েছে, ‘র’-এর তৎকালীন প্রধান রামেশ্বর নাথ কাও ১৯৭৪ সাল থেকে মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তথ্য পেয়েছিলেন। তারা (আর এন কাও) কাছে গোপন রিপোর্ট পৌঁছে যে, বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর মধ্যে বিদ্রোহ পাকিয়ে তোলা হচ্ছে। তিনি ব্যক্তিগতভাবে এটা সম্পর্কে ইন্দিরা গান্ধীকে সংক্ষিপ্ত বর্ণনাও দেন। পরে ইন্দিরা গান্ধী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে মুজিবকে অবহিত করার জন্য তাকেই ঢাকায় পাঠান। ৩২ নম্বরের বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হয় তার,
আরএনকাও-এর ভাষায়, ‘আমরা তখন বাগানের মধ্যে পায়চারি করছিলাম। আমি মুজিবকে বলি যে, তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আমাদের কাছে তথ্য আছে; কিন্তু তিনি (বঙ্গবন্ধু) আনন্দিত ছিলেন।’ তিনি বলেন, ‘আমার কিছুই হতে পারে না, তারা আমার লোক।’ এমনকি যদিও আমি সুনির্দিষ্ট তথ্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ তাকে দিয়েছি, আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি।’ কিন্তু বঙ্গবন্ধু এসব বিশ্বাস করতে পারেনি, তাঁর বিশ্বাস ছিলো কোনো বাঙালি তাঁকে মারতে পারে না’। বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থা বার বার সতর্ক করার পর ও তার একই বিশ্বাস, যে পাকিস্তানিরা আমাকে মারতে পারেনি আর আমার বাঙালি আমাকে মারতে আসতে পারে না। ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে কাওয়ের কাছে আরও বিস্তারিত খবর পৌঁছে যায়। সেটা হলো, বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে মুজিবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র সংগঠিত হচ্ছে। ইন্দিরা গান্ধী দ্রুতবেগে মুজিবকে অবহিত করেন, কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতে অসম্মত হন। তিনি তো বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা, তিনি তার আপন লোকজনের দ্বারা গুপ্তহত্যার শিকারে পরিণত হতে পারেন না। ‘র’-এর কাছে থাকা প্রতিবেদনগুলো ১৯৭৪ সালেও হালনাগাদ ছিল যে, বাইরের দেশের শক্তির মাধ্যমেই ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন হবে।
বঙ্গবন্ধু খুব ভালো করেই জানতেন মুক্তিযুদ্ধে কারা পাকিস্তানের দালালি করেছিলেন। তাঁদের বিচার বঙ্গবন্ধু করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ঘাতকরা তা করতে যে দিবে না বঙ্গবন্ধু তা অনুমান করতে পারেননি। ‘র’- প্রধান রামেশ্বর নাথ কাও সানডে পত্রিকায় লিখেছিলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণনাশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল সদস্যের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আমরা আগাম তথ্য পেয়েছিলাম। আমি বিষয়টি নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কথা বলি। তাঁকে আমরা বলি যে, এ সংক্রান্ত তথ্য অত্যন্ত সূক্ষ্ম সূত্র থেকে আমরা জানতে পেরেছি। এসব সূত্রের পরিচয় যে কোনো মূল্যে গোপন রাখতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে আমি ঢাকা সফর করেছিলাম। শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আমার শেষ বৈঠকের এক পর্যায়ে আমি তাঁকে বঙ্গভবনের [সম্ভবত গণভবন] বাগানে একান্তে কিছু সময় দেয়ার জন্য অনুরোধ করি। সেখানে আমি তাঁর প্রাণনাশের আশঙ্কা নিয়ে আমাদের জানা তথ্য তাঁকে অবহিত করি। কিন্তু তিনি উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বাহু দুলিয়ে বলেন, ‘তারা আমার নিজের সন্তান, তারা আমার ক্ষতি করবে না’। আমি তাঁর সঙ্গে তর্কে যাইনি। শুধু এটুকু বলেছিলাম, এসব তথ্য নির্ভরযোগ্য এবং ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আমরা যা জানতে পেরেছি তা আমরা তাঁকে অবহিত করব। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালের মার্চে আমি আমাদের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলাম। তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। এবং তাঁকে অবহিত করেছিলেন যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পদাতিক ও অশ্বারোহী ইউনিট তাঁর প্রাণনাশের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত শেখ মুজিব এসব সতর্কতা অগ্রাহ্য করেছিলেন’। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে তারা নবজাতক ‘বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র ও একটি পতাকা’ হত্যা করেছে অথছো তারা আজও বাংলাদেশে রাজনীতি করছে বহাল তবিয়তে, এটা আমাদের রাজনীতি চর্চার করুণ পরিণতি বলা যেতে পারে। যদি তাই না হয় তাহলে বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতার লালসায় যুদ্ধপরাধীদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা দিতে পারতেন না। যাহোক জনতার কথার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর পাওয়ার পর ইন্দিরা গান্ধীর প্রতিক্রিয়া নিয়ে লেখক পুপুল জয়কর লিখেছেন, ‘আমি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সন্ধ্যার দিকে তার (ইন্দিরা গান্ধী) বাসভবনে যাই। আমি দেখতে পাই, তিনি নিজেও নিরাপত্তাহীনতার বিষয়ে মহাআতঙ্কিত। তিনি (ইন্দিরা) আমাকে বলেন যে, মুজিব হত্যা হচ্ছে ষড়যন্ত্রের প্রথম ঘটনা। এটাই উপমহাদেশকে ডুবিয়ে দেবে। মুজিব ইতোমধ্যেই প্রস্থান করলেন। ইন্দিরা বিভিন্ন প্রমাণ ও যুক্তি দেখিয়ে বলেন, পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু হবেন তিনি নিজেই। মুজিবের শিশু ছেলেকে হত্যার খবর সব ধরনের শুভ চিন্তাকে ধ্বংস করে দেয়। ভয় ভীতিগুলো প্রকট আকার ধারণ করে।
ইন্দিরা বলেন, ‘আমি গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলো অগ্রাহ্য করেছি, কিন্তু তেমনটি আমি আর করতে পারি না।’ রাজীবের পুত্র রাহুল মুজিবের পুত্রের সম-বয়স্ক। আগামীকাল তারও এমনটি হতে পারে। তারা আমাকে ও আমার পরিবারকে ধ্বংস করতে চায়।’ আত্মজীবনীর লেখক পুপুল জয়কর আরও লিখেছেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ইন্দিরার সঙ্গে মতবিনিময় করা কঠিন হয়ে পড়ে। তিনি আমার সঙ্গে যখন দেখা করেন তখনো তার দুই চোখ সবসময় সতর্ক থাকত।’
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মেজর জিয়া ক্ষমতা দখলের পর ‘দালাল আইন’ বাতিল করে ঘাতক, দালালদের কে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সুরক্ষিত করেছে। আর খালোদা জিয়া দালালদের গাড়িতে পতাকা তুলেছে তার বিচার চাওয়া অযৌক্তিক নয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য বাঙালি কাঁদবে হয়তো হাজার বছর ধরে হয়তো তারও পর। কেননা ৭৫ সালে যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে তার গন্ধ আজ ও পাই। ধানমন্ডির ৩২ নং শুরু হয়েছে এক বুকফাঁটা নীরব কান্না হয়তো তার শেষ কোথায় জানি না। মাঝে মাঝে শুনতে পাই শিল্পীর কণ্ঠে, বাঙালির নিঃশ্বাসে। তাতে একটু হালকা হই।
লেখক : রবীন্দ্রস্মৃতি সংগ্রাহক ও গবেষক