১৫ আগস্টের পর পত্রিকার পাতা থেকে হারিয়ে যান বঙ্গবন্ধু


মো. নুর হোসেন ইমন

১৫ আগস্ট ১৯৭৫! একটি রাত। যার কোন দিন হয় না।  ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে কতিপয় বিপথগামী সেনা সদস্য ও দেশদ্রোহীর হীন ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে জীবন দিতে হয় মুক্তিসংগ্রামের মহান নেতা বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

সেদিন ঘাতকরা শুধুই বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, হত্যা করেছে আরও দুটি বিষয়কে। আর তা হলো বাংলাদেশ আর এদেশের স্বাধীনতাকে। এই হত্যাকাণ্ড নিছক কোনও হত্যাকাণ্ড ছিল না। ছিল একাত্তরে পরাজিত শক্তির আরেকটি প্রতিশোধ পর্ব। দেশি এবং বিদেশি শক্তি যারা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত হয়েছে, আন্তর্জাতিকভাবে যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে স্বাধীনতাবিরোধীদের সাহায্য করেছে, তারা সেদিন যৌথভাবে ষড়যন্ত্র করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে। যাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ধ্বংস হয়ে যায়। বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা মুছে যায়। ওইদিনই এ ঘটনাটি ঘটবে এবং শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করা হবে এইভাবে হয়তো অনেকে চিন্তা করেননি। তেমন চিন্তার কোনও অবকাশও ছিল না। কিন্তু পরিবর্তন একটা হবে সেটা অনেকেই মনে মনে ভাবছিলেন। আপনি যদি পরের দিনের পত্রিকার সম্পাদকীয় দেখেন, সবাই সেটাকে স্বাগত জানিয়েছিল। সুতরাং এই হত্যাকাণ্ড হুট করে কয়েকজন মেজর এবং কিছু সোলজার মিলে করেছে সেটা মনে করা পুরোপুরি ঠিক নয়। এর পেছনে ছিল সুপরিকল্পিত আয়োজন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ছিল একাত্তরের পরাজিত শক্তির করা প্রতিবিপ্লব। দীর্ঘদিন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডকে অাকস্মাৎ প্রতিহিংসামূলক ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এদেশের বেশ কিছু বামপন্থী বুদ্ধিজীবী এমনকি বঙ্গবন্ধুর দলীয় কিছু নেতা ওই হত্যাকাণ্ডকে প্রতিবিপ্লব বলে অভিহিত করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছেন। তাদের মতে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ কোনো বিপ্লব ছিল না। ওটা ছিল একটা স্বাধীনতা যুুদ্ধ। তাদের মতে বিপ্লবই যখন হয়নি, তখন প্রতিবিপ্লব হওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। খুনিরা, হত্যার পরপরই জাতীয় প্রচার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে একজন দুর্নীতিবাজ, অযোগ্য, ক্ষমতালোভী ও স্বেচ্ছাচারী শাসক বলে ঘোষণা দিয়েছিল, পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়েছে যে, তাদের বক্তব্য সত্যের চরম অপলাপ মাত্র।

১৯৭৫ সালের আগস্টের পর সবকিছু থেকেই হারিয়ে যেতে থাকেন বাংলাদেশের এই অবিসংবাদিত নেতা। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরের বছরগুলোয় বদলে ফেলা হয়, বাংলাদেশের ইতিহাস। এমন কী ১৯৭৬ সালের ৭ মার্চের পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর কোনও ছবি ছিল না। ছিল না সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মুক্তিযুদ্ধের ডাক দেওয়া সেই ঐতিহাসিক ভাষণের কোনও চিহ্নও। ১৫ আগস্টের পর থেকে প্রায় দুই দশক দেশে প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সেখানে বঙ্গবন্ধুর অবদান বা আওয়ামী লীগের সম্পৃক্ততা নিয়ে কোনও আলোচনা নেই।

১৯৭৬ সালের ৭ মার্চ। পত্রিকার পাতায় নেই বঙ্গবন্ধুর কোনও ছবি, নেই ৭ মার্চ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মুক্তিযুদ্ধের ডাক দেওয়া সেই ভাষণের কোনও উল্লেখ। অথচ ১৯৭৫ সালের পত্রিকাতে ছিল ইতিহাসের ৭ মার্চ। দৈনিক বাংলা প্রথম পাতা, শেষের পাতায় বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছে সংবাদ। ‘৭ মার্চ: বাংলাদেশ কাঁপানো একদিন’। পত্রিকাটি ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর দিনটিতে বিশেষ বক্স প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ‘স্বাধানতার ডাক মুক্তি ডাক’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে ১৯৭২ সালের ৭ মার্চ। সেইদিনের পত্রিকাজুড়ে ছিল মুক্তির ডাকের ইতিহাস

