শেখ হাসিনার সেই মুখবন্ধ


পার্থ শঙ্কর সাহা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, তাঁর পরিবার ও জাতীয় চার নেতা হত্যার ঘটনায় ১৯৮০ সালে যুক্তরাজ্যে প্রথম অনুসন্ধান কমিশন গঠিত হয়। ওই অনুসন্ধান কমিশনের প্রতিবেদনটি ‘শেখ মুজিব মার্ডার ইনকোয়ারি: প্রিলিমিনারি রিপোর্ট অব দ্য কমিশন অব ইনকোয়ারি’ শিরোনামে পুস্তিকা হিসেবে লন্ডনের র‍্যাডিক্যাল এশিয়া পাবলিকেশনস থেকে ১৯৮২ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত হয়। এর মুখবন্ধ লিখেছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশে আইন করে বিচারের পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়ায় এ কমিটি গঠিত হয়। ব্রিটিশ এমপি ও আইনবিদ স্যার টমাস উইলিয়ামসের নেতৃত্বে কমিশনে আরও ছিলেন আয়ারল্যান্ড সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী শন ম্যাকব্রাইড, ব্রিটিশ এমপি ও আইনবিদ জেফরি টমাস এবং ব্রিটিশ আইনবিদ ও মানবাধিকারকর্মী অবরি রোজ। পুস্তিকাটিতে শেখ হাসিনার লেখা ভূমিকাটি হুবহু তুলে ধরা হলো:

‘আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং আমাদের পরিবারের সদস্যদের ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যা করা হয়। ওই বছরেরই ৩ নভেম্বর হত্যা করা হয় আমার বাবার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ চার রাজনৈতিক সহযোগীকেও। শেখ মুজিব বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি। তিনি ও তাঁর সহযোগীরা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছিলেন। তাঁরা ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ায় ব্রতী ছিলেন। তাঁদের হত্যাকারী ও ষড়যন্ত্রীদের মূল উদ্দেশ্য ছিল এসব মূল্যবোধকে বাতিল করে দিয়ে একটি সাম্প্রদায়িক সমাজ সৃষ্টি করা।

এসব মানুষকে হত্যা করা হয় একটি সামরিক অভ্যুত্থানের অংশ হিসেবে, যার মধ্য দিয়ে শিশু রাষ্ট্রটির গণতান্ত্রিক ধারার অবসান হয় এবং শুরু হয় সামরিক শাসন। এই হত্যাকাণ্ড নিঃসন্দেহে একটি বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অংশ ছিল। এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন তৎকালীন সামরিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রের শীর্ষ কিছু লোক। আর তাই বারবার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও বাংলাদেশের সরকার একজন হত্যাকারীকেও বিচারের মুখোমুখি করেনি। বস্তুত এসব হত্যাকারী ও তাদের সহযোগী ষড়যন্ত্রকারীরা সরকারের কাছ থেকে সুরক্ষা এবং সহযোগিতা পেয়ে এসেছে। এদের কাউকে কাউকে বিদেশে কূটনৈতিক মিশনে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অন্যরা দেশেই নানা সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। এভাবে অপরাধকে পুরস্কৃত করা হয়েছে।

হত্যার শিকার পরিবারের সদস্যরা বাংলাদেশে এর প্রতিকার চেয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। তবে তাঁরা ও যুক্তরাজ্যে তাঁদের গণতন্ত্রমনা সমর্থকেরা এ বিশ্বাসে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি থেকে সরা যাবে না। তাই তাঁরা বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার ও জেলখানার ভেতরে বিনা বিচারে আটক চার জাতীয় নেতার হত্যার বিষয়ে অনুসন্ধান করার জন্য একটি কমিশন গঠন করতে প্রথিতযশা কয়েকজন আইনজ্ঞের কাছে আবেদন জানান। ওই আইনজ্ঞদের সুনাম এবং ভাবমূর্তিই বলে দেয়, তাঁরা বিচারের ক্ষেত্রে যথার্থতার সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করবেন। আমরা আশা করি, এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও আইনের শাসনের অপব্যবহারের ফলে গত সাত বছর ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ধারা যেভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে; বিচারকদের তদন্তের ফলাফল সে বিষয়ে বিশ্ববিবেককে জাগ্রত করবে।

সারা বিশ্বের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার সমর্থন করা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ লালনকারী বিশ্বের সব সরকার ও জনগণের অধিকার এবং সেই সঙ্গে দায়িত্ব। এসব অধিকার লঙ্ঘিত হলে ক্ষোভ প্রকাশের জন্য সম্ভাব্য যেকোনো পন্থা তারা ব্যবহার করতে পারে। বাংলাদেশের সামরিক শাসক বিদেশি সরকার ও জনগণের সহায়তার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। তাই বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক ভাবধারা ফিরিয়ে আনার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বিশ্বজনমত এই হত্যাকারীদের বিচারের মুখোমুখি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।’ 

শেখ হাসিনা
সভাপতি
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
লন্ডন, ৩ নভেম্বর ১৯৮২

SUMMARY

1440-1.jpg

‘শেখমুজিব মার্ডার ইনকোয়ারি: প্রিলিমিনারি রিপোর্ট অব দ্য কমিশন অব ইনকোয়ারি’ শিরোনামে পুস্তিকার প্রচ্ছদ