বঙ্গবন্ধুর হাতে ওসমানীর তরবারি

       
তোফায়েল আহমেদ

১৯৭১-এর ২২ মার্চ ছিল সোমবার। লাগাতার চলা অসহযোগ আন্দোলনের ২১তম দিবস। সকাল সাড়ে ১১টায় প্রেসিডেন্ট ভবনে বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হন। প্রেসিডেন্ট ভবনের সামনে অবস্থানরত সংগ্রামী জনতা বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশে 'জয় বাংলা' রণধ্বনি দেয় এবং ভুট্টোবিরোধী বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। প্রায় ৭৫ মিনিটব্যাপী আলোচনা শেষে দেশের আপামর জনসাধারণের মুক্তিদূত জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক বঙ্গবন্ধু দৃঢ় অথচ বিষণ্ণ অবয়বে প্রেসিডেন্ট ভবনের বাইরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, 'প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আমার নির্ধারিত বৈঠক ছিল। সে অনুযায়ী আমি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে যাই। সেখানে মি. ভুট্টো উপস্থিত ছিলেন। আমি প্রেসিডেন্টকে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছি যে, ৪টি শর্ত পরিপূরণ না হলে আমরা জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করতে পারি না।' অতঃপর দুপুর ১টায় স্বীয় বাসভবনে ফিরে বঙ্গবন্ধু পুনরায় সাংবাদিকদের ব্রিফিং দেন। আজকের আলোচনায় কতটুকু অগ্রগতি সাধিত হয়েছে- বহু সাংবাদিকের এ রকম প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু খানিকটা উচ্চকণ্ঠে বলেন, 'আলোচনায় অগ্রগতি সাধিত না হলে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি কেন?' অপর এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, 'ইতিমধ্যে বাংলাদেশে গুরুতর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। জনগণের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।' অর্থাৎ আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি। তথাপি বঙ্গবন্ধু মুজিব আলোচনার নেতিবাচক ফল সম্পর্কে কাউকে কোনো ধারণা দেননি। আমাদের প্রতি পূর্বেই নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন, 'ওরা আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করবে, তোমরা আমার নির্দেশমতো তোমাদের প্রস্তুতি গ্রহণ করো।' আমরা নেতার নির্দেশমতো সংগ্রামী জনতাকে সংগঠিত করতে উদয়াস্ত কাজ করেছি। রাতে নেতা আমাদের একান্তে ডেকে বলেছিলেন, "আজ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকে আমি প্রস্তাব দিয়েছিলাম, 'পাকিস্তানের এ অঞ্চলে আমরা সরকার গঠন করি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য অঞ্চলে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন, তারা সরকার গঠন করুক এবং ৬ দফার ভিত্তিতে আমাদের খসড়া শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কাজও সমাপ্ত। মি. প্রেসিডেন্ট, আপনি আমার ৪ দফা মেনে নিয়ে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন।' এ প্রস্তাব গ্রহণ করলে বিনা রক্তপাতেই বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করতে পারবে। কিন্তু মনে হয় না এতে তারা রাজি হবে। যা হোক, তোমরা তোমাদের প্রস্তুতি এগিয়ে নিয়ে যাও।" 

