প্রাণবন্ত কামাল ভাই

পাভেল রহমান

পাভেল রহমান
আমি তখন সদ্য গোঁফ ওঠা এক কিশোর। স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর আগেই বাবার শখের ক্যামেরার বদৌলতে হয়ে উঠেছি পারিবারিক আলোকচিত্রী। স্বাধীনতার পরপর ছাত্র ইউনিয়নের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ছবি তুলতে ঘর ছেড়ে আমি সে সময় ক্যামেরা হাতে রাজপথে। আমার তোলা সেই ছবিগুলো ছাপা হচ্ছে ছাত্র ইউনিয়নের মুখপত্র জয়ধ্বনি পত্রিকায়। এর মধ্যে ছাত্র ইউনিয়নের ত্রয়োদশ জাতীয় সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আসা সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অভাবনীয় এক ছবি উঠে এল আমার ক্যামেরায়। পরে ওই ছবিই হয়ে উঠল জাতির জনকের নিরাপত্তাবিষয়ক কালজয়ী এক ছবি। ফলে কী হলো, এই একটি ছবিই বদলে দিল আমার জীবনের রসায়ন। ছবিটির কারণে সাপ্তাহিক একতার সেই সময়ের সম্পাদক মতিউর রহমান (বর্তমানে প্রথম আলো সম্পাদক) আমাকে আলোকচিত্রীর চাকরি দিলেন স্কুলজীবনেই।

একতায় আমার অ্যাসাইনমেন্ট পড়ল বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে, তাঁর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে। আর সেখানেই দেখা হয়ে গেল বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল ভাইয়ের সঙ্গে। প্রথম সাক্ষাতেই আমাকে আবাহনী ক্রীড়াচক্রের আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করার আমন্ত্রণ জানালেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, সেই সন্ধ্যায় আবাহনীর আলোকচিত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচয়ও করিয়ে দিলেন। বঙ্গবন্ধুকে বললেন, ‘আব্বা, ও আবাহনীর ফটোগ্রাফার, ওর নাম পাভেল!’ আবাহনীর আলোকচিত্রীর নাম পাভেল শুনে বঙ্গবন্ধুর বিস্ময় যেন কাটে না।

৪৩ বছর পর আজও ওই সন্ধ্যার সেই স্মৃতি আপ্লুত করে আমাকে। অবাক হই এই ভেবে যে আমার মতো নগণ্য আলোকচিত্রীকে কামাল ভাই সেদিন কীভাবে এত সম্মানিত করেছিলেন! কেন করেছিলেন?


সুন্দর একটা মন ছিল কামাল ভাইয়ের। যে মনে সদা অঙ্কুরিত হতো নিত্যনতুন ভাবনা। আর সেই ভাবনার ফলে আমরা সংগঠিত হয়েছি আবাহনীতে, স্পন্দনে, নাটকের মঞ্চে, একুশে ফেব্রুয়ারিতে—আরও কত জায়গায়! এভাবেই কামাল ভাই হয়ে উঠেছিলেন আমার আপনের চেয়ে বেশি। ঢাকা কলেজে ভর্তির সুবাদে শেখ জামাল সহপাঠী হলেও কামাল ভাইয়ের সঙ্গেই ছিল আমার সখ্য।

স্বাধীনতার পর মুক্তিসংগ্রাম-স্নাত দেশে অস্থির যুবসমাজের মধ্যে খেলাধুলার এক নতুন দিগন্তের উন্মোচক শেখ কামাল। তিনি গড়ে তুলেছিলেন আবাহনীর মতো ক্রীড়া সংগঠন। একসময়ের প্রচণ্ড প্রতাপশালী ফুটবল ক্লাব মোহামেডানকে পেছনে ফেলে আবাহনী ক্রীড়া চক্রকে নতুন ধারার ফুটবল-গৌরবের উচ্চাসনে বসিয়েছিলেন কামাল ভাই-ই। আবাহনীর কেতন কোথায় না উড়েছে! ফুটবল, হকি, ক্রিকেট, টেবিল টেনিস—সর্বত্রই আবাহনীর জয়জয়কার! সাফল্যের চূড়ান্তে ট্রিপল ক্রাউন লাভে উৎফুল্ল হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুও।