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর পত্রিকা থেকে আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে থাকেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭৫ এর ১৭ আগস্ট সব পত্রিকাতে মোশতাকের জীবনালেখ্য এবং সৌদি আরব ও সুদানের স্বীকৃতির সংবাদ প্রকাশ করা হয়।মোস্তাকের  জীবনীতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের সবিস্তার বর্ণনা রয়েছে। ভারতীয় মুখপাত্র বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে অভিহিত করে। কারফিউ ধীরে ধীরে শিথিল করা হয়। মন্ত্রিসভার বৈঠকে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি সন্তোষজনক বলে আলোচিত হয়। সাবেক রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর মরদেহ পূর্ণ মর্যাদায় দাফন করা হয় টুঙ্গিপাড়ায়। কোনো পত্রিকাই এই সংবাদটিকে গুরুত্ব দিয়ে ছাপায়নি। দেশে যেমন জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অভিনন্দন তেমনি নতুন সরকারের প্রতি লন্ডন প্রবাসী বাঙালিদের সমর্থন জানা যায়। নতুন সরকারের প্রতি মওলানা ভাসানী পূর্ণ সমর্থন জানান। ১৮ আগস্ট তর্কবাগীশ অভিনন্দন জানান সরকারকে। ১৪ আগস্ট ও তার আগের প্রামাণ্যচিত্র ও সংবাদচিত্র প্রত্যাহার করে সরকার। মোশতাকের প্রশংসা করে দৈনিক বাংলার সম্পাদকীয়তে বলা হয় 'বলিষ্ঠ, বিচক্ষণ বৈদেশিক নীতি; দুর্নীতির সঙ্গে আপোস নেই।' ইত্তেফাকও 'সবার প্রতি বন্ধুত্ব' শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। পরদিন সম্পাদকীয় ছিল 'স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা এবং সৌদি আরবের স্বীকৃতি। ১৮ তারিখে দৈনিক বাংলা 'মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা' শিরোনামে মোশতাকের ভাষণকে অবলম্বন করে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে।

১৯৭১ এ বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তান কারাগারে আটক ছিলেন, তার বিচার হয়েছিল এবং দাফনের জন্য কবর পর্যন্ত খুঁড়ে রাখা হয়েছিল। ইচ্ছা করলে তখন তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারত। তা না করে বাংলাদেশে ফিরে এসে সংবিধান প্রণয়ন করে, সেই সংবিধানভিত্তিক নির্বাচন করে বঙ্গবন্ধু যখন তিন বছর সংসদীয় গণতান্ত্রিক ধারায় বাংলাদেশের শাসনকার্য পরিচালনা করলেন এবং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সুসংহত করে ও দেশকে দ্রুত উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে নেয়ার জন্য দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করলেন, ঠিক তখনই তাকে হত্যা করা হলো। আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তকারীদের ধারণা ছিল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাবশীর্ষ শেখ মুজিবুর রহমান কখনো পুঁজিবাদী ধারা পরিবর্জন রেডিক্যালাইজেশনের দিকে যাবেন না। তাই তারা যখন দেখল সমাজতন্ত্রকে বঙ্গবন্ধু জাতীয় মৌলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে দ্রুত উন্নয়নের পথে অগ্রসরহওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং তার ওই সিদ্ধান্ত সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের প্রতিকূল হওয়ায় ও দক্ষিণ এশিয়ার সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশ সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব বলয়ের বাহিরে চলে যাচ্ছে এমন সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে, তখনই তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে।

