তোফায়েল আহমেদ
১৯৭১-এর ১৫ মার্চ । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে লাগাতার অসহযোগ আন্দোলনের চতুর্দশ দিবসের আজ ছিল দ্বিতীয় পর্যায়ের অষ্টম দিবস। আজকের দিনটিও শান্তিপূর্ণ সভা-শোভাযাত্রা, সরকারি, আধা-সরকারি অফিস-আদালত বর্জনের মাধ্যমে অতিবাহিত হয়। এ ছাড়া স্বাধিকার আন্দোলনে নিহত বীর শহীদদের উদ্দেশে শোক এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে তোয়াক্কা না করে একতরফাভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে সর্বত্র কালো পতাকা উত্তোলিত থাকে। গত ১৩ মার্চ জারিকৃত ১১৫নং সামরিক আইন আদেশে সরকারি কর্মচারীদের আজ কাজে যোগদানের নির্দেশ প্রদান করা হলেও কোনো বিভাগের কোনো কর্মচারী কাজে যোগ দেননি। বরং তারা সামরিক আদেশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল করে এবং নাখালপাড়ায় এক প্রতিবাদ সভা করে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত অসহযোগ কর্মসূচির প্রতি পুনর্বার একাত্মতা ঘোষণা করেন।
উল্লেখ্য, জেনারেল ইয়াহিয়া খানের এমএলআর অর্থাৎ মার্শাল ল রেগুলেশনস অমান্য করে সামরিক বিভাগের অধীন অর্ডন্যান্স ডিপোর প্রায় ১১ হাজার কর্মচারীর কেউই আজ কাজে যোগদান করেননি। সরকারি কর্মচারীরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের এএলআর অর্থাৎ আওয়ামী লীগ রেগুলেশনস অনুযায়ী তাদের কর্মসূচি পালন করে। বস্তুত বাংলাদেশ তখন এমএলআরের বিপরীতে এএলআর দ্বারা পরিচালিত হতে থাকে। অপরদিকে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১৫নং সামরিক আইনের বিরুদ্ধে বিকেলে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভায় স্বাধিকার আন্দোলনের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক সামরিক আইন প্রত্যাহারের দাবির মুখে নতুন করে জারিকৃত ১১৫নং সামরিক বিধি প্রত্যাখ্যান করে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। প্রস্তাবে বলা হয়, 'বাংলাদেশে কেবল বাংলার সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই কোনো নির্দেশ জারি করতে পারেন এবং বাংলার জনসাধারণ কেবল সেই বিধিই মেনে চলবে। কেননা, বঙ্গবন্ধু সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির নির্বাচিত নেতা।' এদিন সকালে শহীদ মিনারে পাকিস্তান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ স্বাধিকার আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু ঘোষিত কর্মসূচির প্রতি পূর্ণ একাত্মতা ঘোষণা করেন। বিকেলে তোপখানা রোডে কবি সুফিয়া কামালের সভাপতিত্বে পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদের উদ্যোগে এক নারী সমাবেশের আয়োজন করা হয়। এ সমাবেশ থেকেও বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত সব কর্মসূচির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করা হয়। সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের পক্ষ থেকে প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
অসহযোগের পক্ষে গণজাগরণ বেগবান করতে বাংলার শিল্পীসমাজ খোলা ট্রাকে নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অনুষ্ঠান করে। এদিকে ঢাকা নগরীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভুয়া স্বেচ্ছাসেবকরা গোলযোগ তৈরির চেষ্টা করলে এদিন আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান আবদুর রাজ্জাক এক বিবৃতিতে বলেন, 'কিছু সংখ্যক দুস্কৃতকারী আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর পোশাক ও টুপি নকল করে জনসাধারণের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে। এসব দুস্কৃতকারীকে ধরে আওয়ামী লীগ অফিসে প্রেরণ করতে অনুরোধ জানানো যাচ্ছে।' বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ বাস্তবায়নকল্পে