কামাল ভাইয়ের সঙ্গে আমার স্মৃতির শেষ নেই। আবাহনী ফরিদপুর শাখার উদ্বোধন উপলক্ষে আমরা চলেছি ফরিদপুর। প্রতিবারের মতো এবারও আমি কামাল ভাইয়ের নীল টয়োটায়। আমাদের বহরে পাঁচটি গাড়ি। কামাল ভাইয়ের নিরাপত্তায় আছেন বাচ্চু ভাই। বাচ্চু ভাই একাধারে আবাহনীর অর্থ সম্পাদক, আবার বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা দলের একজন সদস্য। তিনি যেমন সুদর্শন, তেমনি তাঁর গোঁফ আর জুলফি জোড়াসহ দেখতেও দারুণ সুপুরুষ। আর এর উল্টো দিকে কামাল ভাই হ্যাংলা-পাতলা। আছে শুধু গোঁফ। ভোরে ঢাকা থেকে ফরিদপুরের উদ্দেশে রওনা হয়ে আরিচায় পৌঁছলাম সকাল সাতটায়। অপেক্ষা করছি ফেরির জন্য। এরই ফাঁকে খবর ছড়িয়ে পড়েছে, বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল এসেছেন ফেরিঘাটে। হকার, ক্ষুদ্র ফেরিওয়ালাদের ভিড় লেগে গেল। ভিড় বাড়ল স্থানীয় মানুষজন আর যাত্রীদেরও। কামাল ভাই গাড়িতে বসে আছেন। হকারদের অনুরোধ একটাই, রাজার (বঙ্গবন্ধু) ছেলে যেন তাঁদের এই ভালোবাসা গ্রহণ করেন। কামাল ভাই সব সময়ই খানিকটা কৌতুকপ্রিয়। এখানেও কৌতুক করে বাচ্চু ভাইকে সবার সঙ্গে তিনি পরিচয় করিয়ে দিলেন শেখ কামাল হিসেবে। বললেন, ‘এই যে আপনাদের রাজার ছেলে।’ সবাই বাচ্চু ভাইয়ের দিকে এগিয়ে গেল ডাব আর কলা নিয়ে। ততক্ষণে কামাল ভাই তাঁর বিখ্যাত গোঁফের নিচ দিয়ে কৌতুকের হাসি হাসছেন। ওদিকে বাচ্চু ভাই অসহায়। সে এক দৃশ্য বটে!

জীবনের শেষ একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমিতে শেখ কামালের (ডানে) নাট্যাভিনয়, ১৯৭৫। ছবি: পাভেল রহমান
জীবনের শেষ একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমিতে শেখ কামালের (ডানে) নাট্যাভিনয়, ১৯৭৫। ছবি: পাভেল রহমান
কিছুক্ষণ পর ফেরি এল এবং কামাল ভাইয়ের জন্য নির্ধারিত ‘বিশেষ’ এই ফেরিটি আমাদের মাত্র পাঁচটি গাড়ি নিয়েই ছেড়ে দিল। ফলে ফেরিতে রয়ে গেছে প্রচুর খালি জায়গা। ব্যাপারটা চোখ এড়াল না কামাল ভাইয়ের। ফেরিটা তাৎক্ষণিক ঘাটে ফেরাতে বললেন তিনি; আর অপেক্ষমাণ যাত্রীদের বাসসহ যে কয়টা প্রাইভেট ট্যাক্সি নেওয়া যায়, তুলে নিতে বললেন সেগুলো।

ফরিদপুরে সারা দিন নানা আলোচনা, কমিটি গঠন ইত্যাদি শেষে ঢাকায় ফেরার পথে আনন্দ হলো অনেক। এমনিতে দেশজ গান ভালোবাসতেন কামাল ভাই। তখনকার একটা জনপ্রিয় গান ছিল, ‘পাগলার মন নাচাইয়া, পাগলি গেল চলিয়া, পাগলার মন ঘরে থাকে না রে পাগলি...’। কামাল ভাইয়ের বন্ধুরা এর মধ্যেই গানটির প্যারোডি করে ফেলেছেন। প্যারোডির পাত্র-পাত্রী কামাল ভাই আর খুকী ভাবি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত ক্রীড়াবিদ সুলতানা আহমেদ খুকী, মানে আমাদের খুকী ভাবির সঙ্গে কামাল ভাইয়ের বিয়ে তখন প্রায় চূড়ান্ত। এই বিয়ে নিয়ে কামাল ভাইয়ের বন্ধুদের মধ্যে আগ্রহের শেষ নেই। প্যারোডি গানের কলিগুলো এমন: ‘কামালের মন নাচাইয়া, খুকী গেছে চলিয়া, কামালের মন ঘরে থাকে না রে...’। সেদিন রাতের ফেরিযাত্রাটির পুরোটাই ছিল গানে গানে মাতোয়ারা। গান ধরলেন কামাল ভাইও। কোনো বাদ্যযন্ত্র ছিল না, কেবল হাতের তালিতে গানের মূর্ছনায় আমরা ভীষণ আনন্দ করলাম কামাল ভাইকে ঘিরে। ওই ভ্রমণে আমি ছবিও তুলেছিলাম অনেক।

