১৫ আগস্টের কালরাত ও আজকের বাংলাদেশ


এম নজরুল ইসলাম

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। মাত্র তিন বছর সাড়ে সাত মাসের ব্যবধানে একটি স্বাধীন দেশের পরিচিতিই যেন পাল্টে গেল। পাল্টে গেল দেশের চিত্র। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি যিনি বীরের বেশে ফিরেছিলেন সদ্য স্বাধীন দেশে, পেয়েছিলেন বীরোচিত সংবর্ধনা। মানুষের ভালোবাসার সঙ্গে নিজের অশ্রুবিন্দুকে মিশিয়ে দিয়েছিলেন, সেই মহান নেতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলেন বিপথগামী কিছু সেনাসদস্যের হাতে। ১০ জানুয়ারির সকালটা ছিল বাঙালি জাতির কাছে এক সাগ্রহ অপেক্ষার সকাল—প্রিয় নেতা দেশে ফিরবেন। আর ১৫ আগস্টের সকালটা ছিল একেবারেই অন্যরকম বিষাদে মাখা। সবাই জানে, বাংলাদেশে সকাল আসে পাখির গানে; ভোরের আকাশ রাঙা হয় আবির মেখে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যেন পাখির কান্নার শব্দে ঘুম থেকে জেগে উঠেছিল বাঙালি জাতি। ভোরের পুব আকাশে আবির নয়, যেন মাখানো ছিল ছোপ ছোপ রক্ত। বাঙালির ইতিহাস এমনিতেই রক্তের অক্ষরে লেখা। সে দিনের সকালও যেন এসেছিল রক্তরাঙা হয়ে। সে রক্ত জাতির জনকের, তার প্রিয়তমা স্ত্রী ও প্রিয় সন্তানদের। কেমন ছিল সেই রাত—যে রাতে নিহত হলেন পিতা? কবি নির্মলেন্দু গুণ চমৎকার এক দৃশ্যকল্প এঁকেছেন তার কবিতায়। ‘সেই রাতের কল্পকাহিনী’ কবিতার চিত্রকল্প যেন পঁচাত্তরের এক রক্তাক্ত রাতকে স্পষ্ট করে দিচ্ছে বাঙালির মানসপটে। কবি লিখছেন— ‘তোমার ছেলেরা মরে গেছে প্রতিরোধের প্রথম পর্যায়ে,/ তারপর গেছে তোমার পুত্রবধূদের হাতের মেহেদি রঙ,/ তারপর তোমার জন্মসহোদর, ভাই শেখ নাসের,/ তারপর গেছেন তোমার প্রিয়তমা বাল্যবিবাহিতা পত্নী,/ আমাদের নির্যাতিতা মা।’

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। বাংলা সন পরিক্রমায় শ্রাবণের শেষ রাত। কেমন ছিল সে রাতের প্রকৃতি? সে রাতে কি বৃষ্টি হয়েছিল? আকাশ কি কেঁদে উঠেছিল সুশৃঙ্খল বাহিনীর শৃঙ্খলা ভেঙে বেরিয়ে আসা ঘাতকদের অস্ত্রের অট্টহাসি শুনে? আক্রোশে গর্জে উঠেছিল? সে রাতে কি কালো মেঘ ছিল আকাশজুড়ে? রাতের আকাশকে আলোয় বন্যায় ভরিয়ে দেয় যে চাঁদ, সে-ও কি মুখ লুকিয়েছিল মেঘের আড়ালে? রাহুর অশুভ ছায়া কি গ্রাস করেছিল অপরূপ জোছনাকে? জানা নেই আমাদের। তবে আমরা জানি, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে সূর্য উঠেছিল ঠিকই, কিন্তু সে দিনের সূর্য কোনো সম্ভাবনার কথা বলেনি? এক স্বপ্নভঙ্গের বিস্ময়-বেদনা নিয়ে শুরু হয়েছিল আমাদের দিন? আমরা কেউ তো ভাবতেই পারিনি, ১৫ আগস্ট সকালের সূর্য কোনো শুভ দিনের সূচনা নয়, একটি বেদনাবিধুর কালো ইতিহাসের জন্ম দিয়ে ফেলেছে। বাঙালির জাতীয় জীবনে অনেক কালো অধ্যায় আছে। কিন্তু ১৫ আগস্ট রাতে রচিত হলো যে কৃষ্ণ অধ্যায়, বাংলার ইতিহাসে তার চেয়ে বেদনার, এর চেয়ে গ্লানিকর আর কিছু নেই। নিজের বাড়িতে সপরিবারে নিহত হলেন জাতির জনক। জাতি পিতৃহীন হলো। যে জাতি মাত্র সাড়ে তিন বছর আগে বুকের রক্ত দিয়ে ছিনিয়ে এনেছে স্বাধীনতার সূর্য, সেই জাতিই কলঙ্কিত হলো পিতৃঘাতক হিসেবে।

