আনিসুজ্জামান, জাতীয় অধ্যাপক
সামান্য এক রাজনৈতিক কর্মী থেকে নিজের মেধা, শ্রম ও প্রজ্ঞার বশে তিনি পরিণত হয়েছিলেন একটি রাষ্ট্রের স্থপতিরূপে। তার জন্য তাঁকে পাড়ি দিতে হয়েছে দীর্ঘ পথ। সে-পথ বেশির ভাগই ছিল বন্ধুর। পায়ে বিঁধেছে কাঁটা, ক্ষরণ হয়েছে রক্তের। তবু যাত্রা থামেনি, গন্তব্যে পৌঁছানো পর্যন্ত হয়নি কোনো আপস। জীবনের অনেকটা সময় কেটেছে কারাগারে। দু-দুবার তাঁর প্রাণসংশয় হয়েছিল। সেই অন্ধকার ভেদ করে জ্যোতির্ময়রূপে দেখা দিয়েছিলেন তিনি।
২১ বছর বয়সী এক কারাবন্দী নির্বাচিত হয়েছিলেন নতুন রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক। ২৬ বছর ধরে সেই দলে ছিলেন। দলের রূপান্তরও হয়েছে তাঁর হাতে। ক্রমান্বয়ে তিনি হয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি। পরে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, হয়েছেন রাষ্ট্রপতি। তবে নিজেকে জেনেছেন জনগণের সেবকরূপে।
১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান যখন ছয় দফা দাবিনামা উত্থাপন করেন লাহোরে, তখন তাঁর পক্ষে খুব বেশি লোক ছিল না। দেশের রাষ্ট্রপতি হুমকি দিয়েছিলেন অস্ত্রের ভাষায় জবাব দেওয়ার। মুজিব মাত্র তিন মাস সময় পেয়েছিলেন জনগণকে তাঁর দাবিনামা ব্যাখ্যা করার। তাতেই অভাবনীয় জনসমর্থন পেয়ে যান তিনি। তারপর তো তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়, বন্দী অবস্থায় রুজু করা হয় শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য বনাম পাকিস্তান মামলা। এটিই পরিচিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বলে। অভিযোগ রাষ্ট্রদ্রোহের: পাকিস্তান থেকে পূর্বাঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রের। মামলার ফল হয়েছিল সরকারের অভিপ্রায়ের সম্পূর্ণ বিপরীত। মামলার বিবরণী যতই প্রকাশ হতে থাকল, পূর্ব বাংলার মানুষের সহানুভূতি ততই বাড়তে থাকল শেখ মুজিবের দিকে। শেষে তো গণ-অভ্যুত্থান। আগরতলা মামলা প্রত্যাহার, মুজিবকে বাধ্য হয়ে মুক্তিদান, প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের বিদায়। মুজিব হলেন বঙ্গবন্ধু।
১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হলো পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন। মুজিব একে আখ্যা দিলেন ছয় দফার পক্ষে গণভোট বলে। নির্বাচনে তাঁর দল পেল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। কিন্তু কুচক্রীরা ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চায় না, চায় না ছয় দফার ভিত্তিতে সংবিধান রচনা। বঙ্গবন্ধু ডাক দিলেন অসহযোগ আন্দোলনের। এই আন্দোলনের সাফল্য সারা বিশ্বকে চমকিত করল। সাতই মার্চ রমনার রেসকোর্সে লাখ লাখ মানুষের সামনে ভাষণ দিলেন মুজিব। এটাই ছিল তাঁর জীবনের সেরা মুহূর্ত। তিনি বললেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’ তিনি বললেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাল্লাহ্।’ তিনি বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই মৌখিক ভাষণ এখন বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্গত। এ ভাষণ শুনে আজও শিহরিত হতে হয়।
পাকিস্তানি বাহিনী নির্মম গণহত্যার সূচনা করে ২৫ মার্চ মধ্যরাতে, গ্রেপ্তার করে বঙ্গবন্ধুকে। তার আগে তিনটি সম্প্রচার যন্ত্র থেকে প্রচারিত হয় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা-ঘোষণার দুটি ইংরেজি ভাষ্য। মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু অনুপস্থিত, কিন্তু সে-যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল তাঁরই নামে। পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালিরা প্রথমে প্রতিরোধ ও পরে পাল্টা আক্রমণ পরিচালনা করে এবং শেষ পর্যন্ত নিতান্ত অল্প সময়েই ভারতের সাহায্যে বিজয় অর্জন করে। মুজিবের মুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক চাপ আর পাকিস্তান উপেক্ষা করতে পারে না। তিনি ফিরে আসেন স্বদেশবাসীর মধ্যে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন এবং বাস্তুচ্যুত ও অসহায় মানুষের পুনর্বাসনের গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করলেন। এক বছরের মধ্যেই জাতি একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান পেল, অনুষ্ঠিত হলো সাধারণ নির্বাচন। কিন্তু সময়টা অনেক বদলে গিয়েছিল। স্বাধীন দেশে মানুষের প্রত্যাশা এত বেড়ে গিয়েছিল যে বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে তার মিল হচ্ছিল না। অস্ত্রশস্ত্র সারা দেশে ছড়িয়ে গিয়ে এক অরাজক অবস্থার সৃষ্টি করে। অতি বাম এবং বাংলাদেশবিরোধী দক্ষিণপন্থীদের সশস্ত্র হানা এই অরাজকতাকে বাড়িয়ে দেয়। বৈরী আবহাওয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্রের ফলে দেশে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষাবস্থা।
সংবিধান সংশোধন করে বঙ্গবন্ধু প্রবর্তন করলেন প্রকৃতপক্ষে একদলীয় শাসনব্যবস্থা। গণতন্ত্রের জন্য—বিশেষত সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য—তাঁর জীবনব্যাপী সংগ্রামের সঙ্গে এই পদক্ষেপ সংগতিপূর্ণ ছিল না। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এটি সাময়িক ব্যবস্থা। হয়তো তাই। কিন্তু নতুন অবস্থার পরিণাম দেখার সুযোগ আমাদের হয়নি। তার আগেই দেশদ্রোহী ঘাতকদের হাতে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে প্রাণ দিতে হয়। তাঁর রক্তাক্ত দেহ পড়ে থাকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রাস্তায় তাঁর বাড়ির সিঁড়িতে। পরদিন হেলিকপ্টারে করে তাঁর লাশ নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ায়। প্রথমে বিনা জানাজায় তাঁকে সমাধিস্থ করার চেষ্টা হয়। সে-প্রয়াস ব্যর্থ হলে কাপড়-কাচা-সাবান দিয়ে তাঁর মরদেহ ধোয়ানো হয়। কাফনের জন্য উপযুক্ত কাপড়েরও ব্যবস্থা করা যায়নি। যত দ্রুত সম্ভব তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। সেখানেই তিনি আছেন।
না, শুধু সেখানেই নেই তিনি। তিনি ছড়িয়ে আছেন সারা বাংলাদেশে। তিনি আছেন তাঁর বজ্রকণ্ঠ বাণীতে। তিনি আছেন এ দেশের মানুষের হৃদয়ে। সেখান থেকে তাঁকে অপসারণ করা যাবে না। মুজিব মৃত, মুজিব অমর।