আজ পত্রিকায় প্রেরিত এক বিশেষ বাণীতে বঙ্গবন্ধু বলেন, 'আমাদের আন্দোলনের বৈধতার কারণে বিজয় এখন থেকে আমাদেরই।' বাংলাদেশের সব দৈনিক পত্রিকার জন্য প্রেরিত এ বাণীটির শিরোনাম ছিল 'বাংলাদেশের মুক্তি'। বাণীতে সাত কোটি বাঙালির সামগ্রিক মুক্তির জন্য চলমান আন্দোলনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু বলেন, 'চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এই সংগ্রাম চলবে। বুলেট, বেয়নেট এবং বন্দুক দ্বারা বাংলাদেশের মানুষকে স্তব্ধ করা যাবে না; কারণ তারা আজ ঐক্যবদ্ধ। আমাদের লক্ষ্য অর্জনে যে কোনো প্রকার আত্মত্যাগে আমরা প্রস্তুত। যে কোনো আক্রমণ প্রতিহত করতে বাংলাদেশের প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে হবে।' সংগ্রামী জনতার উদ্দেশে প্রদত্ত বাণীটিতে রয়েছে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী কর্তৃক আসন্ন গণহত্যার চক্রান্ত প্রতিহত করার এবং প্রস্তুতি গ্রহণের সতর্কসংকেত। এদিকে সন্ধ্যায় সংবাদপত্রে প্রেরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জেনারেল ইয়াহিয়া বলেছেন, 'পাকিস্তানের উভয়াংশের নেতৃবৃন্দ এবং রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে সমঝোতার ক্ষেত্র অধিকতর প্রসারিত করার সুবিধার্থে ২৫ মার্চে আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা হলো।' পুনরায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন কবে বসবে এ রকম কোনো দিন তারিখ উল্লেখ না করেই বিবৃতিটি প্রদান করা হয়। অর্থাৎ ২৫ মার্চ তারিখেই গণহত্যার নীলনকশা চূড়ান্ত করা হয়েছে। সে জন্য লোক দেখানো একটি বিবৃতি দিয়ে বিষয়টি পাকাপোক্ত করা হয়। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনায় তারাও বুঝেছিলেন যে, ইয়াহিয়া খান শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক আলোচনার ভিত্তিতে সমস্যার সমাধানে আন্তরিক নন। সেই সঙ্গে ভুট্টোর আগমনের মধ্য দিয়ে এবং তারই পরামর্শে ২৫ তারিখকেই গণহত্যার দিন হিসেবে ধার্য করা হয়। 

বিকেলে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে আয়োজিত বিমান, নৌ ও স্থলবাহিনীর প্রাক্তন সৈনিকদের এক সম্মিলিত সমাবেশে বাংলাদেশের সব অবসরপ্রাপ্ত সৈনিককে নিজ নিজ এলাকার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সংগ্রাম পরিষদ এবং স্বেচ্ছাসেবকদের সংগঠিত করার নির্দেশ প্রদান করা হয়। মেজর জেনারেল (অব.) এম আই মজিদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সমাবেশটি পরিচালনা করেন কর্নেল (অব.) এমএজি ওসমানী, এমএনএ। সমাবেশে দেশের আসন্ন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য উপস্থিত সবাই শপথ গ্রহণ করেন। যারা এ সমাবেশে আসতে পারেননি, তাদের প্রতিও আসন্ন যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে শামিল হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি সৈনিক এবং অফিসারদের প্রতিও কর্মস্থল ত্যাগ করে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য সমাবেশ থেকে উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়। সাবেক সামরিক অফিসার ও সৈনিকরা সমাবেশ শেষে এক মিছিল সহকারে প্রথমে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যান। সেখানে কর্নেল ওসমানী এক সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দেওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধে যোগদানে উপস্থিত সবাইকে রক্তশপথ অঙ্গীকারনামা পাঠ করান। এরপর মিছিল সহযোগে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আসেন। বঙ্গবন্ধু বাড়ির সদর দরজায় এসে জয় বাংলা ধ্বনি দিয়ে তাদের স্বাগত জানান। অতঃপর মেজর জেনারেল (অব.) এম আই মজিদ, কর্নেল (অব.) ওসমানীসহ মোট চারজন বঙ্গবন্ধুর লাইব্রেরি কক্ষে একান্ত বৈঠকে মিলিত হন। এই বৈঠকে কর্নেল ওসমানী বঙ্গবন্ধুর হাতে সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে একটি তরবারি তুলে দেন। এরপর আলোচনা চলাকালে এক পর্যায়ে ওসমানী সাহেব বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেন, 'ডু ইউ থিংক দ্যাট টুমরো উইল বি এ ক্রুসিয়াল ডে?' বঙ্গবন্ধু জবাবে বলেন, 'নো, আই থিংক, ইট উইল বি টোয়েন্টি ফিফথ।' তখন ওসমানী সাহেব পুনরায় তীক্ষষ্ট স্বরে তার কাছে প্রশ্ন রাখেন, 'কাল তো তেইশে মার্চ। পাকিস্তান দিবস। সে উপলক্ষে ওরা কি কিছু করতে চাইবে না?' বঙ্গবন্ধু বলেন, 'ওরা যে কোনো মুহূর্তে যে কোনো কিছু করতে পারে। তার জন্য কোনো দিবসের প্রয়োজন হয় না। আসলে আমরা যতটা এগিয়ে গিয়েছি এবং সেই সঙ্গে শঙ্কাও বোধ করছি। সে কারণে ওরাও কম শঙ্কিত নয়। ওরা জানে অ্যাডভার্স কিছু করার অর্থই সব শেষ করে দেওয়া।' আসলে এদিন থেকেই রাজনৈতিক মহলে চাপা গুঞ্জন আর থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। ওসমানী সাহেবের সঙ্গে আলোচনা শেষ করে সন্ধ্যা ৬টায় বঙ্গবন্ধু তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী এবং দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ সর্বজনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান, খন্দকার মোশতাক আহমদ এবং ড. কামাল হোসেনকে নিয়ে এক আলোচনা বৈঠকে বসেন। মূলত এই বৈঠকেই সাব্যস্ত হয় যে, যখনই পাকিস্তান সামরিক বাহিনী গণহত্যা শুরু করবে, ঠিক সঙ্গে সঙ্গেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত স্বাধীনতার ঘোষণাটি ওয়্যারলেস সেটের মাধ্যমে ঢাকা বা চট্টগ্রামে প্রেরণ করা হবে। বৈঠকে আরও সিদ্ধান্ত হয় যে, স্বাধীনতার ঘোষণা বাণীবদ্ধ করে বঙ্গবন্ধু নিজ বাড়িতেই অবস্থান করবেন। সংখ্যাগরিষ্ঠের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত নেতা হিসেবে তিনি কখনোই পলায়ন করতে পারেন না। 

