আমরা কেউ ইতিহাসের ছাত্র, কেউ শিক্ষক, কেউ একটি পাতা, কেউ একটি অধ্যায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু নিজেই এক ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস, স্বাধীনতার ইতিহাস, ইতিহাসের এক কিংবদন্তি। ইতিহাসের এই কিংবদন্তিকে হত্যা করে যারা বদলে দিতে চেয়েছিল ইতিহাসের ধারা, তারা জানে না হত্যা করেই থামানো যায় না ইতিহাসের পথ চলা।
আমি কারবালা দেখিনি, এজিদকে দেখিনি, পড়িনি বিষাদ সিন্ধু, আমি দেখেছি জাতির জনকের বুক থেকে ঝরে যাওয়া শেষ রক্ত বিন্দু। আমি সীমারকে দেখিনি, দেখিনি তার পাষÐ বুক। আমি দেখেছি রক্তের স্রোতে ভাসা জাতির জনকের মুখ। আমি দেখিনি সীমারের খঞ্জর, দেখেছি মানুষ নামের কিছু ববর্র। আমি দেখিনি মীরজাফর, দেখিনি পলাশীর প্রান্তর। দেখেছি ধানমÐির বত্রিশ নম্বর। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট, জাতির দীপ্তকণ্ঠের প্রতিনিধি, শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলার স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে ধানমÐির ৩২ নাম্বারে, ঘাতকরা নিমর্মভাবে হত্যা করে। যে শোকে আজও ইতিহাস কঁাদে। সেই রক্তে রাঙ্গা দুঃখের কাহিনী বলতে গেলে অশ্রæ ঝরে ইতিহাসের বালুচরে। ইতিহাস কেঁদে কেঁদে কয়, এ শোক চোখের জলে মুছে যাবার নয়।
১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির জীবনে ভয়াবহ এক শোকের দিন। যে শোক ভোলা যাবে না কোনো দিন। স্মৃতির পাতায় ভুলিনি সবাই, সেই দিন কি ঘটেছিল এই সোনার বাংলায়। ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের ভোরে, গভীর শোকে কেঁদে উঠেছিল বাংলাদেশ, যে কান্নার আজও হয়নিতো শেষ। বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে সেদিন বাংলার মানুষকে কঁাদতে দেখেছি। দু’চোখ ঢেকে যেমন কঁাদে রাতের বেদনায় পরাজিত পৃথিবী। পদ্মা মেঘনা যমুনার পানি, সেদিন শোকে থেমে গিয়েছিল জানি। অসহায় বিবেকের আগুনে পুড়ে আমি, পথের পাতায় লিখে যাই সেই বিষাদের বাণী।
সংঘাতময় এ পৃথিবীতে, আবহমান কাল ধরে চলে আসছে, ন্যায়-অন্যায়ের সংঘাত, সুন্দর-অসুন্দরের সংঘাত, ঘৃণা-ভালোবাসা, শান্তি-অশান্তি, অসুর আর মানবতার সংঘাত। নিরবচ্ছিন্ন সূত্র পরম্পরায় চলে আসা ইতিহাসের আমোঘ ধারায়, ন্যায় এবং সত্যকে বারবার মোকাবেলা করতে হয়েছে অন্যায়-অসত্যকে, ভেতর বাহিরের কুটিল ষড়ষন্ত্রকে। এ সংঘাতের মোকাবেলায় কত মহাপুরুষের রক্তে ভিজে গেছে পৃথিবীর বুক, সৃষ্টি হয়েছে ইতিহাসের ভয়াবহ সংকট, বিপন্ন হয়েছে মানবতা তার ইয়ত্তা নেই।
