ঘটনাবহুল ১৫ আগস্টের সকালবেলা।দিনটি ছিল পবিত্র শুক্রবার।আক্রান্ত হলো ৩২ নং রোডের ৬৭৭ নং বাড়ী।আক্রমণকারীরা শেখ সাহেবকে বন্দী করে তাঁকে নিয়ে নিচে নামতে থাকে।তাঁর সাথে মেজর মহিউদ্দিন( আরমার্ড ) ও মেজর হুদা।একজন তাঁর বাঁ পাশে, অন্যজন একটু পেছনে।এমন সময় সিঁড়ির ধাপে একটু নিচে দাঁড়ানো ৩/৪ জন সৈনিক বন্দুক উঁচিয়ে বিনা উস্কানিতে সরাসরি রাষ্ট্রপতির উপর গুলি বর্ষণ করলো।করা ছিল ঐ কিলার গ্রুপে? কে গুলি বর্ষণ করলো শেখ সাহেবের বুক লক্ষ্য করে?
অগাস্ট হত্যাকাণ্ডের ঠিক পরপরই যার নাম মুজিব হত্যার সাথে সবার মুখে মুখে বঙ্গভবনে ও ক্যান্টনমেন্টে উচ্চারিত হলো, সে হলো মেজর নূর চৌধুরী ও রিসালদার মোসলেম উদ্দিন।প্রথমতঃ মেজর নূর ঐ দিন শেখ সাহেবের বাসার উপর আক্রমণ গ্রুপেরই অন্যতম সদস্য ছিল।দ্বিতীয়তঃ শেখ সাহেব তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়ায় তার ঘৃণা ও আক্রোশ ছিল স্বাভাবিক।উপরন্তূ দ্বিতীয় প্রতক্ষ্যদর্শী মেজর মহিউদ্দিন সরাসরি উল্লেখ করেছেন, “নূরই শেখ সাহেবের উপর ঠান্ডা মাথায় গুলি বর্ষণ করে।”
লেঃ কর্নেল ( অবঃ ) এম এ হামিদ পিএসসি যখন শেখ সাহেবের বাসায় ১৫ তারিখ দুপুরে পরিদর্শনে যায়,তখন তিনি মেজর পাশা এবং আরো দুজন ল্যান্সার সৈনিককে জিজ্ঞাসা করেন, শেখ সাহেবকে কে গুলি করেছিল? তারাও তখন মেজর নূর ও মোসলেম উদ্দিনের কোথায় আকারে ইঙ্গিতে উল্লেখ করে।একজন সৈনিক নাম না জানা এন,সি ও’র নাম বলে।আরেকজন বলেছিল, একজন মেজর সাহেব ইংলিশে গালাগালি করে গুলি করেন।মেজর সফিউল্লাহও মেজর নূরের নাম শুনেছেন বলে জানান।
লেঃ কর্নেল ( অবঃ ) এম এ হামিদ পিএসসি ফারুকের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকালে বলেছিলেন, দেখ ফারুক, মাসকার্নহাস তার বইতে লিখেছে, তুমি তাকে ইন্টারভিউ দিয়ে বলেছো, মেজর নূরই গুলি করেছে।সঙ্গে সঙ্গে ফারুক উত্তেজিত হয়ে বলে, ও ব্যাটা মিথ্যাবাদী, অন্ধ হাফিজ এটা ওটা যা-তা গল্প বানিয়েছে।আমি তাকে বলেছিলাম, মহিউদ্দিন ছিল আক্রমণ গ্রুপের কমান্ডার।ঘটনার পরপরই সে আমাকে রিপোর্ট দেয় যে মেজর নূর শেখকে হত্যা করেছে।কারণ আমি যখন তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমরা উনাকে মেরে ফেললে কেন? তখন সে বলে, সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় হঠাৎ নূর উত্তেজিত হয়ে তাঁর উপর ফায়ার করে বসে।এই ছিল ফারুকের স্পষ্ট কথা।দেখা যায় এখানেও মেজর নূরের নামের প্রতিধ্বনি।
