শেখ ফজলে নূর তাপস
বাবা-মায়ের সঙ্গে কাটানো কোনো ঘটনার স্মৃতি আমার স্পষ্ট মনে পড়ে না। বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তান যেমন মধুর সময় কাটায়, আমরা দুই ভাই তা পাইনি।
১৯৭৫ সালের সেই বিভীষিকাময় দিনে আমার বয়স ছিল পৌনে চার বছর। বড় ভাই শেখ ফজলে শামস পরশের প্রায় ছয়। আমরা দুই ভাই সেই রাতে ঘুমিয়েছিলাম মায়ের সঙ্গে।
সেদিনের কথা পরে মনে করার চেষ্টা করেছি অনেক। খুব আবছা একটা ছবি মনে আসে। সেটিই আমার একমাত্র স্মৃতি—বাবার লাশ। সাদা গেঞ্জি গায়ে। সিঁড়ির পাশের চৌকিতে পড়েছিলেন। গলায় একটি লাল দাগ। সেখানে গুলি লেগেছিল। পরে লাশ নিয়ে যাওয়ার পরে ওই চৌকিতে ছোপ ছোপ রক্ত লেগে ছিল। এ ছাড়া ১৫ আগস্টের আর কিছু আমার মনে পড়ে না।
তারপর তো অনেক কষ্ট, যন্ত্রণা, অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়ে একটা দীর্ঘ সময় কেটেছে।
আরজু মণি
আমাদের দাদি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বোন শেখ আসিয়া বেগম, দুই এতিম সন্তানকে লালন-পালনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তখন বাবা-মাকে হারানোর বিষয়টি আমি বুঝতেই পারিনি। কান্নাকাটি করতাম। আমাদের সান্ত্বনা দিয়ে বলা হতো, বাবা-মা বিদেশে কাজে গেছেন। কয়েক দিন পরেই তাঁরা ফিরে আসবেন। এভাবেই দিন যাচ্ছিল। একটা সময় বুঝলাম, বাবা-মা আর কোনো দিন আসবেন না।
সেই সময়গুলোতে বিভিন্ন আত্মীয় বাড়িতে লুকিয়ে থাকতে হতো আমাদের। সব সময় ভয় আর আতঙ্কের মধ্যে থাকতাম। একটা পর্যায়ে এখানে থাকতে না পেরে দাদি সম্ভবত ১৯৭৮ সালের দিকে আমাদের নিয়ে ভারতে চলে যান। সেখানে আমরা দুই বছর থেকেছি।
প্রায় দুই বছর পরে ঢাকায় ফিরে আসি আমরা। ঢাকায় তখনো বঙ্গবন্ধুর পরিবার, আত্মীয়স্বজনের ওপর নানা রকমের চাপ ছিল। লোকে আমাদের বাড়ি ভাড়া দিতে চাইত না। ফলে দাদি আমাদের নিয়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বাড়িতে থেকেছেন। আমার দুই চাচা, ফুপুদের বাড়িতে থাকতাম আমরা। এভাবে পড়ালেখায়ও খুব সমস্যা হচ্ছিল। কোনো স্কুল আমাদের বেশি দিন রাখতে চাইত না। তাদের ওপর আবার কোন খড়্গ নেমে আসে—সব সময় এই ভয়ে থাকত স্কুল কর্তৃপক্ষ। কী আর করা—বেশ কয়েকবার স্কুল বদল করে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে হয়েছে আমাদের।
আমরা প্রথম একটি স্থিতিশীল-নিরাপদ জীবন ফিরে পাই বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশে ফেরার পর। আমি যখন উপলব্ধি করলাম আমার বাবা-মাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে এবং এই হত্যাকাণ্ডের বিচারও হবে না, তখন যে গভীর যন্ত্রণা প্রতিনিয়ত আমাদের অন্তর দগ্ধ করেছে, তা প্রকাশের ভাষা আমার জানা নেই। আপনজন হারানোর শোকের পাশাপাশি এই বিচার না পাওয়ার যন্ত্রণা দীর্ঘদিন আমাদের জর্জরিত করেছে। তবে সব সময় মনে আশা রেখেছি, একদিন না একদিন এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের বিচার এ দেশে হবেই। আমার আইনশাস্ত্র অধ্যয়নও অনেকটা সেই প্রত্যাশা থেকেই। ব্যক্তিগতভাবে বিজ্ঞান ছিল আমার পছন্দের বিষয়। প্রকৌশলী হতে চেয়েছিলাম আমি। তবে আমার ছোট চাচা আমাকে অনুপ্রাণিত করেন আইন পড়তে। আর আমিও ভেবেছি, যদি কখনো সুযোগ আসে এই অন্যায় হত্যার বিচারের জন্য আইনি লড়াই করব। সেই সুযোগ আমার হয়েছে। এটুকুই সান্ত্বনা।
ফজলে নূর তাপস
বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচার-প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ১৯৯৬ সালে, আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর। তারপরও আমাদের সংশয় ছিল বিচার সম্পন্ন করতে পারব কি না। অবশেষে ৩৪ বছর পর বিচার-প্রক্রিয়া শেষে অপরাধীদের সাজা কার্যকর হয়েছে। তবে যেসব অপরাধী এখনো বিদেশে পালিয়ে আছে, তাদের দেশে এনে সাজা কার্যকর করার কাজটি বাকি রয়ে গেছে এখনো। আশার কথা হলো, সেই প্রক্রিয়াও চলমান।
বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের সঙ্গে শেখ কামাল ও শেখ মণি। ছবি: সংগৃহীত
আগস্ট মাস এলে আমার বুকটা গভীর বেদনায় ভরে ওঠে। রক্তাক্ত ওই ঘটনা যখন বিশ্লেষণ করি, দেখি যে ঘাতকদের জিঘাংসা এত প্রবল ছিল, ন্যূনতম মানবিক বোধ তাদের ভেতরে কাজ করেনি। আমার মা ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। ঘাতকেরা নারী ও শিশুদের পর্যন্ত বর্বরভাবে খুন করেছে। নিহতরা কেউ ভীত ছিলেন না। অতুলনীয় সাহসিকতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে মৃত্যুবরণ করেছেন। এই সাহসী মানুষগুলোর জন্য, আমার বাবার জন্য আমি গর্ববোধ করি।
শেখ ফজলে নূর তাপস: শেখ ফজলুল হক মণির ছেলে, সাংসদ।