আততায়ীর হাতে মহাপুরুষের মৃত্যুবরণ যেমন সংঘাতের এক অনিবাযর্ ঘটনা তেমনি প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে দেশ প্রেমিক রাষ্ট্রনায়ক ক্ষমতাচ্যুত ও নিহত হওয়ার ঘটনা ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। ইসলামের মহান চার খলিফার তিনজনই যেমন শহীদ হয়েছেন আততায়ীর হাতে তেমনি এ গুপ্ত হত্যার তালিকায় ছিলেন ক্রুসেড বিজয়ী বীর সেনানী সালাহউদ্দিন আয়ুবী ও ইমাম ইবনে তায় মিয়ার মতো মনীষীও। এজিদের নৃশংসতায় কারবালা প্রান্তরে সংঘটিত মমাির্ন্তক হৃদয়বিদারক ঘটনার বেদনাদায়ক চিত্র আজও ইতিহাসের পাতায় অংকিত। শহীদ হয়েছেন ইমাম হাসান, ইমাম হোসেনসহ মহানবী (সা.)-এর অসংখ্য অনুসারী। কারবালা প্রান্তরে এজিদের নৃশংসতা ও ববর্বতার শিকার নারী পুরুষের আতর্নাদ, বিষাদের ছায়া আর শহীদের বিন্দু বিন্দু রক্তে রচিত হয়েছে বিষাদসিন্দু।
বিষপানে হত্যা করা হয়েছে সক্রেটিসকে, ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে যীশু খ্রিষ্টকে। এ সংঘাতের কারণেই জীবন প্রদীপ নিভে গেছে রোমের সিজার, জায়ারের লুবাম্বা, গ্রানাডার মরিস বিশপ, চিলির আলেন্দেসহ অসংখ্য মহাপুরুষের। আততায়ীর বুলেটের নিমর্ম আঘাতে জীবন দিতে হয়েছে এ উপমহাদেশের মহাত্মাগান্ধী, লিয়াকত আলী খান, ইন্দিরা গান্ধীসহ বিশ্বের জনপ্রিয় রাষ্ট্রনায়ক আব্রাহাম লিংকন, জন, এফ, কেনেডির মতো মহান নেতাকে। স্বাধীনতা ও সাবের্ভৗমত্ব রক্ষায় টিপু সুলতানের বীরত্ব ও দেশপ্রেম ব্যথর্ হয়েছে, তাকে জীবন দিতে হয়েছে শুধু এদেশের আলো, বাতাস, অন্নে পুষ্ট কতিপয় বিশ্বাসঘাতক মোনাফেকদের ষড়যন্ত্রের কারণে।
মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় যেমন বাংলার শেষ সূযর্ অস্তমিত হয়েছে পলাশী প্রান্তরে তেমনি জীবন দিতে হয়েছে বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে মীরনের আদেশে মোহাম্মদী বেগের হাতে। ন্যায় অন্যায়ের এ সংঘাতের কারণেই মনসুর হেযাজের মতো সত্যবাদী ধামির্ককেও কতল করা হয়েছে। মনসুর হেযাজ অন্যায়, অসত্যের সাথে কখনও আপেষ করেননি, সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন মৃত্যুর আগ পযর্ন্ত। তাই তার দ্বিখÐিত মাথা তখনও বলেছে ‘আনাল হক’ অথার্ৎ আমিই সত্য। এসব হত্যাকাÐ যেমন নিছক হত্যাকাÐ নয়, সংঘাতের অশুভ পরিনতি তেমনি জনপ্রিয় রাষ্ট্রনায়ককে হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতাদখলও কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট, শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালি জাতীয়তাবাদের অগ্রদূত, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা আবহমান কাল ধরে চলে আসা ন্যায়-অন্যায়ের সংঘাত থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, দীঘির্দনের পরিকল্পিত এবং ছক বাধা এক প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের বাস্তবায়ন।
