তোয়াব খান
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তো সাধারণ মানুষ নন। অনন্যসাধারণ, মহানায়ক—হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি।
আমি মনে করি, হাজার বছরের মধ্যে বাঙালির জীবনে কোনো দিন স্বাধীন রাষ্ট্র হয়নি। বাঙালির প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু, বাঙালির সহস্র বছরের স্বাধীন রাষ্ট্রীয় সত্তার প্রতিষ্ঠাতা। সেই হিসেবে তিনি মহানায়ক, মহান রাষ্ট্রনায়কও। অর্থাৎ রাষ্ট্রনায়কের যে গুণাবলি প্রয়োজন হয় একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের মানবগোষ্ঠীকে তার স্বাধীন সত্তায় প্রতিষ্ঠিত করতে, তার সব গুণই বঙ্গবন্ধুর মধ্যে দেখা গিয়েছিল বলেই আজকে তাঁর এই অভিধা।
বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠা
এটা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এই ভারতীয় উপমহাদেশটাই ছিল ব্রিটিশের উপনিবেশ। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যাঁরা আন্দোলন করেছেন, অর্থাৎ স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন, এ রকম মানুষের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন একটা প্রক্রিয়া চলেছে। সেই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই যাঁরা এসেছেন, তাঁরা সবাই কিন্তু এভাবে একটি সাধারণ নেতৃত্বের পর্যায় থেকে একেবারে মহান নেতার পর্যায়ে পৌঁছেছেন। বঙ্গবন্ধুও তা-ই। সর্বোপরি এ দেশের দুখী-দরিদ্র মানুষের জন্য তাঁর নিরন্তর ও নিরলস সংগ্রাম এবং দাবি আদায়ে দীর্ঘ কারাবাসের মুখে দৃঢ় মনোবল তাঁকে করে তুলেছিল জীবন্ত কিংবদন্তি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনধারাই গড়ে উঠেছিল এমনভাবে, যেটা গোপালগঞ্জের সাধারণ গ্রামাঞ্চল থেকে শুরু হয়ে একেবারে কলকাতা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। প্রথমে গ্রামে, গ্রামের স্কুল, গ্রামের মানুষ, গ্রামের লোকজনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক। তাদের ভালো, মন্দ-সুখ-দুঃখের সঙ্গী হওয়া। এসবের মধ্য দিয়ে একটা নেতৃত্বের বিকাশ ঘটেছে। সেটাই একটি মার্জিত রূপ ধারণ করে, যখন মহানগরী কলকাতায় ছাত্র আন্দোলনে তিনি আত্মনিয়োগ করেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে থাকতে থাকতে যে যোগ্যতা ও গুণাবলি গড়ে উঠেছিল, তার একটা পরিশীলিত অর্থাৎ নাগরিক চরিত্রের রূপ তাঁর মধ্যে আসতে থাকে। এভাবেই তিনি নেতৃত্বে আসেন।
স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর সেই সময়ের রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আবেগাপ্লুত বঙ্গবন্ধু, ১০ জানুয়ারি ১৯৭২। ছবি: অমিয় তরফদার
দেশভাগের পর কলকাতা থেকে তাঁর ঢাকায় আগমন। ঢাকায় এসে মুসলিম লীগের শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বলেছেন, ঢাকায় এসে তাঁদের প্রথম কাজই ছিল সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আন্দোলন করা। সাম্প্রদায়িকতা একদিকে যেমন সামন্ত-চিন্তার ফসল, অন্যদিকে তেমনি খুবই পশ্চাৎপদ ধ্যানধারণা, যেটাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান আন্দোলনটা গড়ে উঠেছিল। পাকিস্তানের এই চিন্তাভাবনা, ধ্যানধারণা এবং রাষ্ট্রনীতি, এর বিরুদ্ধে তাঁরা প্রথম আন্দোলন শুরু করেন। বঙ্গবন্ধুই বলেছেন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাঁদের বলেছিলেন, তোমাদের কিছুই করতে হবে না, আগে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, হিন্দু-মুসলমান খুনোখুনি বন্ধ করার চেষ্টা করো। অর্থাৎ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ে তোলার চেষ্টা করো।