প্রকৃত অবস্থা হলো, শেখ সাহেব যখন সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসছিলেন,তখনই তাঁকে থামিয়ে রীতিমতো তাকে করে মাত্র ৭ফুট দুরুত্ব থেকে তাঁর বুক লক্ষ্য করেই গুলি করা হয়।তাঁর বুকে ১৮টি গুলির আঘাত পাওয়া যায়।সবগুলোই তাঁর বুকে ও পাঁজরে প্রায় একই স্থানে কাছাকাছি আঘাত করে।কোনো গুলিই তাঁর গলা বাঁ মুখমণ্ডলে আঘাত করেনি।এতে প্রতীয়মান হয় যে,একটি স্টেনগান থেকেই তাক করা একঝাঁক ব্রাশ ফায়ার সরাসরি তাঁর বুকে আঘাত হানে- তা নূরের স্টেনগান থেকে হোক,আর মোসলেম উদ্দিনের স্টেনগান থেকেই হোক, অথবা হাবিলদারের।অন্যরা তাঁর উপর ফায়ার করলেও গুলি এদিক সেদিক যায়, শুধু দুটো গুলি তাঁর পায়ে লাগে।একটি গুলি উপরে একজন সৈনিকের গায়েও লাগে।
যার ‘তাক’ করা ব্রাশ ফায়ার শেখ সাহেবের বুকে মৃত্যুবানের মতো আঘাত হানলো, সে কে হতে পারে? ৮০% সম্ভাবনা মেজর নূর।শেখ সাহেবকে ফায়ার করার মুহূর্তে তাঁকে ইংরেজিতে বকাবকি করা হয়।তিনজনের মধ্যে একমাত্র মেজর নূরের পক্ষেই ইংরেজিতে বকাবকি করা সম্ভব ছিল।সিঁড়ি যে স্থানে কিলার গ্রুপটি দাঁড়িয়ে ছিল,সেখানে স্বল্প পরিসর জায়গায় সামনের ২/১ জন ছাড়া তাদের পেছনে অবস্থানকারী অন্যদের শুট করার প্রশ্নই আসেনা।তাই ধরে নেওয়া যায়, একজনই ঠান্ডা মাথায় স্টেনগান তাক করে Get aside বলে ফায়ার করেছিল।বাকিরা বন্দুক উঁচিয়ে থাকলে তারা ফায়ার করতে পারে, নাও করতে পারে।
প্রতক্ষ্যদর্শী মেজর হুদা বলেছিলেন, সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন ঘাবড়ে গিয়ে একসাথে ফায়ার করে,এক কেউ নয়।তার কথা সঠিক বলে ধরে নিলে শেখ সাহেবের বিশাল দেহের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে অসংখ্য গুলিও আঘাত পাওয়া যেত, কিন্তু তা ছিল না।শুধুমাত্র বুকের একটি স্থানেই বুলেটের আঘাত কেন্দ্রীভূত ছিল।যা প্রমান করে,একজনের তাক করা ব্রাশ ফায়ার থেকেই ক্ষতের সৃষ্টি হয়।বহুজনের ফায়ার থেকে নয়।
অতএব বিভিন্ন তথ্য ও সূত্র এবং তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, শেখ মুজিবুর রহমানের উপর গুলি বর্ষণকারী দলে ছিল তিনজন – মেজর নূর চোধুরী, রিসালদার মোসলেম উদ্দিন এবং জনৈক ল্যান্সার এনসিও। এদের মধ্যে মেজর নূর চোধুরীর নামই সর্বাগ্রে।তারই তাক করা স্টেনগান থেকে বর্ষিত ব্রাশ ফায়ার থেকেই শেখ মুজিব নিহত হন।
তথ্য সূত্র: তিনটি সেনা অভ্যুথান ও কিছু না বলা কথা ( লেঃ কর্নেল ( অবঃ ) এম এ হামিদ পিএসসি )