’৭৫-এর ১৫ আগস্ট, অন্ধকারের পেট চিড়ে যখন বেরিয়ে আসে সোনালি ভোর, কিচির মিচির শব্দ করে রাত জাগা পাখিগুলো ঘোষণা করছে রাতের শেষ প্রহর, মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে ভেসে আসছে ফজরের আযানের সুমধুর ধ্বনি তখন ধানমÐির ৩২ নাম্বারে ঘটে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায়। মীরজাফরের রক্তের কনিকা বহনকারী কিছু উচ্চবিলাসী, বিপথগামী ও উচ্ছৃঙ্খল সেনা সদস্য স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারদের সহায়তায় অত্যন্ত নৃশংসভাবে হত্যা করে সময়ের নিভীর্ক পুরুষ, জাতির দৃপ্তকণ্ঠের প্রতিনিধি, শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি, মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, বাংলার স্থপতি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানকে। পবিত্র জুমার দিন, ফজরের নামাজের সময় মীরজাফরের দল হত্যা করল একজন শ্রেষ্ঠ মানবকে, একজন উদারচিত্তের মানবতাবাদী মহৎ মানুষকে, সবোর্পরি একজন মুসলমানকে। অসুরের হাতে বলি হলো একজন পবিত্র মানুষ। মানুষের রক্তে আবারও ভিজে গেল পৃথিবীর বুক। বাঙালি জাতি হারাল তাদের জাতির জনককে, বিশ্ব হারাল এক মহান নেতাকে।
এই নৃশংস হত্যাকাÐ ও বিভীষিকার ভয়াবহতা বুঝবার ভাষা নেই। পৃথিবীর সব ভাষার সব শব্দ উজাড় করে দিয়েও এই ববর্রতার চিত্র তুলে ধরা যাবে না। শুধু এইটুকু বলা চলে ছয়শত বছর পর বাংলার সবুজ প্রান্তরে কবর থেকে যেন উঠে এসেছিল তৈমুরের প্রেতাত্মা কিংবা তেরশ বছরের আগের এজিদের বংশধররা। ’ ৭৫ এর ১৫্ আগষ্ট, অসুরের দল শুধু জাতির জনককেই নয়, ধানমÐির ৩২ নম্বরে আরও হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর সহধমির্ণী, জীবনের সুখ দুঃখের সাথী বেগম ফজিলাতুন্নেসা, একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসের, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল, রোজী জামাল এবং সবর্ কনিষ্ঠ শিশু পুত্র শেখ রাসেলকে।
কচি মুখ মায়াবী চোখ, নিমর্ল হাসির অবুঝ শিশু রাসেলের বঁাচার আকুতির বিনিময়ে, ঘাতকরা কচি বুকটা ঝঁাঝরা করে বুলেটের আঘাতে। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে তারও বুকের তাজা রক্তে ভেসে যায় মেঝে, মাঝখানে নীরব, নিথর প্রাণহানি অবস্থায় পড়ে থাকে ক্ষত বিক্ষত দেহ। শিশু রাসেল অসুরদের বাধা দিতে পারেনি, ভাগ্যকে মেনে নিয়েছে নীরবে। এ ছাড়া তার আর কোনো উপায় ছিল না। নিমর্ম বুলেটের আঘাত ও রক্তক্ষরণে নিঃশেষ প্রায় ওষ্ঠাগত প্রাণ নিয়ে শিশু রাসেল হয়তবা একবার বলেছে, ‘হে পৃথিবীর