বস্তুত, মধ্যযুগীয় যে ধ্যানধারণা, ধর্মের ভিত্তিতে ভাগাভাগি এবং তারই জন্য লড়াই; তার বিপরীতে নাগরিক জীবনের জন্য রাজনীতির সংগ্রাম, অর্থাৎ রাজনৈতিকভাবে নিজেদের মধ্যে বিরোধ থাকতে পারে, কিন্তু ধর্মের কারণে নয়। এটাই শেষ পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়ায় ধর্মনিরপেক্ষতা বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে।
শুরুর দিকে অর্থাৎ ১৯৪৮-৪৯ সালে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের দিকে তাকালে দেখা যায়, ওই সময় কিন্তু একটি সংগঠন তাঁরা গড়ে তুলেছিলেন। সেটা বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, তাঁরা যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। গণতান্ত্রিক যুবলীগ। এই যুবলীগে অনেকেই ছিলেন। তখন তাঁরা সবাই একটা প্রশ্নেই লড়াই করেছেন—সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। ওই সময় দেখা যায়, যুবলীগ শুধু সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে নয়, আরও অনেক কিছুতে সম্পৃক্ত ছিল। যেমন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তাঁদের অংশগ্রহণ ছিল। বঙ্গবন্ধু বারবার উল্লেখ করেছেন, এ দেশের প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার লোকজন যাঁরা ছিলেন, তাঁরা তাঁদের ধ্যানধারণা বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারতেন না, অর্থাৎ মূল বাস্তবতার কাছাকাছি তারা পৌঁছাতে পারতেন না। তিনি বলতে চেয়েছেন, প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার দিক দিয়ে যাঁরা তৎকালীন নেতৃত্বে ছিলেন, তাঁদের কথাবার্তা, স্লোগান আর কর্মসূচিগুলো মানুষের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি করতে পারেনি। বরং মাথার ওপর দিয়ে চলে গেছে। কিন্তু যাঁরা আরও নিচের তলা থেকে, অর্থাৎ জনগণের কাছে থেকে ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে আন্দোলন করেছেন, তাঁরাই ওপরে উঠেছেন।
বঙ্গবন্ধু আসলেই বাংলার সাধারণ মানুষের নাড়ির স্পন্দনটা বুঝতে পেরেছিলেন। মুসলিম লীগের শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে দুটো বিষয় কাজ করত। একটা হচ্ছে, সাধারণ মানুষের চিন্তাভাবনা এবং তাদের যে দুঃখ, কষ্ট, দুর্দশা; তা থেকে মুক্ত করার জন্য কর্মসূচি গ্রহণ। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, সাহসিকতা। অর্থাৎ সাহস করে মানুষকে আন্দোলনের পথে নিয়ে আসা। স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হলে যে সাহস ও দৃঢ় মনোবলের দরকার হয়, সেটা অর্জন করা। এই ক্ষেত্রে দেখা যায়, শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রনেতা, যুবনেতা এবং তিনিই আওয়ামী লীগের একজন নেতা, যিনি প্রতিটি ক্ষেত্রে সেই সময়কার অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রসর ছিলেন। মানুষের কাছেও তিনি দ্রুত পৌঁছে যেতে পারতেন।
গণভবনের লেকের পাড়ে মাছ ধরছেন বঙ্গবন্ধু। পেছনে প্রেসসচিব তোয়াব খান। ছবি: সংগৃহীত
আওয়ামী লীগের নেতা শামসুল হক ১৯৪৯ সালে প্রথম উপনির্বাচনে জিতে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্রদের মিটিং চলছে, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে কি না তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আমার নিজের পরিষ্কার মনে আছে, শামসুল হক সাহেব বারবার বলেছিলেন, আপনারা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করবেন না, তাহলে ওরা রক্তগঙ্গা বইয়ে দেবে। তিনি বারবার এটা বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ওই ছাত্রসভায় আমার যত দূর মনে পড়ে আবদুল মতিন—যিনি ভাষা মতিন নামে খ্যাত—প্রস্তাব দেন, চারজন করে বেরিয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করুন। শামসুল হক সাহেবকে সেখানে রীতিমতো অপদস্থ হতে হয়। শেখ মুজিবুর রহমান তখন হাসপাতালে কারারুদ্ধ ছিলেন। ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে সিদ্ধান্ত নেয় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের। কিন্তু যে রাজনৈতিক নেতারা এই আন্দোলনের জন্য সর্বদলীয় ভাষাসংগ্রাম পরিষদ করেছিলেন, তাঁরা ওই রাতে আবার এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু জেলখানা থেকে শেখ মুজিবুর রহমান হাসপাতালে থাকা অবস্থায় অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন। জনগণ যদি কোনো আন্দোলনে এগিয়ে যায়, তখন কোনো নেতা যদি সেখান থেকে পিছিয়ে পড়েন বা থেমে যান, তাহলে তিনি কিন্তু জনগণের আস্থা হারান এবং নেতৃত্বে থাকেন না। শেখ মুজিবুর রহমান জীবনে কোনো দিন এই ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দেননি।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনের আগে নানা টানাপোড়েনে একপর্যায়ে যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যাচ্ছিল। সেই টালমাটাল সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান যুক্তফ্রন্টের পক্ষে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়ে দাঁড়িয়ে যান। আবার ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর যখন মুসলিম লীগ বা পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী আদমজীতে দাঙ্গা লাগায়, সেই দাঙ্গা প্রতিরোধের জন্য সবার আগে এগিয়ে এসেছিলেন একজন, তিনি শেখ মুজিবুর রহমান। অর্থাৎ মানুষের সংগ্রাম ও আন্দোলনের পর্যায়গুলো এভাবে যদি আমরা দেখি, তাহলে দেখব শেখ মুজিবের একটি অগ্রণী ভূমিকা সব ক্ষেত্রেই পাওয়া যায়। অর্থাৎ এই অগ্রণী ভূমিকার জন্য শেখ মুজিব ক্রমান্বয়ে বঙ্গবন্ধুতে রূপান্তরিত হয়েছেন। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সংগ্রামী ছাত্র–জনতা তাঁকে শুধু আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধুরূপে অভিষিক্ত করেছে।
জনগণের মন ও চাহিদা বুঝতে পারা এবং বুঝে উপযুক্ত কর্মসূচির মাধ্যমে এগিয়ে আসা—এটাই নেতৃত্বের বড় যোগ্যতা। এই ক্ষেত্রে শেখ মুজিবুর রহমান কোনো দিন ব্যর্থ হননি। আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের পর বহুবার চেষ্টা করেছে দুর্নীতির দায়ে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে মামলা করার, তাঁকে কারাগারে আটকে রাখার। কিন্তু প্রমাণ করতে না পেরে ছেড়ে দিতে হয়েছে। জেল থেকে বেরিয়ে এসেছেন তিনি। এসেই আবার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের বৈষম্য ব্যাপক, সর্বক্ষেত্রে পূর্বাঞ্চল বঞ্চিত। এবং এ অঞ্চলের মানুষের জন্য এটা একটা বড় বিষয়। ১৯৪৭-এ পাকিস্তান যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, বাংলার গর্ভনর তখন ব্রিটিশ সরকারকে জানিয়েছিলেন, এই যে দুই টুকরো পাকিস্তান হচ্ছে, এর পূর্ব অংশ কিন্তু ২০ বছরের বেশি এই পশ্চিম অংশের সঙ্গে থাকবে না। দেখা গেছে, এটা ২৫ বছরের মধ্যে স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে গেছে। এই যে পূর্বাঞ্চল বঞ্চিত এবং পশ্চিমের সঙ্গে থাকতে পারবে না, এই ধারণা বঙ্গবন্ধুর মধ্যে শুরু থেকেই ছিল।
