ড. মো. হুমায়ুন কবীর
ইংরেজি বছরের আগস্ট মাসটি বাঙালি জাতির জন্য এক শোকাবহ মাস। এ আগস্ট মাসের ১৫ তারিখেই ইতিহাসের এক জঘন্যতম ও কলঙ্কজনক হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্রষ্টা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল। ইতিহাস সেখানেই থেমে থাকেনি। সেদিন শুধুমাত্র যে জাতির জনককেই হত্যা করেছিল তা নয়, ঘাতকের আঘাত থেকে বাদ যায়নি মাত্র ১১ বছরের সেই ছোট্ট শিশু শেখ রাসেলের আকুতিটুকু। সে সময় ঘাতকদের দুর্ভাগ্য ও বাংলাদেশের সৌভাগ্য- দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে। তার মধ্যে একজন হলেন দেশের অত্যন্ত সফল রাজনীতিক সুদীর্ঘ প্রায় ৩৪ বছর যাবৎ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী, তৃতীয়বারের মতো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারেও সফল প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং অপরজন তাঁরই সহোদরা অত্যন্ত সাদাসিধে জীবনে অভ্যস্ত, ক্ষমতার কাছাকাছি থেকেও যাঁকে ক্ষমতার কোনো মোহই বিন্দুমাত্র টানতে পারেনি সেই বিশিষ্ট সমাজসেবী এবং দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ও সরকারের একজন অন্যতম সুপরামর্শক শেখ রেহানা। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট সে রকম আরেকটি ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে যাচ্ছিল। কিন্তু সেখানে বঙ্গবন্ধুকন্যা মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে ও তাঁর মনের জোরে তিনি রক্ষা পেলেন ঠিকই কিন্তু তাৎক্ষণিক ঝরে গেল ২৪টি তাজা প্রাণ এবং আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করলেন আরো শতাধিক নেতাকর্মী।
জীবন দেওয়া ওই ২৪ জনের মধ্যে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী এবং মহিলা আওয়ামী লীগের এবং ত্যাগী দীর্ঘদিনের সভানেত্রী বেগম আইভী রহমান জীবন দেন। আর সেই মৃত্যুযন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে ধুঁকে ধুঁকে দীর্ঘদিন গ্রেনেডের শত শত স্প্লিন্টার শরীরে নিয়ে কষ্টের পর ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ নিহত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু যেমন ৭ মার্চ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার ডাক দিয়ে ৯ মাস দেশে মুক্তিসংগ্রাম চলার সময় পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থেকে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে সগৌরবে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন বাঙালির অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির জন্য। ঠিক তেমনি ১৯৭৫ সালের সেই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ড ঘটার পর ১৯৮১ সালে তাঁর বাবার মতোই অসীম সাহস ও মনোবল নিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য এ দেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। আবার এ আগস্ট মাসকে কেন্দ্র করেই ২০০৫ সালে ১৭ আগস্ট জেএমবি নামক একটি জঙ্গি সংগঠন সারা দেশে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে একটি বাদে ৬৩টি জেলাতেই একসঙ্গে বোমা মেরে এক ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করেছিল। এর একটিই মাত্র কারণ ছিল আর তা হলো দেশকে আস্তে আস্তে মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের দিকে নিয়ে যাওয়া এবং স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তিকে ক্ষমতায় আসতে না দেওয়া। তারা জানত যে, তাহলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হবে এবং উন্মোচিত হবে সকল ষড়যন্ত্রের রূপরেখা। আসলে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা, ২১ শে আগস্টের গ্রেনেড হামলা, ১৭ আগস্টের সারা দেশে সিরিজ বোমা হামলা, ময়মনসিংহে সিনেমা হলে বোমা হামলা, ঢাকার রমনা বটমূলে উদীচীর বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা ইত্যাদি আসলে একই সূত্রে গাঁথা বলে নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের ধারণা।