মানুষ! তোমরা একবার দেখ, একদল অসুরদের হাতে কিভাবে জীবন দিতে হলো একজন নিরাপরাধ, নিষ্পাপ, অসহায় শিশুকে। অসুরদের সাথে রাজনৈতিক মতানৈক্য, রাজনৈতিক বিরোধ থাকতে পারে আমার বাবার, আমার ভাইয়ের। আমিতো রাজনীতি বুঝি না, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র বুঝি না, আমি শিশু, আমি নিরাপরাধ, আমি নিষ্পাপ, আমার কোনো শত্রæ নেই, সারাবিশ্ব আমার জন্য অভয়ারণ্য তবুও আমাকে কেন জীবন দিতে হলো অসুরের হাতে। এ প্রশ্ন আমার পৃথিবীর মানুষের কাছে।’
অবুঝ শিশু রাসেলের কান্না, পায়নি সেদিন মানবতার ছেঁায়া। রাতের নিস্তব্ধতা ও অশুভ শক্তির বেষ্টনি ভেদ করে পেঁৗছায়নি পৃথিবীর মানুষের কানে। কিন্তু ইথারে ভাসতে ভাসতে পেঁৗছে গেছে আল্লাহর দরবারে, প্রচÐ ঝঁাকুনিতে কেঁপে উঠেছে আল্লাহর আরশ যা আমরা বুঝতে পারিনি, অনুভব করতে পারিনি, এটা আমাদের অজ্ঞতা, আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা। আল্লাহর কি অপার মহিমা! বিদেশে থাকার কারণে বেঁচে যান ভাগ্যগুণে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা আমাদের প্রিয় নেত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর তার ছোট বোন শেখ রেহানা। কিন্তু স্বজন হারাবার ব্যথায় ক্ষতবিক্ষত তাদের হৃদয়, বিভীষিকাময় ও দুবির্ষহ কালোরাতের স্মৃতি আজ তাদের জীবনের একমাত্র সম্বল।
’৭৫ এর ১৫ আগস্ট প্রকৃত অথের্ কোন সামরিক অভুত্থান ছিল না, ছিল ১৭৫৭ সালের ইংরেজ বেনিয়াদের ষড়যন্ত্র ও দেশীয় দালালদের সহযোগিতায় পলাশী প্রান্তরে সংঘটিত বিয়োগান্ত নাটকেরই পুনরাবৃত্তি। ভাগ্যের সেই একই পরিহাস। যার যৌবনের উত্তাপে গড়া এ সোনার বাংলা-তার রক্তাক্ত লাশ সিঁড়িতে ফেলে রেখে খুনির দল এগিয়ে যায় ক্ষমতার মসনদের দিকে। যার সারাজীবনের এত সাধনার ধন, সোনার বাংলা-তার অস্তিম যাত্রায় কফিন আচ্ছাদিত হয়নি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকায়, বিউগলে বেজে ওঠেনি শেষ বিদায়ের করুণ সুর। যার সারাজীবনের ত্যাগ ও শ্রমের ফসল বাঙালি জাতির স্বতন্ত্র আবাসভূমির ঠিকানা তার সমাধির জন্য রাজধানীতে জোটেনি সাড়ে তিন হাত জায়গা। বঙ্গবন্ধুর রক্তাক্ত লাশ খুনিদের উল্লাস নৃত্যের মধ্য দিয়ে মাটি চাপা দেয়া হয় নিজ জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ায়। আজ সময়ের ব্যবধানে টুঙ্গীপাড়া হয়ে উঠেছে বাঙালি জাতির তীথর্স্থান। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর মাজার দেখলে মনে হয় স্বাধীনতার সোনালি ইতিহাস গায়ে জড়িয়ে সারা বাংলা ঘুমিয়ে আছে টুঙ্গীপাড়ার সবুজ মাঠে।
