আমরা তাঁকে ভালোবেসেছি


আনিসুজ্জামান

পনেরোই আগস্ট বললেই মনে ভেসে ওঠে একটা দৃশ্য। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে সিঁড়ির নিচে পড়ে রয়েছে রক্তাপ্লুত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মরদেহ। এ দৃশ্য প্রথম দেখেছিলাম বাংলাদেশ টেলিভিশনে। বঙ্গবন্ধু যে আর নেই, সে-কথাটা জাতিকে বিশ্বাস করাতে এ-ছবি প্রচারিত হয়েছিল। তারপর এ-মর্মান্তিক দৃশ্য দেখেছি ভিডিওর ছবিতে, স্টিল ছবিতে, শাহাবুদ্দিনের আঁকা ছবিতে। আরও কেউ কেউ এ-ছবি আঁকার চেষ্টা করেছেন।

সেইসঙ্গে মনে পড়ে শেক্‌সপিয়ারের জুলিয়াস সিজার নাটকে রক্তাক্ত সিজারের মৃতদেহ সামনে রেখে জনগণের উদ্দেশে মার্ক অ্যান্টনির বক্তৃতা। ছুরিকার আঘাতে আঘাতে জর্জরিত সিজার পড়ে গেলেন কীভাবে, তার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলছেন: ‘আহ্‌, কী সে পতন! তার সঙ্গে আমি, তুমি, আমরা সকলে ভূপতিত হলাম।’ পনেরোই আগস্টে বঙ্গবন্ধুর যখন পতন হলো, তখন তিনি শুধু একা নন, বাংলাদেশের মানুষমাত্রই পতিত হয়েছিল।

আমরা তাঁকে ভালোবেসেছি (আবার মার্ক অ্যান্টনির কথা: ‘তোমরা তাঁকে একদা ভালোবেসেছিলে—অকারণে নয়’)। তার প্রধানতম কারণ তাঁরই নেতৃত্বে আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছিলাম। অথচ সেই আগস্টের ভয়াবহ দিনটায় আমরা প্রতিবাদে জ্বলে উঠতে পারিনি। বিচ্ছিন্নভাবে কেউ কেউ কোথাও কোথাও বিক্ষোভ করেছিল, হাতে তুলে নিয়েছিল অস্ত্র, কিন্তু সে আর কতজন! বিপুলসংখ্যক মানুষ কি ঘটনার আকস্মিকতা ও নির্মমতায় চলৎশক্তি হারিয়ে ফেলেছিল? আমাদের সমষ্টিগত স্মৃতিভ্রংশ হয়েছিল? না, আর কিছু?

এই মানুষটিকেই আমরা নেতা বলে জানতাম, নেতা বলে মানতাম। এক দিনে তো তিনি নেতা হয়ে যাননি। ১৯৪৭ সাল থেকে রাজনীতি করেছেন পূর্ব বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের জন্যে। নিজের জন্যে কিছু চাননি। মন্ত্রিত্ব লাভ করেও তা ত্যাগ করেছেন সংগঠন করবেন বলে। ১৯৪৮ সালের মার্চে প্রথমবার কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন, শেষবার ১৯৭১-এর মার্চে। এর মধ্যে প্রায় ১৬ বছর তিনি জেলে কাটিয়েছেন, একাকী আটক থেকেছেন রুদ্ধ কক্ষে; সামরিক কর্মকর্তার সঙ্গে এক ঘরে কাটিয়েছেন যখন তখনো তাঁর সঙ্গে কথা বলার অনুমতি ছিল না—এও তো একধরনের নির্জন কারাবাস। দুবার তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। একবারের কথা আমরা সবাই জানি—ইয়াহিয়া খান আয়োজিত প্রহসনমূলক মামলায় তাঁর মৃত্যুদণ্ড হয়। যে-ঘরে তিনি আটক ছিলেন, তার পাশেই খোঁড়া হয় তাঁর কবর—যাতে তিনি দেখতে পান, ভীত হন। ভয় কাকে বলে, তিনি তা জানতেন না। তাই যাদের হাতে বন্দি ছিলেন, তাদের বলেছিলেন, ‘আমার লাশটা যেন বাংলাদেশের মাটিতে শেষ আশ্রয় পায়।’

