বঙ্গবন্ধু বিশ্ব ইতিহাসের মহানায়ক


আর কে চৌধুরী
একাত্তরের পরাজিত শক্তির সুগভীর ষড়যন্ত্রে প্রাণ হারাতে হয় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতিকে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে প্রকারান্তরে খুনিচক্র বাঙালি জাতির আত্মাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। মুয়াবিয়াপুত্র ইয়াজিদের হাতে হজরত ইমাম হোসেন (রা.) ও মীরজাফরের ষড়যন্ত্রে নবাব সিরাজউদ্দৌলার হত্যাকা-ের পর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের একটি মর্মান্তিক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত।

এ ঘটনার মাধ্যমে হত্যা ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি জাতির ঘাড়ে চেপে বসে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম মহানায়ক। সেরা মুক্তি সংগ্রামী, সেরা রাষ্ট্রনায়ক। জননন্দিত নেতা হিসেবে তার তুলনা ছিলেন তিনি নিজেই। দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা ও দায়বোধ তাকে মহীরূহে পরিণত করেছিল। ব্যক্তি শেখ মুজিব হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু। বাঙালি জাতি, বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং অস্তিত্বের শত্রুরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে প্রকারান্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকেই হত্যা করতে চেয়েছিল।

১৫ আগস্টের ঘটনা জাতীয় রাজনীতিতে অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা পরিবর্তনের যে কালো অধ্যায়ের সূচনা করে তার পরিণতিতে বারবার বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে যে সাম্প্রদায়িকতা ও দ্বিজাতিতত্ত্বের বিভেদ নীতিকে বাংলাদেশের মানুষ কবর দিয়েছিল, তা পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রয়াস চলে ১৫ আগস্টের পর থেকে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধে কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়। বাংলাদেশের মানুষ খুনিচক্র এবং তাদের দোসরদের সে ষড়যন্ত্র সফল হতে দেয়নি। ১৯৯৬ সালে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল হয় দেশবাসীর প্রত্যাশার পরিপূরক হিসেবে। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার এবং খুনিদের পাঁচজনের মৃত্যুদ- কার্যকর হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ৪১ বছর আগে প্রাণ হারিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির এজেন্টদের হাতে। এ বছর আমরা এমন এক সময় জাতীয় শোক দিবস পালন করছি যখন দেশে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার চলছে। আমাদের বিশ্বাস, এ বিচার সম্পন্ন করা এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চির অবসান ঘটিয়ে বঙ্গবন্ধুর খুনি ও তার সহযোগীদের পুনরুত্থানের পথ রোধ করা হবে। ৪১তম শাহাদাতবার্ষিকীতে জাতির পিতার অমর স্মৃতির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও অভিবাদন।

বঙ্গবন্ধুর সময়ে আমি ছিলাম ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ। নগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম কেমন চলছে? কিভাবে করলে ভালো হবে? কোথায় কি সমস্যা আছে? সেসব বিষয় নিয়ে আমরা (তৎকালীন নগর সভাপতি গাজী গোলাম মোস্তফা, সাধারণ সম্পাদক সুলতান, কোষাধ্যক্ষ আমি আর কে চৌধুরীসহ অনেকে) নিয়মিত সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করতাম। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট সন্ধ্যার পর আমরা বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়িতে তার সঙ্গে বসি। আলোচনা হয় দীর্ঘসময় ধরে। পূর্বের ন্যায় বঙ্গবন্ধুর মধ্যে সেদিনও ছিল খুব প্রাণচাঞ্চলতা। বঙ্গবন্ধুর কখনই ভাবেনি তার করা স্বাধীন বাংলাদেশে এমন কিছু ঘটবে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর ঘাতকরা তার ঘনিষ্ঠজনদের ওপর নির্যাতন চালায়। আমাকে হত্যা করার জন্য কয়েকবার আমার বাড়িতে আক্রমণ চালায়। তাদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে আমাকে ৬ মাস আত্মগোপনে থাকতে হয়।

বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে যদি লিখতে হয় তবে সর্বপ্রথম লিখতে হবে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক নেতা, পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পুরোধা এবং বাংলাদেশের জাতির জনক। জনসাধারণের কাছে তিনি শেখ মুজিব নামে বেশি পরিচিত এবং তার উপাধি হচ্ছে বঙ্গবন্ধু। আগস্ট মানেই জাতির বেদনা বিধুর শোকের মাস, এক রক্তক্ষয়ী অধ্যায়ের নাম। স্বাধীন বাংলাদেশে এ মাসে নেমে আসে বাঙালি জাতির ওপর এক কালো থাবা। বাঙালির ইতিহাসে কলঙ্কিত এক অধ্যায় সূচিত হয়েছে আগস্ট মাসেই। ইতিহাসের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে বাঙালি জাতি পিতৃ হত্যার বিচারের রায় কার্যকরের মাধ্যমে কলঙ্কমুক্ত হলেও আমাদের প্রতিটি শিরা-উপশিরা ও ধমনীতে ঘাতকদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণার উদ্রেক করে এ মাস।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা এবং স্বাধীনতার চেতনাকে মুছে ফেলার অপচেষ্টায় এক কালো অধ্যায়ের সূচনা করে অপরিণামদর্শী ঘাতকরা। অকৃতজ্ঞ ঘাতকরা ১৫ আগস্ট কালোরাতে শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, ঘৃণ্য নরপশুরা একে একে হত্যা করেছে বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশুপুত্র শেখ রাসেলসহ পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামালকে। জঘন্যতম এই হত্যাকা- থেকে বাঁচতে পারেনি বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, ভগি্নপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, ভাগ্নে যুবনেতা ও সাংবাদিক শেখ ফজলুল হক মণি, কর্নেল জামিলসহ ১৬ জন সদস্য ও আত্মীয় স্বজনকে।

১৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে নির্মম ও কলঙ্কজনক অধ্যায়ের দিন। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট যা ঘটেছিল তা মানব ইতিহাসের ঘৃণ্যতম অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। সর্বোপরি গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের প্রতি এ ঘটনা ছিল ভয়ঙ্কর কুঠারাঘাত।

আর কে চৌধুরী : লেখক।

SUMMARY

1474-1.png