’৭৫-এর ১৫ আগস্টের ঘটনার আকস্মিকতায় সমগ্র জাতি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং একটি প্রতি বিপ্লব ঘটাতে পারেনি একথা সত্যি। কিন্তু হিমালয় পবের্তর ন্যায় যার ব্যক্তিত্ব, আকাশের উদারতা আর সাগরের বিশালতায় বাংলাজুড়ে যার অস্তিত্ব ইতিহাস থেকে তার নাম, তার অবদান, তার গৌরব রক্তপাত ঘটিয়ে বিলুপ্ত করা যায় না। সময় যার হাতে তুলে দিয়েছে কীতির্ ও গৌরবের পুরস্কার, ইতিহাসে যার নাম রয়েছে লেখা স্বণার্ক্ষরে, তার কৃতিত্ব, তার যশ তাকে হত্যা করে মুছে ফেলা যায় না। বরং সে গৌরবের দ্বীপ্তি ও মযার্দা আরও বেড়ে যায়। আর হত্যাকারীদের স্থান হয় মানুষের সীমাহীন ঘৃনা ও ইতিহাসের আস্তাকঁুড়ে। এসব ইতিহাসের অমোঘ বিধান। এ বিধানকে যারা লঙ্ঘন করেছে, মানব সভ্যতার সমস্ত রীতিনীতি জলাঞ্জলি দিয়ে ন্যায়কে অন্যায়, সত্যকে অসত্য দ্বারা পরাভূত করতে চেয়েছে, তারা আসলে ছুটেছে মিথ্যে মরীচিকার পিছে। যার সাক্ষী আমাদের এই আকাশ, বৃক্ষ, প্রকৃতি।
ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। পলাশী প্রান্তরের বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর, মীরন, মোহাম্মদী বেগ, ঘসেটি বেগম, রায় দুলর্ভ, জগৎশেঠ, উমিচাদ বিশ্বাসঘাতকতার কাফ্ফারা কাকে বলে, ইতিহাসের পরতে পরতে চিনিয়ে দিয়ে গেছে। প্রধান বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর হতে চেয়েছিল মহবত জঙ্গ কিন্তু ভাগ্যের কি নিমর্ম পরিহাস! শেষ পযর্ন্ত হয়েছিল ক্লাইভের গাধা। দেনার দায়ে রাজকাযর্ চলাতে পারতোনা, বিশ্বাসঘাতকতার শেষ পরিণতির কথা ভেবে ভাঙ্গ খেয়ে চুর হয়ে পড়ে থাকত। ইংরেজদের দেনা মেটাতে গিয়ে মীরজাফর বধর্মান, নদীয়া জেলার গোটা খাজনা ইংরেজদের নামে লিখে দিতে বাধ্য হয়। খাজনা আদায়ের শাসনযন্ত্রে যেই ইংরেজদের প্রবেশ শুরু হলো, গোটা দেওয়ানি ও নিজামত তাদের হাতে চলে না যাওয়া পযর্ন্ত আর শেষ হলো না। ইংরেজরা দেনার দায়ে মীরজাফরকে একবার ক্ষমতাচ্যুত করেছিল আবার তারাই কৃপা করে তাকে মসনদে বসিয়েছিল কিন্তু মসনদ চালাবার ভাগ্য হলো না। অচিরেই পাপের প্রায়শ্চিত করতে সে কুষ্ঠ রোগে ধুঁকে ধুঁকে মারা গেল। তারপরও তার পাপের প্রায়শ্চিত হলো না, আজও বাংলার মানুষ বিশ্বাসঘাতককে ঘৃণাভরে মীরজাফর বলে গালি দেয়, তার মাজারে জুতা রেখে জিয়ারত করে সিরাজের মাজার।
ষড়যন্ত্রকারীদের একজন ঘসেটি বেগম তার সমস্ত লুকানো ধনরতœ দিয়ে মীরজাফরকে সাহায্য করেছিল। তার পরিণতিও ভালো হয়নি, যথারীতি বিশ্বাসঘাতকতার ফল ভোগ করেছে। মীরজাফর মসনদে আরোহণের পর নিষ্ঠুর মীরনই মোটামোটি রাজকাযর্ চালাত। তার আদেশেই আর এক নবাব নন্দিনী আমেনা বেগমের সাথে ঘসেটি বেগমকেও জলে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়। দু’বোন ডুবে মরার আগে মীরনের মাথায় বজ্রপাতের অভিসম্পাত করে যায়।
