অধ্যাপক ড. গোলাম রহমান
অধ্যাপক ড. গোলাম রহমান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষক। সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার। ছিলেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রো-ভিসি। খোলা কাগজের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডসহ তৎকালীন পরিস্থিতির কথা শুনেছেন তুষার রায়
খোলা কাগজ : বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দুর্ঘটনা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা। এ ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষাপট কীভাবে তৈরি হয়েছিল?
ড. গোলাম রহমান : জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা একটি সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের অংশ। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে ঘাতকরা। এটা শুধু ব্যক্তিগত আক্রোশ ছিল না বরং এটা ছিল দেশি-বিদেশি শক্তির একটি যৌথ চক্রান্ত।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীরা থামেনি। তারা বিভিন্ন চক্রান্ত করে গিয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি সদ্য স্বাধীন দেশ গতে তুলতে বঙ্গবন্ধু অকল্পনীয় উদ্যোগ হাতে নিয়েছিলেন। একের পর পড়া বিভিন্ন সেক্টর পুনঃগঠন করছিলেন। ধ্বংস হয়ে যাওয়া অবকাঠামোর উন্নয়ন, শিল্পের পুনঃরুজীবিত করা, কর্মসংস্থান, বৈদেশিক সম্পর্ক স্থাপন, প্রশাসনে শৃঙ্খলা আনাসহ সব ক্ষেত্রে একটি গতি আনতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। রাজনৈতিকভাবেও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছিল।
এভাবে যখন দেশ মাথা তুলতে শুরু করেছে তখন মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দেশি-বিদেশি শক্তি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ছক কষতে থাকে। ঠিক ওই সময়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বে কিছু পরিবর্তন শুরু হয়।
ওই সময়ে পশ্চিমা বিশ্বে ধনতান্ত্রিক বিকাশের প্রচারণা শুরু হয়। পশ্চিমারা এ মডেল সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠা করতে জোর কদমে এগোতে থাকে। আর সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে অধনতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক বিকাশের চেষ্টা অব্যাহত অগ্রগতিতে এগিয়ে চলছিল। এ মডেলে বাংলাদেশে উন্নয়নও হচ্ছিল জোর গতিতে।
বঙ্গবন্ধুর এ মডেল সারা বিশ্বের প্রশংসা পায়। এবং ধীরে ধীরে তিনি সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের নেতা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এ অধনতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের মডেল স্বভাবতই পশ্চিমারা পছন্দ করেনি।
বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বিরোধিতাকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ মডেল পছন্দ করেনি। এরপর থেকেই জাতির জনককে হত্যার চেষ্টা জোরদার হয়। ফলে বলা যায় শুধু একক কোনো কারণে তাকে হত্যার করা হয়নি। বিশ্ব রাজনীতিও এর সঙ্গে জড়িত ছিল। বঙ্গবন্ধুর ক্যারিশমাটিক প্রভাবের বিষয়ে ঘাতক-ষড়যন্ত্রকারীরা এত ভীত ছিল যে তাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। যাতে তার কোনো উত্তরসূরি কখনো বাংলাদেশের নেতৃত্বে না আসতে পারে।
বাকশাল নিয়ে বিভিন্ন নেতিবাচক সমালোচনা রয়েছে। এ বিষয়ে কিছু বলবেন?
রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের তৎকালীন নেতারা বাকশাল নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার প্রতিষ্ঠিত বাকশালের উদ্দেশ্য ছিল সব রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম তৈরি করা। যেখানে সবাই নির্বাচনে অংশ নেবে। জনসমর্থন অনুপাতে দেশ পরিচালনার কর্মকাণ্ডে অংশ নেবে। বাকশালের ধারণা জনমনে প্রতিষ্ঠা পাওয়া বা জনগণ বুঝতে পারার আগেই এটা নিয়ে নানা প্রপাগান্ডা শুরু হয়ে যায়।
তা ছাড়া যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে রাজনৈতিক বিষয় ছাড়াও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা ছিল। নানা সংকটের মধ্যে জেরবার শেখ মুজিব যথেষ্ট সময় পাননি বাকশালের সুফল জনগণের হাতে তুলে দেওয়ার।
জাতির জনকের সোনার বাংলা কতটা প্রতিষ্ঠা পেল?
১৯৭৫ সালে জাতির জনককে হত্যার পর ২১ বছর দেশে গণতান্ত্রিক চর্চা ছিল না। এ দীর্ঘ সময়ে মুক্তিযুদ্ধকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। যুক্তিযুদ্ধের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে।
তখন তো বঙ্গবন্ধুর নামও উচ্চারণ করা যেত না। পত্র-পত্রিকা, বইপত্র থেকে জাতির জনকের নাম মুছে ফেলার চেষ্টা চলেছে। ফলে বঙ্গবন্ধু-উত্তর স্বপ্নের সোনার বাংলা থমকে ছিল ওই সময়।
আসলে সোনার বাংলা তো তিনি রূপক অর্থে বুঝিয়েছেন। তার চাওয়া ছিল বাংলাদেশের মানুষ পেট ভরে খেতে পারবে, পরতে পারবে, মতপ্রকাশের অধিকার পাবে। দীর্ষ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ আবার হারানো পথ ফিরে পায়। একটু একটু করে মূলধারায় ফিরতে থাকে হারিয়ে যাওয়া গণতন্ত্র, উন্নয়ন, মানুষের অধিকার ইত্যাদি। আজ বাংলাদেশ সত্যিকারের সোনার বাংলার পথে অগ্রসর হচ্ছে শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে। কন্যার হাত ধরেই পিতার স্বপ্ন সত্য হচ্ছে। আজ বাংলাদেশ ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপ নিয়েছে। সব ক্ষেত্রে দেশ দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে। দেশে আজ ১৩ কোটি মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে, আট কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছে, ফেসবুক ইউজ করছে তিন কোটি ৮০ লাখ মানুষ।
বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। আজ ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে গেছে। দেশজুড়ে বিশাল বিশাল অবকাঠামো তৈরির কাজ চলছে। গত কয়েক বছরে বাজেটের আকার বিপুল পরিসরে বেড়েছে। এসব চোখ ধাঁধানো উন্নয়ন সারা বিশ্বে সমাদৃত ও প্রশংসিত হচ্ছে। বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার পথে এগিয়ে চলেছে।
উন্নয়নের পাশাপাশি কিছু কিছু সমস্যা ও সংকট তো রয়েছে। এ বিষয়ে কি বলবেন?
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমরা কিছু সমস্যার মধ্য দিয়েও যাচ্ছি। আমাদের বড় একটা সমস্যা দুর্নীতি। এটা এখনো সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে রয়েছে। দুর্নীতির দুষ্ট ক্ষতের কারণে আমাদের কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি ব্যহত হচ্ছে। উন্নয়ন প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু এটা রোধ করার জন্য আরো প্রচেষ্টা দরকার। যেটা দেখা যাচ্ছে না। এ ছাড়া আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দুর্বলতা রয়েছে। গণতান্ত্রিক চর্চা আরো বাড়ানো দরকার। গণতান্ত্রিক চর্চা ব্যাহত হলে সার্বিক অগ্রগতিও ব্যাহত হয়। এ ছাড়া মানবাধিকারের প্রশ্নে আরো কাজ করার সুযোগ রয়েছে। এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ দারুণ অগ্রগতি অর্জনের পথে রয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ ও বর্তমান আওয়ামী লীগের মধ্যে গুণগত, মাত্রাগত, ও পদ্ধতিগত কোনো পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় আপনার দৃষ্টিতে?
সেই সময়ের আওয়ামী লীগ ছিল দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল। তখন দেশ ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিরন্তন সংগ্রাম করে গেছে আওয়ামী লীগ। তখন এত সব ব্যক্তি, লাভ-লোকসান, চাওয়া-পাওয়ার বিষয় নেতাদের মধ্যে কাজ করত না। তখন মুখ্য বিষয় ছিল জনগণের কল্যাণ কতটা নিশ্চিত হলো। বর্তমান আওয়ামী লীগে সেই মানসিকতার নেতার সংখ্যা কমেছে। এখন রাজনীতি চলছে নিজের স্বার্থের জন্য। নিজের কতটা উন্নতি হলো, লাভ হলো তার ওপর লক্ষ্য রেখে নেতারা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন। এখন রাজনীতি অনেকটা ব্যবসার হাতিয়ার। এ গুণগত তারতম্যটা চোখে পড়ে। তবে ব্যতিক্রমও আছে। সবাই যে নিজ স্বার্থে আওয়ামী লীগ করে তাও না। দেশপ্রেমিক আওয়ামী লীগার এখনো রয়েছে। তবে সংখ্যায় কম।
অনেক ঘাতক এখনো বিদেশে লুকিয়ে রয়েছে, এ বিষয়ে সরকারের তৎপরতা কি যথেষ্ট?
জাতির পিতার খুনিদের বিচার শেখ হাসিনা সরকার করেছে। তবে এখনো অনেক খুনি বিদেশের মাটিতে রয়েছে।
এখানে লক্ষ্যণীয়, যেসব দেশে খুনিরা লুকিয়ে আছে তাদের মধ্যে অনেক দেশই আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি বিরোধিতা করেছে। সেসব দেশের অনুগ্রহেই মূলত এসব খুনিরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। সংশ্লিষ্ট অনেক দেশের সঙ্গে আমাদের বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি নেই। এসব ক্ষেত্রে কূটনৈতিক তৎপরতা আরো বাড়াতে হবে। তবে এদের ধরার জন্য সরকারের তৎপরতা আরো বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে বাংলাদেশের পাশাপাশি ওইসব দেশে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করতে হবে।
খোলা কাগজ : আপনাকে ধন্যবাদ।
ড. গোলাম রহমান : খোলা কাগজকেও ধন্যবাদ।