একটা কথা তিনি প্রায়ই বলতেন, আমরা তাঁর সঙ্গে কাজ করতে গিয়েও দেখেছি, যেখানে ভূখণ্ডের সম্মিলন নেই; সে ক্ষেত্রে দেশটাকে টিকিয়ে রাখা খুব কঠিন। যেকোনো দেশের ঐক্য ও জনগণের সংহতির ক্ষেত্রে একটা বড় ‘ফ্যাক্টর’ বা উপাদান হচ্ছে, দুই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে মোবিলিটি অর্থাৎ আসা-যাওয়া এবং এর সম্মিলন; বিশেষত, মোবিলিটি অব লেবার। অর্থাৎ শ্রমিকেরা যদি এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে কাজ করার জন্য যেতে না পারে, অর্থনৈতিক যোগসূত্র, অর্থনীতির যে চালিকাশক্তি—যা বিভিন্ন অঞ্চলকে ঐক্যসূত্রে গেঁথে রাখে, সেটা আর থাকে না। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের ব্যবধান যেহেতু ১ হাজার ১০০ মাইল, তাই মোবিলিটি অব লেবারও নেই, এটা করাও সম্ভব না। সে জন্য ওই সময় সবাই বলত, দুই পাকিস্তানের যোগসূত্র বলতে দুটি—পিআইএ (পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স) আর সোহরাওয়ার্দী। আর কিছুই নেই।
ভারত এত বড় দেশ, তারা একসঙ্গে থাকে কীভাবে? থাকে, কারণ দেশটির এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে লোকে যাচ্ছে। শ্রমিকেরা কাজ করতে যাচ্ছে। এর ফলে একটি অর্থনৈতিক যোগসূত্র গড়ে ওঠে, যেটা পাকিস্তানের ছিল না। এই যে ছিল না বা না থাকা—এই অবস্থায় দুই অঞ্চলের আলাদা হয়ে যাওয়াটাই অবধারিত। এ জন্য বঙ্গবন্ধু প্রথম চেষ্টা শুরু করেন আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের পরে। এই সময়ে তিনি বিভিন্ন দলের নেতাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছেন। আলোচনা চালিয়েছেন। এর প্রমাণ পার্টির গোপন দলিলে আছে। বঙ্গবন্ধু মণি সিংহ, খোকা রায়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এটা (বিভক্তি) না করলে কিছু হবে না। কমিউনিস্ট নেতারাও একমত হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা বলেছিলেন, এটাই ঠিক। তবে সময় এখন এসেছে কি না তাঁরা নিশ্চিত নন। বামপন্থী নেতারা যখন ঠিক বুঝতে পারছেন না যে সময় এসেছে কি না, শেখ মুজিব তখন ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন, সময় যদি এখন না-ও এসে থাকে, সময়কে আনতে হবে।
সে অনুযায়ী কর্মপন্থা নিয়ে এগিয়ে গেলেন তিনি। এটাই বড় জিনিস। নেতৃত্বের গুণে সব জায়গায় নেতারা ‘মহান’ নেতায় রূপান্তরিত হয়ে যান। যেমন মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী মহাত্মা গান্ধী হয়েছেন। আবার নেলসন ম্যান্ডেলা হয়েছেন মাদিবা, জেলে থেকে একের পর এক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে। লেনিনের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। অর্থাৎ নেতৃত্বের দূরদৃষ্টি ও বলিষ্ঠতা—এ দুটো না থাকলে কোনো দিন মহান নেতা হওয়া যায় না।
রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু
১৯৭১-এর আলোচিত ও সুপরিজ্ঞাত হলো, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়ই ছিলেন পাকিস্তানের জেলে। কিন্তু তাঁর আহ্বানে এবং সেই অর্থে নেতৃত্বে, মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। আমার মতে, মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় উপাদান ছিল বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ। এই এক ভাষণ বারবার প্রচারের মাধ্যমে লাখ লাখ সৈনিক যা করতে পারেনি, তা-ই করা গেছে। অতএব তিনি ছিলেন সেই অর্থে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের সর্বাধিনায়ক।
শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকায় ফিরে আসার পর গণতান্ত্রিক দেশ গড়ায় তাঁর যে দায়বদ্ধতা, সেটা কিন্তু পরদিন ১১ জানুয়ারিই বোঝা গেছে। তিনি রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করে নিলেন প্রধানমন্ত্রীর পদ, যা পাকিস্তানের ইতিহাসে কোনো দিন হয়নি। পাকিস্তানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রথম দিনই গভর্নর জেনারেল হয়েছেন। এটা একটা বৈশিষ্ট্য। দ্বিতীয়ত, এরই সূত্র ধরে বঙ্গবন্ধু বলেছেন যে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে আমি গণতান্ত্রিক নীতি অনুসরণ করব। এই গণতান্ত্রিক নীতিগুলো ক্ষেত্রে কী কী হতে পারে, সেগুলো বারবারই এসেছে। যেমন নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচনে কীভাবে হয়েছে—যেভাবে আমাদের এই সমাজব্যবস্থায় সব নির্বাচন হয়। এবং নির্বাচনে ব্যতিক্রমও থাকে। তবে সাধারণভাবে দেখা যায়, নির্বাচনে নানা ‘ফ্যাক্টর’ থাকে, এই ‘ফ্যাক্টরগুলো’ নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করে। ব্যতিক্রম ’৫৪ সালের নির্বাচন ও ’৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন। কিন্তু অন্য সব নির্বাচনে কোনো না কোনো ‘ফ্যাক্টর’ ছিল।
বঙ্গবন্ধু এসে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য আত্মনিয়োগ করলেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার, একটি দেশ মুক্তিযুদ্ধ করেছে, নয় মাস ধরে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুয়ায়ী, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে ইউরোপে যে ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছিল, তার চেয়েও ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছিল বাংলাদেশে। দেশের দুটো বন্দরই ছিল অচল। সব রেললাইন অকেজো। সব সেতু ভাঙা। এই অবস্থায় একটা দেশকে গড়ে তোলা দুরূহ কাজ। এখানে অবধারিতভাবে আর্থিক দৈন্য, খাদ্যাভাব ও সংকট—এগুলো দেখা দেয়। কখনো খাদ্যাভাবে দুর্ভিক্ষও হয়। চীন, রাশিয়ায় এমন হয়েছে। অন্য যেসব দেশে বিপ্লব হয়েছে, সব জায়গারই ছিল এক অবস্থা।
খুব স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশেও এমন হওয়ার কথা ছিল; এবং একেবারে যে হয়নি, তা-ও নয়। তবে ’৭২ বা ’৭৩-এ কিন্তু হয়নি। হয়েছে ’৭৪ সালে। কারণ, যে বৃহৎশক্তি পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা করেছে, তারা তখন আর্থিক দিক থেকে বাংলাদেশ যেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারে, খাদ্যসংকট যাতে দূর না হয়, তার জন্য ব্যবস্থা নিয়েছে। তারা আসা বন্ধ করে দিয়েছে খাদ্যের জাহাজ। হেনরি কিসিঞ্জার বঙ্গবন্ধুকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছিলেন, আমরা তো এক লাখ টন পাঠিয়েছি। আরেক লাখ টন খাদ্য পাঠাচ্ছি। কিন্তু সেই জাহাজ আর আসেনি। এ দেশে এভাবেই বিপর্যয় সৃষ্টি করার চেষ্টা হয়েছে।
এ ক্ষেত্রে শাসক বঙ্গবন্ধুর জন্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শুধু এই আর্থিক দিকটাই বড় কথা নয়, দেখতে হবে শাসনতান্ত্রিক পরিকাঠামো কেমন ছিল, কী ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছিল করাচির মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন যেভাবে চলত, তার চেয়ে একটু উন্নত। অর্থ মন্ত্রণালয় ছিল না, সেন্ট্রাল ব্যাংকের কোনো কিছুই ছিল না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলতে ছিল না কিছু। তার চেয়ে বড় জিনিস হচ্ছে, এ রকম একটি রাষ্ট্রবিপ্লব—যুদ্ধ বা সংঘাতের পর দেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে সাংঘাতিক সমস্যা দেখা দেয়। দুনিয়ার সব জায়গায় দেখা দিয়েছে, দেখা দিয়েছে বাংলাদেশেও। সে ক্ষেত্রে পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিডিআর—অর্থাৎ যে প্রশাসনিক যন্ত্রের মাধ্যমে এর মোকাবিলা করা হবে, সেটা ছিল না এ দেশে। সবাই নির্ভর করত একজন ব্যক্তির ওপর। আমি নিজেও কতগুলো ক্ষেত্রে দেখেছি, তখন দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সবচেয়ে বড় ‘ফ্যাক্টর’ ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। একটা উদাহরণ দিই: তখন আমি বঙ্গবন্ধুর প্রেসসচিব হিসেবে যোগ দিয়েছি, তো একদিন গিয়ে শুনলাম, হঠাৎ ওয়াপদা ঘেরাও করা হয়েছে। কে করেছে? শ্রমিক লীগ। এখন ঘেরাও তুলে নেওয়ার জন্য যেতে হবে প্রধানমন্ত্রীকে। বঙ্গবন্ধু যখন ওখানে গেলেন, তখন ঘেরাও ওঠানো হলো।