মীরজাফরের পুত্র মীরন, লোকে তাকে ছোট নবাব বলে ডাকত, তার সব দুষ্কমের্র সাথী ছিল খাদেম হোসেন। মীরজাফরের জমানায় সে পুনির্য়ার ফৌজদারি লাভ করেছিল। একদিন হঠাৎ করেই মীরন ও খাদেম হোসেনের মধ্যে লাঠালাঠি শুরু হয়ে গেল। বিদ্রোহী খাদেম হোসেনের পিছু ধাওয়া করতে গিয়ে খোলামাঠে তঁাবুর মধ্যে বিনা মেঘে বজ্রপাতে মীরন নিহত হলো। আর খাদেম হোসেন প্রাণের ভয়ে তরাইয়ের নিñিদ্র অরণ্যের মধ্যে পালিয়ে চিরতরে লোক চক্ষুর অন্তরাল হলো।
ষড়যন্ত্রের অপর নায়ক রায় দুলর্ভ, মীরনের আদেশে দু’দিনের দেওয়ানি রাজবল্লভের হাতে ছেড়ে দিয়ে ধন ও মান নিয়ে কলকাতায় পালিয়ে বঁাচলেন। কিন্তু তার সঞ্চিত ধন উত্তরাধিকারীদের ভোগে লাগল না। তার একমাত্র সন্তান মুকুন্দবল্লভ তার জীবদ্দশায় মৃত্যু মুখে পতিত হওয়ায় রায় দুলের্ভর বংশলোপ পেলো। জগৎ শেঠ, মহাতাব রায় ও মাহারাজা স্বরুপচন্দের পরিণাম হলো আরও ভয়াবহ। ইংরেজদের মিত্র বলে নবাব মীরকাশিম এই দুই শেঠকে গঙ্গার জলে ডুবিয়ে মারলেন। জগৎশেঠের পরিবার ব্যবসায় যে ঘা খেল তা আর সামলিয়ে উঠতে পারল না। দেওয়ানি হাতে পেয়ে ক্লাইভ রু²ভাবে তাদের উত্তরাধিকারীর হাত থেকে রাজকোষের চাবি ছিনিয়ে নিলেন। এভাবে পলাশী যুদ্ধের বিশ বছরের মধ্যে প্রায় সব ষড়যন্ত্রকারী সমূলে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।
আমাদের দুভার্গ্য, আমরা ইতিহাস পড়ি কিন্তু ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি না। ’৭৫-এর প্রধান মীরজাফর খন্দকার মোশতাক হতে চেয়েছিল একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু সে ক্ষমতা স্থায়ী হয়নি। মাত্র ৮১ দিনের মাথায় মোশতাক ক্ষমতাচ্যুত হয়ে চুরির দায়ে জেলে যায়। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে আর কোনো দিন জনসম্মুখে বেরোয়নি। আপন বাসভবনে বন্দি অবস্থায় নিজ কৃতকমের্র জন্য অনুশোচনা এবং বিবেকের দংশনে মানুষের আদালতকে ফঁাকি দিয়ে ধুকে ধুকে এগিয়ে যায় মৃত্যুর দিকে। বিচার শুরু হয় বিধাতার আদালতে, নিজের সন্তানও মীরজাফরের সন্তানের পরিচয়ে এদেশে বাস করতে চায় না। পিতার অপকমের্র দায়ে ক্ষোভে আর ঘৃণায় মোশতাকের সন্তানরা দেশ ছেড়ে চলে যায়। অন্যান্য মীরজাফরদের শেষ পরিণতি আরও করুন। একজন মধ্যপ্রাচ্যে সড়ক দুঘর্টনায় মারা যায়। বুলেটের নিমর্ম আঘাতে আর একজনের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, হাড় মাংস, শিরা-উপশিরা ছিন্ন-বিছিন্ন অবস্থায় মাটি চাপা পড়ে। মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে লাশটি উদ্ধার করা সম্ভব হলেও শনাক্ত করার কোনো উপায় ছিল না। বিবষর্ অবস্থায় লাশটি দেখার সৌভাগ্যও দেশবাসীর হয়নি। ফঁাসিকাষ্ঠে ঝুলে কেউ কেউ পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেছে। কেউ কেউ মৃত্যু পরোয়ানা মাথায় নিয়ে বিদেশের মাটিতে ফেরারি হয়ে আছে।
