তিনি ইতিহাসে চিরভাস্বর

সিমিন হোসেন রিমি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ অবিচ্ছেদ্য। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব তথা বাংলাদেশের উজ্জ্বল প্রতীক। জনগণের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে চিন্তার বিকাশের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছিল তাঁর নেতৃত্ব। সে চিন্তার জগৎজুড়ে ছিল মানুষের মুক্তি, মানুষের জন্য উন্নয়ন-ভাবনা। তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে দেখা যায় এক উদ্যমী কিশোর, সাহসী যুবক, দৃঢ়চেতা তরুণ বিচক্ষণ এক রাজনৈতিক ব্যক্তিকে, যাঁর চিন্তার বৃহৎ অংশজুড়েই সাধারণ মানুষের জন্য কল্যাণভাবনা। এই কল্যাণভাবনা থেকেই তিনি উপলব্ধি করেন মানুষের সংকট ও তার গভীরতা। তিনি তাঁর অন্তরের বিশ্বাস প্রকাশ করেন গভীর উপলব্ধি থেকে। তরুণ বয়সের উপলব্ধি তিনি প্রকাশ করেছেন তাঁর ভাষায়, ‘যেকোনো মহৎ কাজ করতে হলে ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন। যারা ত্যাগ করতে প্রস্তুত না, তারা জীবনে কোনো ভালো কাজ করতে পারেনি—এ বিশ্বাস আমার ছিল। আমি বুঝতে পেরেছিলাম এ দেশে রাজনীতি করতে হলে ত্যাগের প্রয়োজন আছে এবং আমাদের ত্যাগ করতে হবে পাকিস্তানের জনগণকে সুখী করতে হলে।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ১২৮)

এই বইয়ে ফুটে ওঠে বঙ্গবন্ধুর উপলব্ধিতে অত্যন্ত স্বচ্ছ মানুষের মনোজগৎ। তাদের মানসিকতা, আচার-আচরণ। তরুণ বয়সে মানুষকে ভালোবেসে, তাদের কষ্ট দূর করতে তিনি যে লক্ষ্য স্থির করেছিলেন, সেই লক্ষ্যে স্থির ছিলেন প্রতি মুহূর্তে। তাই তো তিনি অকপটে বলতে পারেন, ‘আমরা এ দেশের শাসক নই, আমরা এ দেশের সেবক এ কথা মনে রাখতে হবে। জনগণের সেবার জন্যই আমরা নির্বাচিত হয়েছি এবং তাদের সেবাতেই আমাদের আত্মনিয়োগ করতে হবে।’ (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: জীবন ও রাজনীতি, পৃষ্ঠা ৯২৮)


বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টি যেমন স্বদেশের আনাচে-কানাচে, তেমনি তাঁর ভাবনা অনুসরণ করে সুচারুভাবে বিশ্বপরিস্থিতি ও রাজনীতিকেও। কখনো তিনি টুকে রাখেন তাঁর রোজনামচায়, ‘সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন একটি চমৎকার কথা বলেছেন। কথাটি একেবারে সত্য। ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা সম্পর্কে বলেছেন, “জয়ের সাধ্য নাই, ফেরারও পথ পাইতেছে না।”’ (কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা ৭৬) আবার কখনো পাকিস্তানের রাজনীতি নিয়ে লিখেছেন, ‘আমার ভয় হচ্ছে এরা পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির দিকে নিয়ে যেতেছে। আমরা এ পথে বিশ্বাস করি না। আর এ পথে দেশের মুক্তিও আসতে পারে না। কিন্তু সরকারের এই নির্যাতনমূলক পন্থার জন্য এ দেশের রাজনীতি “মাটির তলে” চলে যাবে। আমরা যারা গণতন্ত্রের পথে দেশের মঙ্গল করতে চাই, আমাদের পথ বন্ধ হতে চলেছে। এর ফল যে দেশের পক্ষে কী অশুভ হবে তা ভাবলেও শিহরিয়া উঠতে হয়। কথায় আছে অন্যের জন্য গর্ত করলে নিজেই সেই গর্তে পড়ে মরতে হয়।’ (কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা ৬২)