এরপর একপর্যায়ে বিডিআরের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থান চলে গেল সেনাবাহিনী। কখনো-বা সেনাবাহিনী-বিমানবাহিনী মুখোমুখি অবস্থানে। সব ক্ষেত্রে তাঁকেই সশরীরে নিষ্পত্তি করতে হয়েছে। অর্থাৎ ব্যক্তি মুজিবের প্রভাব, বঙ্গবন্ধুর প্রভাব—একে সর্বোতভাবে কাজে লাগিয়ে সমস্যার সুরাহা করতে হয়েছে। ব্যক্তির অবদান এখানে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
চতুর্থ সংশোধনী নিয়ে অনেক কথা বলা হয়। বিশেষত, বাকশাল বিষয়ে। এটা একটা রাষ্ট্রব্যবস্থা। এ নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ-ও মনে রাখা দরকার, আমাদের দেশের ওই অবস্থায় কী করা প্রয়োজন ছিল। এগুলো বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-ভাবনায়ও ছিল। তবে এটা ঠিক, বাকশালকে স্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করেননি বঙ্গবন্ধু। তিনি সব সময় বলতেন, এটা অস্থায়ী এবং সময় এলে এটা ফিরিয়ে নেওয়া হবে। বাকশাল হওয়ার পরে যখন মন্ত্রিপরিষদ নতুন করে গঠন করা হয়, দেখা যায় প্রায় সব মুখই পুরোনো। নতুন তেমন কেউ নেই। অনেকেরই প্রশ্ন ছিল, এটা কী হলো? জবাবে একদিন বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘দেখ, সবাই তো বুদ্ধিমান। রাষ্ট্রচিন্তায় সব বড় বড় থিওরিটিশিয়ান। কিন্তু আমরা পার্লামেন্ট্রি ব্যবস্থা করেছি। পার্লামেন্ট্রি ব্যবস্থার মতোই করেছি রাষ্ট্রপতির পদটাকে। সংসদ সার্বভৌম রয়ে গেছে। পার্লামেন্টের সদস্যরা ইচ্ছে করলে রাষ্ট্রপতিকে না করে দিতে পারে। আমি যদি আজকে এখানে পুরোনো সবাইকে বাদ দিয়ে নতুন নতুন লোক নিয়ে মন্ত্রী করি আর কালকে এরা আমার বিরুদ্ধে নো কনফিডেন্স মোশান নিয়ে আসতে পারে?’ এটা সর্বজনবিদিত, পার্লামেন্ট তখনো সার্বভৌম। যদিও সেই রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী তখন প্রেসিডেন্ট।
১৫ আগস্ট, ১৯৭৫
আমার মতে, বাকশাল গঠনের সঙ্গে ১৫ আগস্টের প্রত্যক্ষ কোনো সম্পর্ক নেই। যারা এটা ঘটিয়েছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা তারা আগেও করেছিল। চক্রান্ত আগে থেকেই ছিল। আরও পরিষ্কার করে বলা যায়, পাকিস্তান কোনো দিনই চায়নি বাংলাদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক। চক্রান্ত তারা নানাভাবেই করেছে। আর এই ষড়যন্ত্রে যাদের কথা এসেছে, তাদের মধ্যে দুজন রশিদ ও ফারুকের নাম সব থেকে বেশি আলোচিত। এরা দুজন কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা ছিল না। এদের মুক্তিযোদ্ধা বলা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। কারণ, তারা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয় অনেক পরে। এবং সেই অর্থে তাদের মুক্তিযোদ্ধা বলা যায় না।
ষড়যন্ত্রটা তারা শুরু করে একাত্তরের সেপ্টেম্বর থেকেই। কারণ, ওই সময় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেও তারা যুদ্ধক্ষেত্রে আসেনি, ছিল কলকাতাতেই। পরে এসে নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা বলেছে। আমাদের দেশে সাধারণভাবে যা ঘটে—এখানে পারিবারিক সম্পর্ক একটা বড় বিষয়। যেহেতু দেশটা ওই সময় কিছুটা সামন্ততান্ত্রিক আর কিছুটা পুঁজিবাদী অবস্থায় ছিল। কমিউনিকেশন থিওরিতে একটা কথা বলে, সেটা হচ্ছে সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ইন্টারপারসনাল কমিউনিকেশন হচ্ছে সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর। অর্থাৎ আত্মীয়তার সম্পর্ক বড় হয়ে দাঁড়ায়। এখানে ফারুক ও রশিদ দুজনেরই আত্মীয়স্বজন বেশি ও প্রভাবশালী লোকজন ছিলেন। তাদের এই চক্রান্তটা আগে থেকেই চলছিল। এবং বাকশাল হওয়ার পরে তারা আর্মিতে অসন্তোষ সৃষ্টি করার চেষ্টা করছিল।
তখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নানা দল ছিল। ছিল দৈনিক পত্রিকার ছড়াছড়ি। প্রত্যেকে প্রত্যেকের মতো করে লিখে যাচ্ছে নিজের ইচ্ছেমতো। একজন লিখল, সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ মুজিবকে খতম করতে হবে। মাওলানা ভাসানী একটা সাপ্তাহিক কাগজ বের করতেন। নাম হককথা। ঢাকায় ছাপা হতো, টাঙ্গাইলেও ছাপা হতো। মাওলানা সাহেব তো বলেছিলেন, ৬২ হাজার কোটি টাকার অস্ত্র ছিল ক্যান্টনমেন্টে। সব ইন্ডিয়া লুট করে নিয়ে গেছে। তিনি এমন অনেক কথা বলতেন, যার কোনো ভিত্তিই ছিল না। কুষ্টিয়ায় ঈদের নামাজে আওয়ামী লীগের একজন এমপিকে গুলি করে মেরে ফেলা হলো। একদল গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলী সাহেবের বাড়িতে হামলা করল। এগুলো দমন বা মোকাবিলা করার মতো সেনা, পুলিশ থাকতে হয়, কঠোরভাবে দমনও করা যায়, এর কোনোটাই এ দেশে ছিল না।
সব থেকে বড় ফ্যাক্টর, যেটা বঙ্গবন্ধু নিজেও স্বীকার করতেন, আর্থিক দৈন্য, উৎপাদনের মন্দাভাব আর ব্যক্তিপর্যায়ে দুর্নীতি ও সন্ত্রাস। বঙ্গবন্ধু নিজেই বলতেন, ‘আমি যেগুলো নিয়ে আসি, সব খেয়ে ফেলে। যাকে দিই, সে-ই লুটপাট করে।’ তখন উনি বললেন, বাকশাল হলো দ্বিতীয় বিপ্লব। এই বিপ্লবের সাতটা স্লোগান ছিল। এর মূল যে তিনটি-চারটি স্লোগান, তা কিন্তু আজও কেউ বাতিল করতে পারেনি। যেমন এক. দুর্নীতির মূলোচ্ছেদ। দুই. জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, তিন. উৎপাদন বৃদ্ধি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছিল। ব্যবস্থা নেওয়া হয় জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করার। আর উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বিরাট আন্দোলন ও অভিযান শুরু হয়েছিল। বলাই ছিল ঢাকায় রাস্তার ধারে একখণ্ড পতিত জমি যদি পাও, সেখানেই তুমি ধান লাগাও। তখন ঢাকায় রাস্তার ধারে ধারে কিন্তু ধান চাষ করা হয়েছিল। এই উৎসাহ-উদ্দীপনা কৃষকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। প্রশাসনিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, যাতে ধানের চারা কৃষকের হাতে পৌঁছায়। ফলে দেশে ফসল ভালো হওয়ার খবর আসতে থাকে সবখান থেকে। সেই সময় পনেরোই আগস্টের ঘটনাটা ঘটেছে।
আমাকে এক সম্পাদক বলেছিলেন, আপনি কি মনে করেন কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়া ১৫ আগস্টে এটা করেছে তারা?
আমি বললাম, কেন?
তিনি বললেন, দেখুন, দেশ যখন উৎপাদন বৃদ্ধির মুখে, যখন ফসল উঠবেই আর দুই মাসের মধ্যে, ফসল উঠে গেলে খাদ্যের সমস্যা মিটে যাবে, মরিচ-লবণের দাম কমে যাবে, কমে গেলে তো আর শেখ মুজিবকে হত্যা করার কোনো গ্রাউন্ড আর থাকবে না। অতএব, যা করার এই সময়ের মধ্যে করতে হবে। এই হিসাবটা কম্পিউটারে ফেলে করা হয়েছে। অর্থাৎ আকার-ইঙ্গিতে এটাই বলা হচ্ছে যে যারা কম্পিউটারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, এ রকম রাষ্ট্রই এর পেছনে থাকার কথা।
এ দেশের শুরু থেকে এখনো পর্যন্ত সব থেকে বড় শত্রু হচ্ছে পাকিস্তান। পাকিস্তান কোনো দিনই চায়নি যে বাংলাদেশ একটি উন্নত, সমৃদ্ধিশালী রাষ্ট্র হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক। ভবিষ্যতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রব্যবস্থা যদি পরিবর্তন না হয়, এ রকমই তারা থাকবে। কারণ, এটাকে তারা রাজনীতির হাতিয়ার বলে মনে করে।
ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু
১৯৭৩ সালের মে মাসে বাসায় এসে জানতে পারলাম ইতিমধ্যে গণভবন থেকে দুইবার টেলিফোন এসেছে। আবার টেলিফোন এল। এক্ষুনি চলে আসুন, জরুরি দরকার আছে। গণভবনে পৌঁছালে সোজা নিয়ে যাওয়া হলো বঙ্গবন্ধুর বেডরুমে। দুপুরে খেয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। উনি বললেন যে দেখো, তোমাকে একটা কথা বলি। আমার একটা কাজ করে দিতে হবে। এই কাজটা যত তাড়াতাড়ি তুমি করতে পারবা, তত তাড়াতাড়ি তোমার ছুটি। আর যত দিন না হবে তত দিন তোমার এখানে থাকতে হবে। আজকেই জয়েন করো, যাও।
এই অবস্থায় ওখানে যোগ দিলাম। প্রথম কাজ ছিল বঙ্গবন্ধুর একটি বক্তৃতা লেখা। বক্তৃতা লেখার বিষয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, তুমি একা চলে আসবা। এসে কথাবার্তা বলবা। এই হচ্ছে সূত্রপাত। আমি ১৯৭৩ সালে যখন প্রথম সেখানে যাই, তখন নিতান্তই বহিরাগত ছিলাম। তারপর ক্রমে একেবারে কাছের লোক হিসেবে কাজ করতে পেরেছি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সবচেয়ে বড় পরিচয় প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, রাষ্ট্রনায়ক নয়, এগুলোর চেয়ে ব্যক্তি মুজিব বড়। তিনি নিজেকে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেখতেন না। যারাই তাঁর সঙ্গে কাজ করত, সবাই তাঁর নিজের লোক। ওভাবেই তিনি দেখতেন।
গণভবনের লেকের মাছ ছাড়া আছে। আমাকে বললেন, ‘দেখো, এই মাছগুলো আমি কখন আসব ওরা জানে। আসলে আমি খাবার দেব। তারপরে খেয়ে চলে যাবে।’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ স্যার, মাছেরা তো সব বুঝতে পারছে, আপনি আসছেন।’
তিনি বললেন, ‘অ্যাই, আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছিস নাকি।’ আমি বললাম, ‘কোনো দিন হয় এ রকম!’ এই কথাগুলো শুধু তাঁকেই বলা যেত।
আরেকবার লাহোর ইসলামিক সামিট প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বললেন, বাদশাহ ফয়সাল ও ইউএইর শেখ জায়েদ বলছেন, তুমি যত টাকা চাও, পাবে। ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী বা পাকিস্তানি সেনাকে ছেড়ে দাও।
ফিরে এসে একটা ক্লিমেন্সি ফরমান জারি করলেন। জেলে ছিল যারা, তাদের ছেড়ে দেওয়া হলো। ক্লিমেন্সির প্রথম যে ড্রাফটা ছিল তাতে সবাই ছাড়া পেয়ে যেত। তখন আমলারা খুব খুশি। এমনকি অনেক আওয়ামী লীগ নেতাও খুশি। একজন বললেন, সবুর ভাইয়ের টেলিফোনটা রেস্টোর করা দরকার। অমুক জায়গায় তাঁর বাড়িটা দখল হয়ে আছে। বঙ্গবন্ধু বলছেন, এগুলো করে দেওয়া যাবে। এখানে আমি, গাফ্ফার চৌধুরী আর এম আর আখতার মুকুল—আমরা তিনজন ছিলাম। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘সবাই দেখো। সবার আজকে খুব আনন্দের দিন। কেবল তিনজনের মুখে কোনো হাসি নেই।’
আমি বললাম, স্যার, হাসিটা কী করে আসবে! আমাদের মা-বোনদের যারা রেপ করেছে, তাদেরও ছেড়ে দিতে হবে। যারা বাড়িঘর জ্বালিয়েছে, তারাও ছাড়া পাবে। যে খুন করেছে, তাকেও ছাড়তে হবে।
সব শুনে বঙ্গবন্ধু আমলাদের বললেন, ‘তোমরা করো কী? আমাকে তো ডেনজারাস পথে নিয়ে যাচ্ছিলে।’ তখন ডেকে আবার সংশোধন করা হলো। এটা বলা সম্ভব হয়েছিল তিনি শেখ মুজিব বলে। তিনি বঙ্গবন্ধু বলে। তিনি জাতির পিতা বলে।
তোয়াব খান: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের (প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি থাকাকালে) প্রেসসচিব; উপদেষ্টা সম্পাদক, দৈনিক জনকণ্ঠ ।