প্রতিদিনের মতো আজও বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ঢেউয়ের মতো একের পর এক শান্তিপূর্ণ ও নিয়মানুগ মিছিলের স্রোত আসতে থাকে। বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের মিছিলের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, 'বাংলার মানুষ আওয়ামী লীগ ও আমাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে নির্বাচিত করেছে। সুতরাং শাসন করার বৈধ অধিকার কেবল আমারই আছে। বুলেট এবং বেয়নেটের মাধ্যমে যত ষড়যন্ত্রই চলুক না কেন সমগ্র বাংলাদেশ আজ জাগ্রত, বাঙালি জাতি আজ একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে অবিচল ও ঐক্যবদ্ধ। সুতরাং জয় আমাদের সুনিশ্চিত।' যে কোনো ধরনের আপস-মীমাংসার বিরুদ্ধে স্লোগানরত জনতার উদ্দেশে তিনি বলেন, 'যদি তারা দ্রুত আমাদের ৪ দফা দাবি মেনে নেয় তাহলে এখনও পর্যন্ত আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ অবস্থানে থেকে বসবাস সম্ভব।' এদিন বিদেশি টেলিভিশনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেন, 'দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নির্বাচিত বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে শাসন করার নৈতিক বৈধতা কেবলমাত্র আমারই রয়েছে, অন্য কারও নয়। আমার জনগণ তাদের সুমহান আত্মত্যাগ ও কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মধ্য দিয়ে বিগত ২১ দিনের অসহযোগ আন্দোলনে বিশ্বের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।' ২৫ তারিখের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। সারাদেশের রাজনৈতিক নেতাকর্মী এবং সর্বস্তরের মানুষ প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। মিরপুরের সংগ্রামী জনতা বঙ্গবন্ধুর ৪ দফার সমর্থনে আজ বিকেল ৫টায় বিশাল এক ট্রাক মিছিল বের করে নগরীর বিভিন্ন দিক প্রদক্ষিণ শেষে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এসে নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। এ ছাড়াও সাবেক চাকরিজীবী অ্যাসোসিয়েশন, চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট অ্যাকশন কমিটি, এসএসসি পরীক্ষার্থী সমিতি, বাস্তুহারা সমিতি, ঢাকা দোকান মালিক-কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদ, গভর্নমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশন ও ওয়াপদা ওয়ার্কার্স ফেডারেশন বায়তুল মোকাররম ও শহীদ মিনারে মিছিল সমাবেশ করে নিজ নিজ ব্যানারে স্বাধীনতার দাবিতে স্লোগান সহকারে শোভাযাত্রা বের করে। আমরা নেতার নির্দেশমতো আগামীকালের 'লাহোর প্রস্তাব দিবস' পালন ও বাংলার প্রতি ঘরে ঘরে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা তোলার কর্মসূচি সফল করতে সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে সর্বস্তরের জনতাকে সঙ্গে নিয়ে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করি।

SUMMARY

146-1.jpg