বঙ্গবন্ধু দেশের মানুষের নাড়ির স্পন্দন বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন, যার পরিণতি আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ। ইংরেজিতে একটি কথা আছে—লিডারশিপ ইজ দ্য ক্যাপাসিটি টু ট্রান্সলেট ভিশন ইনটু রিয়ালিটি (নেতৃত্ব হলো স্বপ্নকে বাস্তব করে তোলার সক্ষমতা)। বঙ্গবন্ধু ঠিক এই কাজটিই করেছিলেন। তিনি বাঙালির মুক্তির স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি দারিদ্র্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল, উদার এক গণতান্ত্রিক কল্যাণরাষ্ট্রের স্বপ্নের আলো জ্বালিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাজ করতে হবে, আমাদের জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। বাঙালি জাতি যে প্রাণ, যে অনুপ্রেরণা নিয়ে স্বাধীনতাসংগ্রাম করেছিল সে প্রাণ, সেই অনুপ্রেরণার মতবাদ নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। দেশের দুঃখী মানুষকে মুক্তি দেওয়ার জন্য, তাদের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য। এ জন্য যারা যেখানে আছেন, যারা দেশকে ভালোবাসেন, সকলকে আমি আহ্বান করব আসুন দেশ গড়ি। আসুন দেশের মানুষের দুঃখ দূর করি।’ (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: জীবন ও রাজনীতি, পৃষ্ঠা ৯০৬)

আজ প্রয়োজন কর্মী মানুষের, যাঁরা দক্ষতা, সততা, ন্যায্যতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়বেন, যেখানে মানুষকে কষ্ট দেয় এমন সব অন্ধত্ব, উগ্রতা, জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে না। মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বপ্নের বীজ বুনে দিয়ে গেছেন। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ স্পর্শ করেছে সোনার বাংলার স্বপ্নকে। যেতে হবে অনেকটা পথ। এ পথ থেমে থাকার নয়। এ অঞ্চলের শত শত বছরের ইতিহাস বলে, এখানে মানুষ কখনোই উগ্রতা-অন্ধত্বকে প্রশ্রয় দেয়নি। গড়তে হবে সেই সমাজ, যে সমাজ মানুষকে ভালোবাসে, অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয় না। গড়তে হবে সেই সমাজ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্নে জাগ্রত আছে যে সমাজ।

পৃথিবীর আদিকাল থেকে ষড়যন্ত্র নামক বিষয়টি গোত্রে, সমাজে, দেশে ঘাপটি মেরে আছে নানা রূপে। তেমনি ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ সফল হতে দিতে চায়নি এমন কিছু মানুষ ছিল। তারা স্পর্শকাতর বজ্রকঠিন ভাবাবেগকে হাতিয়ার করতে চেয়েছিল। তারা প্রশ্ন তোলে, বঙ্গবন্ধুকে চাও, না স্বাধীনতা চাও! জীবিত মুজিবকে চাইলে স্বাধীনতা নয়। যুদ্ধদিনের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমরা যদি বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মানচিত্র স্থাপন করতে পারি, তাহলে সেই স্বাধীন জাতি এবং নতুন রাষ্ট্রের মানচিত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রভাতসূর্যের মতো উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন। আমার স্থির বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানিদের কাছে নতি স্বীকার করবেন না। বাঙালি জাতির গলায় গোলামির শিকল পরিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে তিনি নিজে বরং ফাঁসির রজ্জু গলায় তুলে নেবেন হাসিমুখে। এটাই আমার বিশ্বাস। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে এটাই আমার ইমান। তাঁর সঙ্গে আমি ২৭ বছর রাজনীতি করেছি। তাঁকে আমি গভীরভাবে জানি। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছাড়া আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার আর কোনো বিকল্প নেই। বাঙালিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই স্বাধীনতা চাই। স্বাধীন বাংলাদেশ মানেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। পরাধীন বাংলায় বঙ্গবন্ধু ফিরে আসবেন না। জীবনের বিনিময়ে হলেও আমরা দেশকে স্বাধীন করব। যেকোনো কিছুর বিনিময়ে আমরা বাংলার মাটিকে দখলদারমুক্ত করব। বাংলার মুক্ত মাটিতে মুক্ত মানুষ হিসেবে বঙ্গবন্ধু মুজিবকে আমরা ফিরিয়ে আনব। তিনি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে ফিরে আসবেন। তাঁকে আমরা জীবিত অবস্থায় ফিরিয়ে আনব, ইনশা আল্লাহ। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণ রক্ষার জন্য বিশ্বমানবতার প্রতি আমরা আকুল আবেদন জানাচ্ছি।’ (সূত্র: তাজউদ্দীন আহমদের বিভিন্ন সময়ের বক্তৃতা, বিবৃতি ও তাঁর সম্পর্কে নেওয়া সাক্ষাৎকার)

বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রভাতসূর্য। তাঁর স্থান ইতিহাসে চিরভাস্বর। জাতীয় শোক দিবসে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি। একই সঙ্গে এই দিনে শাহাদতবরণকারী সবার আত্মার শান্তি কামনা করছি।

সিমিন হোসেন রিমি: সাংসদ; লেখক, সমাজকর্মী।

SUMMARY

1454-1.jpg