তার আগে, ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার এক নম্বর আসামিরূপে তিনি যখন বন্দি ছিলেন সেনানিবাসে, তখনকার কথা। আমাদের সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও রাষ্ট্রদূত অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গিয়াসউদ্দীন আহমদ চৌধুরী বীর বিক্রম আমাকে বলেছিলেন: বন্দি অবস্থায় বঙ্গবন্ধুকে তাঁর প্রকোষ্ঠের বাইরে বিকেলে বা সন্ধ্যায় হাঁটাতে নিত। পরিকল্পনা হয়েছিল, তাঁকে পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করে বলা হবে, তিনি পালাতে গিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে কর্তব্যরত এক অবাঙালি সামরিক অফিসার বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধাবশত তাঁকে এ-বিষয়ে সতর্ক করে দেন। বঙ্গবন্ধু সতর্ক হন। তাতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টা আঁচ করেন। এই অফিসার বদলি হয়ে যান তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে এবং অচিরে সেনানিবাসের মধ্যেই আততায়ীর গুলিতে নিহত হন।

এই বর্ণনার সমর্থন পাই বঙ্গবন্ধুর কারাগারের রোজনামচায়: ‘আমাকে সন্ধ্যার পরে আলো বন্ধ করে মেস এরিয়ার বাইরে একটা রাস্তায় বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হতো। একজন অফিসার আমার সঙ্গে হাঁটতো আর দু’জন মিলিটারী রাস্তার দুইদিকে পাহারা দিত। কোনো যানবাহন চলাচল করতে পারত না। রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হতো। কয়েকদিন বেড়াবার পরে আমার একটু সন্দেহ হলো। মেস এরিয়ার মধ্যে এত জায়গা থাকতে আমাকে বাইরে বেড়াতে নেওয়া হচ্ছে কেন?

দু’একজনের ভাবসাবও ভালো মনে হচ্ছিল না। একটা খবরও আমি পেলাম। কেহ কেহ ষড়যন্ত্র করছে আমাকে হত্যা করতে। আমাকে পেছন থেকে গুলি করে মেরে ফেলা হবে। তারপর বলা হবে পালাতে চেষ্টা করেছিলাম, তাই পাহারাদার গুলি করতে বাধ্য হয়েছে। যেখানে আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হতো জায়গাটা মেসের বাইরে। জনসাধারণ বা অন্য কাউকে দেখাতে পারবে যে আমি ভেগে বাইরে চলে গিয়েছিলাম তাই গুলি করা হয়েছে। আমি যে ষড়যন্ত্রটা বুঝতে পেরেছি এটা কাহাকেও বুঝতে না দিয়ে বললাম, এরিয়ার বাইরে বেড়াতে যাবো না। আমি ভিতরেই বেড়াব। ষড়যন্ত্রকারীরাও বুঝতে পারল যে আমিও বুঝতে পেরেছি।’

যাঁকে দুবার চেষ্টা করেও পাকিস্তানিরা মারতে পারল না বা মারতে সাহস করল না, তাঁকে হত্যা করল তাঁর দেশেরই সন্তানেরা—যে-দেশবাসীকে তিনি খুব বেশি ভালোবাসতেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ তো ছিল তাঁর স্নেহভাজন। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে এদের বুকে কাঁপন লাগেনি, সেই মহীরূহকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে তাদের আজ্ঞাবহদের হাত কাঁপেনি! আর যারা তাদেরকে সূর্যসন্তান বলে অভিনন্দিত করেছিল, দিয়েছিল রাষ্ট্রীয় উচ্চপদ, প্রতিবন্ধকতা স্থাপন করেছিল তাদের বিচারের পথে—ইতিহাস তাদেরও ক্ষমা করেনি, করবে না কো‌নো দিনও।

SUMMARY

1447-B11.jpg