সংঘাতময় এ পৃথিবীতে কখনও কখনও ন্যায় এবং সত্য পরাভূত হয়েছে, অন্যায়-অসত্যের কাছে, বিবেক বন্দি হয়েছে ববর্রতায়, নৈতিকতা, আদশর্ মানবিক মূল্যবোধ বিপন্ন হয়েছে, কিন্তু তা সাময়িক। ববর্রতা, অন্যায় অসুন্দরের মতো অপশক্তি কখনও স্থায়ী হয় না। বিভ্রান্তির ঘোর কেটে যাওয়া মাত্রই মানুষের মাঝে ফিরে আসে বিবেকের অনুভ‚তি, বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে অনুশোচনা, পুঞ্জিভ‚ত গøানি আর দুঃসহ যন্ত্রনার। যেমন বাংলার মানুষকে অনুতাপ করতে দেখেছি সিরাজের জন্য, আমি মানুষকে কঁাদতে দেখেছি মুজিবের জন্য, গ্রানাডার মাটিকে করতে দেখেছি বিদ্রোহ, শুষে নেয়নি মরিশ বিশসের রক্ত। আমি দেখেছি চিলির আলেন্দের জনপ্রিয়তা, তার ছবি বুকে নিয়ে সে দেশের মানুষের কান্না। চিলির মাটিকেও করতে দেখেছি বিদ্রোহ শুষে নেয়নি আলেন্দের রক্ত। আর এত বাংলার মাটি’-৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে পুড়ে পুড়ে খঁাটি। একদম খঁাটি। যেন মুজিবের সেরা ভক্ত, বাংলার মাটিকেও করতে দেখেছি বিদ্রোহ এ মাটি শুষে নেয়নি মুজিবের রক্ত।
আমরা কেউ ইতিহাসের ছাত্র, কেউ শিক্ষক, কেউ একটি পাতা, কেউ একটি অধ্যায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু নিজেই এক ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস, স্বাধীনতার ইতিহাস, ইতিহাসের এক কিংবদন্তি। ইতিহাসের এই কিংবদন্তিকে হত্যা করে যারা বদলে দিতে চেয়েছিল ইতিহাসের ধারা, তারা জানে না হত্যা করেই থামানো যায় না ইতিহাসের পথ চলা।
সময়ের হাত ধরে অঁাধার পেরিয়ে ইতিহাস এগিয়ে যায় পায়ে পায়ে। ইতিহাসের হাত ধরেই সময়ের ব্যবধানে বঙ্গবন্ধু কবর থেকে উঠে এসেছেন তার প্রিয় সোনার বাংলায়, তার প্রিয় মানুষের কাছে। ইতিহাসের রক্ত গোলাপ হয়ে ফুলে ফলে, ফসলের মাঠে, কৃষকের হাসি, রাখালের বঁাশি, মাঝির ভাটিয়ালী গানে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সঞ্চারিত মিছিল, কবিতার আসরে, নাটকের মঞ্চে সবর্ত্রই ছড়িয়ে পড়েছে বঙ্গবন্ধু অস্তিত্ব। রুখে তার দুবার্র গতি, কার আছে এমন সাধ্য। যতদিন বাংলার মাটি, মানুষ, বৃক্ষ আকাশ প্রকৃতি থাকবে ততদিন বঙ্গবন্ধু থাকবে, বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারিত হবে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে, অত্যন্ত গবের্র সঙ্গে।
ফজলুল হক খান: গীতিকার, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক