মহিউদ্দিন আহমদ
বাংলাদেশ, আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক সুতোয় বাঁধা পড়েছে। কয়েকটি নদী যখন এক মোহনায় মিশে যায়, তখন তাদের জলের ধারা আলাদা করা যায় না। তবে শেখ মুজিব একদিনে তৈরি হননি। তিনি হঠাৎ কোনো চায়ের স্টলে বা প্রেসক্লাবে ঘোষণা দিয়ে নেতা হননি। তেমন কোনো পারিবারিক পরম্পরাও ছিল না। তিনি উঠে এসেছিলেন একেবারেই মাটি থেকে। তাঁর নিজের ভাষায় বলা চলে, তিনি রীতিমতো ‘চোঙা ফুঁকে’ রাজনীতিবিদ হয়েছেন। তাঁর সারা শরীরেই ছিল নরম মাটির গন্ধ। আর মানুষকে জানা-বোঝার জন্য ছিল অসম্ভব ঘ্রাণশক্তি। দুই দশকের রাজনীতির পরিক্রমায় তিনি জনতার চোখে নায়ক হয়ে উঠলেন। হলেন আশা-ভরসার প্রতীক, আইকন।
আওয়ামী লীগ জন্ম নেওয়ার চার বছরের মাথায় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে তিনি দলের অন্যতম নিয়ন্ত্রক হতে পারলেও তাঁর পরিপূর্ণ উত্থানটি ঘটেছিল তাঁর রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর। ১৯৬৪ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন ঘটিয়ে তিনি আর পেছন ফিরে তাকাননি। ১৯৬৮ সালের নভেম্বরে ঢাকা কলেজের ছাত্ররা ভালোবেসে তাঁকে নাম দিয়েছিল বঙ্গবন্ধু। ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ থেকে মুক্ত হওয়ার পর ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (এখন নাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত জনসভায় তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধু হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। একদা মজিবর রহমান, শেখ মুজিব কিংবা মুজিবুর রহমান হয়ে উঠলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর নেতৃত্বে বাঙালিরা এককাট্টা হলেন।
বাঙালির জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সবচেয়ে বেশি জরুরি ছিল একধরনের উচ্চাকাঙ্ক্ষী জাতীয়তাবোধ তৈরি করা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এটা করতে পেরেছিলেন। জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তাঁর নিজের একটি সংজ্ঞা আছে। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে ‘সংবিধান বিল’ পাস হওয়ার পর সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে এক আবেগপূর্ণ ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘এই যে জাতীয়তাবাদ, সে সম্পর্কে আমি একটা কথা বলতে চাই। ভাষাই বলুন, শিক্ষাই বলুন, সভ্যতাই বলুন, আর কৃষ্টিই বলুন—সবকিছুর সঙ্গে একটা জিনিস রয়েছে। সেটা হলো অনুভূতি। এই অনুভূতি যদি না থাকে, তাহলে কোনো জাতি বড় হতে পারে না এবং জাতীয়তাবাদ আসতে পারে না। অনেক জাতি দুনিয়ায় আছে, যারা বিভিন্ন ভাষাবলম্বী হয়েও এক জাতি হয়েছে। অনেক দেশে আছে, একই ভাষা, একই ধর্ম, একই সবকিছু নিয়ে বিভিন্ন জাতি গড়ে উঠেছে—তারা এক জাতিতে পরিণত হতে পারেনি। জাতীয়তাবাদ নির্ভর করে অনুভূতির ওপর।’
বিস্ময়ের কথা, বাঙালির আরেক দিকপাল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একই কথা বলে গেছেন শেখ মুজিবের জন্মের এক শ বছর আগে। বাংলা ১৩০৮ সনের শ্রাবণ মাসে ‘নেশন কী’ প্রবন্ধে তিনি বলেছিলেন, ‘সুগভীর ঐতিহাসিক মন্থনজাত নেশন একটি মানসিক পদার্থ, তাহা একটি মানসিক পরিবার...জাতি ভাষা বৈষয়িক স্বার্থ ধর্মের ঐক্য ও ভৌগোলিক সংস্থান নেশন নামের মানস পদার্থ সৃজনের মূল উপাদান নহে।...অতীতের গৌরবময় স্মৃতি ও সেই স্মৃতির অনুরূপ ভবিষ্যতের আদর্শ—একত্রে দুঃখ পাওয়া, আনন্দ করা, আশা করা—এগুলোই আসল জিনিস, জাতি ও ভাষার বৈচিত্র্য সত্ত্বেও এগুলোর মাহাত্ম্য বোঝা যায়; একত্রে মাসুলখানা স্থাপন বা সীমান্ত নির্ণয়ের অপেক্ষা ইহার মূল্য অনেক বেশি।’
একই ভাষণে বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিয়ে প্রশ্ন তোলার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়ে শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘মেহেরবানি করে আগুন নিয়ে খেলবেন না।’ দেশে আগুন নিয়ে খেলার লোকের অভাব ছিল না। জাতীয়তাবাদের কথা সংবিধানে এবং মাঠে-ময়দানে জারি থাকলেও তার ব্যাখ্যা পাল্টে যেতে খুব বেশি সময় লাগেনি। শেখ মুজিবের ঘোষিত অনুভূতি ‘অবিভাজ্য’ ছিল না। চার বছরের মাথায় সেটা প্রমাণিত হয়েছিল।
একাত্তর সালে এই দেশটা লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল। একটা ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে শেখ মুজিব রাষ্ট্রের হাল ধরেছিলেন। কিন্তু তাঁর কণ্ঠে ছিল শান্তি ও সংহতির সুর। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটা ডজ ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে সমবেত লাখ লাখ মানুষের সামনে তিনি উচ্চারণ করলেন গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি অঙ্গীকার। পাকিস্তানের উদ্দেশে বার্তা দিলেন, ‘তোমরা আমার লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছ, মা-বোনদের বেইজ্জত করেছ, অগুনতি বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছ, এক কোটি লোককে ভিটেছাড়া করে ভারতে যেতে বাধ্য করেছ; তার পরও মনের মধ্যে তোমাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পুষে রাখতে চাই না। তোমরা স্বাধীন থাকো, আমাদের স্বাধীনভাবে থাকতে দাও। তোমাদের সঙ্গে সব চুকেবুকে গেছে।’
শেখ মুজিব সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চেয়েছিলেন। যথেষ্ট কারণ থাকা সত্ত্বেও মনের মধ্যে প্রতিহিংসা পুষে রাখেননি। পাকিস্তানের সঙ্গে অতীতের তিক্ততা ভুলে স্বাভাবিক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তাঁর বাড়িয়ে দেওয়া হাতটি পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো গ্রহণ করেননি। ‘পাকিস্তান ভাঙা’র ক্ষত পাকিস্তানিদের মনে রয়ে গেছে এখনো।
১৯৭৩ সালের ১৫ জুলাই জাতীয় সংসদে সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতে গণহত্যাজনিত, মানবতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধ ও আন্তর্জাতিক আইনের অধীন অন্যান্য অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের ব্যবস্থা করার সুযোগ তৈরি হয়। ৩০ নভেম্বর সরকার ‘দালাল’ আইনে আটক ব্যক্তিদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে। ৩৪ হাজার ৪০০ জন আটক ব্যক্তি ছাড়া পান। বিজয় দিবসের প্রাক্কালে ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭৩ বেতার ও টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে শেখ মুজিব বলেন, ‘আমরা প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধ গ্রহণের নীতিতে বিশ্বাসী নই। তাই মুক্তিযুদ্ধের শত্রুতা করে যারা দালাল আইনে অভিযুক্ত ও দণ্ডিত হয়েছিলেন, তাদের সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়েছে। দেশের নাগরিক হিসেবে স্বাভাবিক জীবনযাপনে আবার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, অন্যের প্ররোচনায় যারা বিভ্রান্ত হয়েছেন এবং হিংসার পথ গ্রহণ করেছেন, তারা অনুতপ্ত হলে তাদেরও দেশ গড়ার সংগ্রামে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে।’ দেশ গড়ার লক্ষ্যে জাতীয় ঐক্য তৈরি করার প্রত্যয় ছিল এই ভাষণে।
সাধারণ ক্ষমার আওতায় মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যারা যুক্ত, তাদের রাখা হয়নি। বাংলাদেশ ১৯৫ জন পাকিস্তানিকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচারের ব্যাপারে অটল থাকে। ভাবাবেগ দিয়ে জনগণের মধ্যে উন্মাদনা তৈরি করা যায়, কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়টি একেবারেই আলাদা। এ জন্য পদে পদে আপস করতে হয়। শেখ মুজিব দ্বিতীয় পথটিই বেছে নিয়েছিলেন। ৯ এপ্রিল ১৯৭৪ দিল্লিতে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যকার ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি ও সম্প্রীতি গড়ে তোলার স্বার্থে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাতিল করে দেওয়া হয়।
চুক্তি সই করার পর দিল্লি থেকে ফিরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করেন। শেখ মুজিব ছিলেন বিষণ্ন। কামাল হোসেনকে তিনি বলেছিলেন, ‘বাঙালিরা উদারতা দেখিয়েছে। এই অঞ্চলে একটা নতুন ধারা সৃষ্টির জন্য আমরা সর্বোচ্চ ছাড় দিয়েছি। কিন্তু আমি ভাবছি, জীবনে প্রথমবারের মতো জনগণকে দেওয়া ওয়াদা রাখতে পারলাম না। আমি বলেছিলাম, বাংলাদেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে। আমি আমার কথা রাখতে পারিনি। আশা করি, এই সিদ্ধান্ত আমাদের জনগণের জন্য ভালো কিছু নিয়ে আসবে।’ শেখ মুজিবের আশাভঙ্গ হয়েছিল। তিনি সমঝোতার জন্য উদ্যোগ নিলেও ভুট্টো তাঁকে নিরাশ করেছিলেন। এমনকি দেশের মধ্যেও তিনি বৈরী সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন।
একটা জাতিকে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দেওয়ার ক্ষেত্রে একাত্তরের ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল অনন্য। শেখ মুজিব তাঁর রাজনৈতিক পথচলার বছরগুলোতে অনেক বক্তৃতা দিয়েছেন। তবে মর্মবস্তুর বিচারে ১৯ জুন ১৯৭৫ ঢাকায় বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বৈঠকে শেখ মুজিব সম্ভবত তাঁর সেরা ভাষণটি দিয়েছিলেন। ওই ভাষণে ভবিষ্যতের একটা রূপকল্প ছিল।
এ দেশে অনেক কিছুর ঘাটতি থাকলেও ‘বিপ্লবীর’ অভাব নেই। প্রত্যেক ‘বিপ্লবী’ই নিজেকে অভ্রান্ত এবং অন্যদের ভ্রান্ত বা বিভ্রান্ত মনে করেন। শেখ মুজিবকে তাঁরা কখনোই ‘বিপ্লবী’র কাতারে ঠাঁই দেননি। শেখ মুজিব কদাচিৎ নিজেকে বিপ্লবী বলে আস্ফালন করেছেন। ১৯ জুনের বক্তৃতার একপর্যায়ে ‘বিপ্লব’ সম্পর্কে তিনি তাঁর ধারণা খোলামেলাভাবে তুলে ধরেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘বিপ্লব কাকে বলা হয়? পুরানো রীতি, যেটা দেশের মঙ্গল না করে সেই রীতি বদলানোর মত সৎসাহস থাকা প্রয়োজন; পুরানো আইন, যে আইন দেশের মঙ্গল না করে সেই আইনের পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করার অধিকার জনগণের রয়েছে।...উপনিবেশবাদীরা দেশকে শোষণ করার জন্য যে সিস্টেম দেশের অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের মধ্যে চালু করে গিয়েছিল, সেই অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সেই সিস্টেম সেই আইন, সেই সব কিছু পরিবর্তন করার নামই বিপ্লব।...ঘুণে ধরা এই শাসনব্যবস্থাকে ভেঙ্গে চুরমার আমি করতে চাই। বর্তমানে ঘুণে ধরা বিচারপদ্ধতিকে ভেঙেচুরে জনগণ যাতে তাড়াতাড়ি বিচার পায়, সে রকম ব্যবস্থা আমি নতুন করে করতে চাই। আমার এই নতুন সিস্টেমই একটা বিপ্লব।...ব্রিটিশ আমলের সেই ঘুণে ধরা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সিস্টেম দিয়ে বাংলার মানুষের মঙ্গল হতে পারে না। ইট মাস্ট গো।...আই ওয়ান্ট মাই আর্মি—এ পিপলস আর্মি। আই ডু নট ওয়ান্ট মাই আর্মি টু ফাইট এগেইনস্ট অ্যানিবডি, বাট আই ওয়ান্ট মাই আর্মি টু ডিফেন্ড মাই সেলফ অ্যান্ড অ্যাট দ্য সেম টাইম টু ওয়ার্ক।’
শেখ মুজিব এখানেই থেমে থাকেননি। সমাজের সবার জন্য আচরণবিধির কথাও তিনি ওই ভাষণে উল্লেখ করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমাদের একটা ফ্যাশন হয়ে গেছে যে এ ওর বিরুদ্ধে গালাগালি করে, অন্য একজনের বিরুদ্ধে গালাগালি করে।...আই বিলিভ ইন পজিটিভ অ্যাপ্রোচ, নট এ নেগেটিভ অ্যাপ্রোচ। সে জন্য আমার পার্টিতে যারা আপনারা আছেন, আসুন আমরা পজিটিভ অ্যাপ্রোচ নিই।’
শেখ মুজিব দেবতা ছিলেন না। তিনি ছিলেন ভূমিপুত্র, দেশের এক সাহসী সন্তান, যাঁর হাত ধরে একদিন এ জাতি জেগে উঠেছিল। তিনি আজ নেই। কিন্তু তাঁর কথাগুলো এখনো কত প্রাসঙ্গিক, কত অনুসরণীয়। তাঁর নামে হাজারো কালভার্ট, সেতু আর স্টেডিয়াম বানানোর চেয়ে অনেক বেশি সম্মানিত করা হবে তাঁকে, যদি আমরা তাঁর কথাগুলো গুরুত্ব দিয়ে বোঝার এবং মেনে চলার চেষ্টা করি। অথচ তাঁকে পণ্য বানিয়ে আমরা তাঁকেই বিতর্কিত করছি, দেশকে বিভক্ত করছি।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com