কামাল ভাইয়ের গায়েহলুদ আর বিয়ের অনুষ্ঠানে অনেক হই-হুল্লোড় করেছিলাম আমরা। গণভবনে নববধূকে দেখতে আয়োজন করা হয়েছিল ঘরোয়া এক অনুষ্ঠানের। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্রের জন্য কনে দেখার পর্বটি ছিল অতুলনীয়। কামাল ভাইয়ের জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল পিতামাতা, ভাইবোনের সঙ্গে নিজের বিয়ের আনন্দ ভাগ করে নেওয়া।

১৯৭৫ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি, কামাল ভাইয়ের শেষ একুশে ফেব্রুয়ারি। ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন একীভূত হয়ে নতুনভাবে জাতীয় ছাত্রলীগ নামকরণ হয়েছে। তো, একুশে ফেব্রুয়ারি উদ্‌যাপনের জন্য কামাল ভাইয়ের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সমন্বয়ে তৈরি করা হলো স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। তিনি নিজে দায়িত্ব নিলেন কীভাবে শহীদ মিনারের পাদদেশে শ্রদ্ধা জানাতে আসা জনতাকে ঠিকমতো গাইড করতে হবে, সে ব্যাপারটি দেখভালের। টিএসসির সুইমিং পুলে ট্রেনিং হলো স্বেচ্ছাসেবকদের।

সব মিলে ১৯৭৫ সালের একুশের শহীদ মিনারের বেদিটি হয়ে উঠেছিল দর্শনীয়, সুশৃঙ্খল। বলার অপেক্ষা রাখে না, এর পুরো কৃতিত্বই ছিল কামাল ভাইয়ের।

তিনি ছিলেন শাস্ত্রীয় সংগীতেরও এক অনুরাগী শিক্ষার্থী। ছিলেন ছায়ানটের ছাত্র। ওস্তাদ ফুল মোহাম্মদের কাছে ধানমন্ডির বাড়িতে তালিম নিলেও পিয়ানোর প্রতি ছিল তাঁর দারুণ আগ্রহ। কামাল ভাইয়ের তিনতলার ঘরে ছিল বাদ্যযন্ত্রের সমাহার। সাতসকালের তালিমের পর তিনি তাঁর প্রিয় নীল টয়োটায় ছুটতেন শংকরের আবাহনী ক্লাবে আর ধানমন্ডির আবাহনীর প্র্যাকটিস মাঠে। কখনো কখনো তাঁর সঙ্গী হতাম আমিও। আবাহনীর খেলোয়াড়দের সঙ্গে তিনি অংশ নিতেন ফুটবল খেলায়।

কামাল ভাই খেলতেন ক্রিকেটও। আউটার স্টেডিয়ামে নিয়মিত ব্যাট হাতে সাদা হ্যাট পরে নামতেন। তাঁর দিনের প্রথম ভাগে ছিল সংগীত, ফুটবল, ক্রিকেট; আর শেষ ভাগে, অর্থাৎ সন্ধ্যায় তিনি ব্যস্ত থাকতেন মঞ্চে—নাটকের অভিনয়ে। তাঁর অভিনীত নাটক নিয়ে গিয়েছিলেন ভারতে। কলকাতার মঞ্চে মুনীর চৌধুরীর বিখ্যাত কবর নাটক মঞ্চায়ন করেন তিনি। অভিনয়প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন বাংলা একাডেমি মঞ্চেও।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর শেখ কামাল ছিলেন প্রাণবন্ত আর অমায়িক ব্যবহারের এক টগবগে যুবক। সহপাঠী থেকে শিক্ষক, ছোট থেকে বড়—সম্মান করতেন সবাইকে। তাঁর ছিল না কোনো দাম্ভিকতা।

শেখ কামাল—কামাল ভাই আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর ঋণ আমি কী করে শোধ করব? আজও খুঁজে ফিরি এই প্রশ্নের উত্তর।

পাভেল রহমান: শেখ কামালের সহচর, আলোকচিত্রী।

SUMMARY

1450-1.jpg