১৫ আগস্ট কলঙ্কজনক এ ঘটনা ঘটেছিল বলেই ৩ নভেম্বর জেলহত্যা এবং তৎপরবর্তী শেখ হাসিনার ওপর বারবার আঘাত এসেছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, ক্ষমতায় থাকুন আর না থাকুন তিনি এখনো বিশ্বের অন্যতম নিরাপত্তা হুমকিতে থাকা একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তার পরও তিনি দেশের দুঃখী মানুষের মুখে দুমুঠো অন্ন তুলে দিয়ে তাদের মুখে একটু হাসি ফোটানোর জন্য বাবার থেকেও বেশি মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে অকুতোভয় হয়ে কাজ করছেন। আমরা জানি বাঙালি বীরের জাতি। সে জন্যই বীর বাঙালিদের মাত্র নয়, মাসের যুদ্ধে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছিল। সেই যুদ্ধের মহানায়ক যে ছিলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এতে দেশের কিছু দুষ্কৃতিকারী ছাড়া আর কারো কোনো সন্দেহ নেই। সেসব যুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর সহযোদ্ধা অনেকেই ছিলেন, তার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সহচর যাঁরা তাঁদের জীবন দিয়েও সেটা প্রমাণ করে গেছেন। এখানে জাতীয় চার নেতার নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। এঁরা ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের উপরাষ্ট্রপতি অধ্যাপক সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ তাজউদ্দীন আহমদ, অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান। তাঁরা চারজনই আমরণ বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত বিশ্বস্ত ছিলেন। এটি সহজেই বোঝা যায় যে, তাঁরা যদি সেদিন বঙ্গবন্ধু কিংবা দেশ ও জাতির সঙ্গে বেইমানি করতেন, তাহলে তাঁরাও ইতিহাসের খলনায়ক ও মীরজাফর খন্দকার মোস্তাক আহমদের মতোই পুরস্কৃত হতে পারতেন। কিন্তু দেশ ও জাতির স্বার্থে জীবন গেলেও তা তাঁরা সেদিন করেননি। ফলস্বরূপ ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের কলঙ্কজনক নির্মম ঘটনার পরবর্তীতে তাঁরা কারাবন্দি হন এবং কারাগারেও তাঁরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতিই আস্থা প্রকাশ করার অপরাধে ওই বছরের ৩ নভেম্বর কারাগারের অভ্যন্তরেই আরেক ন্যক্কারজনক ঘটনার শিকার হয়ে তাঁদের জীবন দিতে হলো। সে জন্যই দেশ ও জাতি তাঁদের স্মরণ রেখেছে। জাতীয় বীর এ চার নেতার মধ্যে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকার কারণে তাঁরই নির্দেশে তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে পুরো নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে স্বাধীন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সে কারণে বলা যায় এবং অভিজ্ঞমহল তাই মনে করেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর পরপরই সৈয়দ নজরুল ইসলামের অবদান, তা বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না। এ জাতীয় চার নেতারই সুযোগ্য সন্তান হিসেবে আজ দেশের কল্যাণে নিবেদিত হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদের ছেলে হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন তানজিম আহমদ সোহেল তাজ, সাবেক এমপি ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যিনি একপ্রকার কিছুটা মনের কষ্ট নিয়ে দেশ থেকে চলে যাওয়ার পর তাঁরই বড় বোন সিমিন হোসেন রিমি এখন একজন এমপি, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর ছেলে মোহাম্মদ নাসিম যিনি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং তিনি আওয়ামী লীগের অন্যতম একজন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, এ এইচ এম কামরুজ্জামানের ছেলে জনাব এএইচএম খাইরুজ্জামান লিটন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একজন অন্যতম কেন্দ্রীয় নেতা এবং যিনি রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ছিলেন। এঁরা শুধু তাঁদের বাবার গুণেই যে নেতা হয়েছেন তা কিন্তু নয়, বরং তাঁরা স্ব-মহিমায় ও যোগ্যতায় আজ দেশ পরিচালনা ও দলের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন।
লেখক: ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