কমপক্ষে দুটি কারণে পাকিস্তানি সেনাযন্ত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ছয় দফাকে মেনে নেয়নি। কি ছিল ছয় দফায়? প্রধানত তিনিটি বিষয় ছিল তাতে- (১) সরকারের রাজস্ব আদায় ব্যবস্থার সংস্কার। রাজস্ব নির্ধারণ ও আদায় করার ক্ষমতা থাকবে প্রদেশগুলোর হাতে। অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের রাজস্ব ব্যবস্থা থাকবে পূর্ব পাকিস্তানিদের হাতে। (২) মুদ্রা ব্যবস্থার সংস্কার। দুই পাকিস্তানে দুটি আলাদা মুদ্রা থাকবে। তবে এই মুদ্রা অবাধে উভয় অঞ্চলে বিমিময়যোগ্য হবে। (৩) প্রতিটি প্রদেশ তাদের নিজের প্রয়োজন ও ইচ্ছামতো নিজের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে পারবে।
ছয় দফার মূল কথা হচ্ছে, অর্থনৈতিক দিক থেকে পাকিস্তানের দুই অংশকে এক করে দেখা যাবে না, এক ভাবে বিচার করা যাবে না। দুটি অংশের জন্য দুটি বিশেষ ধরণের এবং আলাদা ধরণের উন্নয়ন মডেল বেছে নিতে হবে।
কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিরা যখন জাতীয় বাজেটের ৫৫% ভাগ ব্যয় করে সেনাবাহিনীর জন্য এবং বাজেটের টাকা আসে পূর্ব বাংলার পাট রপ্তানি করে, তখন তাদের ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক। আসলে সেনাযন্ত্রই ছয় দফার দিকে বন্দুক তাকে করেছিল, কারণ ছয় দফার অস্তিত্ব সেনাযন্ত্রের অস্তিত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল।
পাকিস্তানিদের একটি অন্তর্নিহিত ভয় ছিল, ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সামরিক ভারসাম্যের পরিবর্তন। পূর্ব পাকিস্তান যদি স্বায়ত্বশাসিত হয় তবে সেনাবাহিনীর বাজেটে টান পড়বে। ফলে ভারতের বিপরীতে পাকিস্তান দুর্বল হয়ে পড়বে। কাশ্মীর হাত ছাড়া হয়ে যেতে পারে, যদি পূর্ব পাকিস্তানের কাশ্মীর নিয়ে ঝগড়া করার আগ্রহ না থাকে।
পশ্চিম পাকিস্তান বাঙালিদের সবসময় সন্দেহ করে এসেছে এই বলে যে, অর্থনৈতিক স্বায়ত্বশাসনের ভান করে, দুই প্রদেশের জন্য দুই মুদ্রা প্রচলন করে ওপর বাংলার সাথে বহির্বাণিজ্য সংগঠিত ও ধর্ম নিরেপেক্ষ সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়।
পাঞ্জাবি একচেটিয়া ব্যবসায়ীদের স্বার্থকে সরাসরি আঘাত করেছিল ছয় দফা, কারণ তারা তাদের প্রতিযোগী ভারতীয় ব্যবসায়ীদের হাতে পূর্ব বাংলাকে তুলে দিতে চায়নি। ছয় দফা আরও একটি জায়গায় আঘাত করেছিল। আঘাত করেছিল একটি বিশেষ মানসিকতার উপর, যে মানসিকতা উগ্র জাতীয়তাবাদী, ভারতের উপর প্রতিশোধকামী। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের পাতিবুর্জোয়া শ্রেণী এই মানসিকতা লালন করে চলেছে।
[তথ্য সূত্র: বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হচ্ছিল – বের্নার-অঁরি লেভি
অনুবাদ ও সম্পাদনাঃ – শিশির ভট্টাচার্য্য ]