তিনদিন পরে ১৮ ও ১৯ তারিখের সংবাদে বহির্বিশ্বের স্বীকৃতি ও নিরবচ্ছিন্ন জীবনযাত্রা মূল ফোকাস ছিল। ১৯ আগস্ট দৈনিক ইত্তেফাকের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ হচ্ছে, ব্রিটেনের সানডে টাইমসে এন্টনি ম্যাসকারেনহেসের রিপোর্ট অনুসারে বঙ্গবন্ধু সরকারের পতনের তিনটি কারণ হলো- সামরিক বাহিনীর প্রতি বঙ্গবন্ধুর অবিশ্বাস, ইসলামের অবনয়ন এবং জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া। এ তিনটি কারণই ছিল অসত্য। কারণ বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সেই সময় দেশের অর্থনৈতিক মুক্তির পথ অন্বেষণ করে বাকশালের কর্মকাণ্ডকে বেগবান করে তোলার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত ছিলেন। আর ইসলামের প্রতি তাঁর ঐকান্তিক নিষ্ঠার কথা সম্প্রতি প্রকাশিত 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' থেকে আরো স্পষ্টভাবে জানা যায়।

২১ আগস্ট রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণ করার খবর প্রকাশিত হয়। সংবিধানের আংশিক সংশোধনের পরেও পার্লামেন্ট অব্যাহত থাকে। রাষ্ট্রীয় মূলনীতি অপরিবর্তিত রাখা হয়। '৭২ সালের সংবিধানের রাষ্ট্রপতির ৯নং আদেশ বাতিল করা হয়। (২৩ আগস্ট, ইত্তেফাক) এর আগেই নতুন সরকার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্রের মারফতে প্রতিশ্রুতি পায় ব্যাপক মার্কিন সাহায্য অব্যাহত থাকবে বলে। খাদ্যশস্য নিয়ে ১৯টি জাহাজ বন্দরে ভিড়ে। ২২ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পায় মোশতাক। অথচ '৭৪-এর দুর্ভিক্ষের সময় বঙ্গবন্ধু সরকারের সঙ্গে মার্কিনিদের বিরূপ আচরণ করেছিলেন।

৩ নভেম্বর ঢাকার জেলখানার মধ্যে জাতীয় চার নেতাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। সেই ঘটনার সূচনা ২৩ আগস্ট থেকে। অর্থাৎ ২৪ তারিখে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ প্রকাশিত হয় দৈনিক ইত্তেফাকে। দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে সাবেক উপ-রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ ২৬ জন গ্রেফতার হন। জাতীয় চার নেতা মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামরুজ্জামানসহ আওয়ামী লীগের অনেক সিনিয়র নেতৃবৃন্দ বন্দি হন। একই তারিখের পত্রিকা থেকে জানা যাচ্ছে, রাষ্ট্রপতির সামরিক আইন বিধি অনুসারে সামরিক আদালত গঠনের ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। বলা হয়- 'বেআইনি অস্ত্র অবৈধ সম্পত্তি ও দুর্নীতির সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদন্ড।'  ৩১ আগস্ট  'রাজনৈতিক দল ও কার্যকলাপ নিষিদ্ধ' করে সরকার। ব্রিটিশ পত্রিকা ফিন্যান্সিয়াল টাইমস ১৬ আগস্ট লিখেছে- দারিদ্র্য, হিংসাদ্বেষ, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি প্রভৃতি গুরুতর সমস্যার সমাধানে ব্যর্থতার জন্য সাবেক প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু নিজেই বহুল পরিমাণে দায়ী। এর আগে ৩০ আগস্ট দি টেলিগ্রাফের বরাত দিয়ে মুজিবের পতন সম্পর্কে বলা হয়- শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে বিগড়ে দিয়েছিলেন তিনি; যারা তাঁকে একসময় নেতা বানিয়েছিল। ১৫ থেকে ২৫ তারিখের মধ্যে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের নয়া অধ্যায় সূচনার খবর এলো ২৬ আগস্টের পত্রিকায়।সব কিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী হচ্ছিল আর চালানো হচ্ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে মুছে পেলার অপচেষ্টা।কিন্তু ইতিহাস তার নিয়মে চলবে। তার অনন্য উদাহরণ আজ। যেখানে ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর নাম, জয় বাংলা উচ্চারণ করা যেত না রাষ্ট্রীয় কোনও গণমাধ্যমে, সেখানে আজ সবজায়গায় বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠিত সত্য। তার সুযোগ্য কন্যার নেতৃত্বে তিনি আজ ইতিহাসে আবার প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। দুলিস্যাৎ হয়ে গেছে ষড়যন্ত্রকারীদের সকল ষড়যন্ত্র।

SUMMARY

1477-1.png