দেশ থেকে অর্থ ও সম্পদ পাচার বন্ধ করার লক্ষ্যে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ রাজধানী ও দেশের বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্ট স্থাপন করে। যানবাহন ও সাধারণ জীবনযাত্রার ব্যাঘাত ঘটায় আগামীকাল মঙ্গলবার থেকে তা প্রত্যাহার করার নির্দেশ দেওয়া হয় এবং একই সঙ্গে বলা হয়, 'চেকপোস্ট প্রত্যাহার করা হচ্ছে ঠিকই, তবে বাংলাদেশ থেকে কোনোক্রমেই যাতে অর্থ-সম্পদ পাচার না হয়, সেদিকে জনসাধারণকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।' স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃচতুষ্টয় এক বিবৃতিতে বলেন, 'আমরা জানতে পারলাম, এখনও কিছু সংখ্যক দুস্কৃতকারী বর্তমান সংগ্রামের সুযোগে গাড়িতে অস্ত্রশস্ত্র, পিস্তল, রিভলভারসহ বিভিন্ন গৃহে হামলা চালিয়ে টাকা-পয়সা আদায় করছে; আমরা স্বাধীনতাকামী জনগণকে উক্ত গাড়ি ও লোকদের ধরে পুলিশের হাতে সোপর্দ করার আহ্বান জানাই।' সারাদেশে অসহযোগের সুযোগে কেউ যাতে কোনো প্রকার বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে না পারে, সেদিকে ছিল আমাদের সজাগ দৃষ্টি। আজ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ এক বিবৃতিতে বলেন, 'বাংলাদেশের জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল আন্দোলন আজ এক নয়া পর্যায়ে প্রবেশ করেছে।'
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন শুরু করার আহ্বান জানিয়েছিলেন, তাতে জনগণের নিরঙ্কুশ সাড়া পাওয়া গেছে। ফলে সব সরকারি বিভাগসহ সর্বস্তরের নাগরিক এই গণআন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে এবং বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আমরা যেসব নির্দেশ জারি করেছি, তা মেনে চলার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করছে। সব পক্ষের চাপের মুখে আজ বিকেলে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার উদ্দেশ্যে ঢাকা আগমন করেন। উল্লেখ্য, সর্বাত্মক অসহযোগের ফলে প্রেসিডেন্টের আগমনকে কেন্দ্র করে সামরিক প্রশাসক নজিরবিহীন নিরাপত্তা গ্রহণ করে। আগামীকাল মঙ্গলবার থেকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রেসিডেন্টের সম্ভাব্য আলোচনা শুরু হবে- এমন পূর্বাভাস আগেই পাওয়া গিয়েছিল বিধায় বঙ্গবন্ধু তাঁর সহকর্মী টিম সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে স্বীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। গতকাল দেওয়া এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু যা বলেছিলেন অর্থাৎ 'জনগণের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম এগিয়ে চলছে। সমগ্র বিশ্বে যারা মুক্তিকামী এবং জাতীয় মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে চলছে, তারা আমাদের দাবিকে তাদের নিজেদের দাবি বলে গ্রহণ করেছে। যারা শক্তি দ্বারা শাসন করার চক্রান্ত করে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের দুর্গ তৈরি করতে কতটুকু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন, আমাদের জনগণ তা প্রমাণ করেছে। আজ বাংলাদেশের নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে প্রত্যেকেই মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার যোগ্যতা অর্জন করেছে।'
সর্বাত্মক অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের সংগ্রামী চেতনা আমাদের এ রকম একটি আত্মপ্রত্যয়ী জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান করে তুলেছিল, নেতার নির্দেশে আমরা প্রত্যেকেই ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র
অথবা পরিপূর্ণ স্বাধীনতার লক্ষ্যে স্থির-প্রতিজ্ঞ ও অবিচলভাবে নিষ্ঠার সঙ্গে নিজেদের প্রাত্যহিক-দৈনন্দিন রাজনৈতিক কার্যসূচি পালন করেছিলাম।