চারদিকে গুলির শব্দ শুনেই নিশ্চয় ঘুম ভেঙেছিল জাতির পিতার। হয়তো ঘুমের ভিতর তিনি দেখছিলেন দেশের উন্নয়নের স্বপ্ন। ঘুম ভাঙার পর কী অনুভূতি হয়েছিল তার। কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতার ভাষায়, ‘তুমি কামান আর মৃত্যুর গর্জনে উঠে বসেছো বিছানায়,/ তোমার সেই কালো ফ্রেমের চশমা পরেছো চোখে,/ লুঙ্গির উপর সাদা ফিনফিনে ৭ই মার্চের পাঞ্জাবী,/ মুখে কালো পাইপ, তারপর হেঁটে গেছো বিভিন্ন কোঠায়।/ সারি সারি মৃতদেহগুলি তোমার কি তখন খুব অচেনা ঠেকেছিলো? তোমার রাসেল? তোমার প্রিয়তম পত্নীর সেই গুলিবিদ্ধ গ্রীবা?/ তোমার মেহেদিমাখা পুত্রবধূদের মুজিবাশ্রিত করতল?/ রবীন্দ্রনাথের ভূলুণ্ঠিত ছবি?/ তোমার সোনার বাংলা?’
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি দেশে ফিরেছিলেন নায়কের বেশে। পেয়েছিলেন বীরোচিত সংবর্ধনা। তাকে কেন প্রাণ দিতে হলো নিজের দেশে ঘাতকের হাতে? সদ্য স্বাধীন দেশ তখনো বিধ্বস্ত। মুছে ফেলা যায়নি যুদ্ধের ছাপ। ভেঙে যাওয়া অর্থনীতির চাকা সচল করার চেষ্টা চলছে। চলছে দেশকে নতুন করে গড়ার পরিকল্পনা। মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, সেই সময়ে কেন দেশের স্থপতিকে খুন করা হলো?

প্রণিধানযোগ্য বিশ্লেষণ দিয়েছেন সাংবাদিক ও কলামিস্ট আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী। তিনি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের নব্য ধনী, নতুনভাবে গড়ে ওঠা সিভিল এবং মিলিটারি ব্যুরোক্র্যাসি এবং তখন নিষিদ্ধ ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী এই ভেবে ভীত হয়ে ওঠে যে, শেখ মুজিব কেবল দেশের রাজনৈতিক মুক্তি অর্জন করেই ক্ষান্ত হবেন না, তিনি তার প্রতিশ্রুত অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার পথে এগোবেন। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে প্রচলিত আমলাতন্ত্রের কাঠামো ভেঙে প্রশাসনের একেবারে নিচুতলা থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বশীল শাসনের ব্যবস্থা করবেন। লুটেরা ধনিক শ্রেণিকে দমন করার লক্ষ্যে তিনি সমাজতন্ত্রের লাল ঘোড়া দাবড়াবেন। রাজনীতিতে সামন্তবাদী ধর্মীয় প্রভাব এবং ধর্মের নামে রাজনৈতিক ব্যবসা তিনি উচ্ছেদ করবেন। ফলে এই চক্রগুলো সংগঠিত হয় এবং স্বাধীনতার মূল লক্ষ্যগুলোসহ বঙ্গবন্ধুর সরকারকে উচ্ছেদের জন্য চক্রান্ত শুরু করে।’

১৫ আগস্ট বাঙালির জাতীয় শোক ও সন্তাপের দিন। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয় ১৯৭৫ সালের এই দিনে। পরিকল্পনা ছিল সুদূরপ্রসারী। শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা নয়, তার আদর্শকেও নির্বাসনে পাঠানোর গভীর ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। ঘাতকের বুলেট সে দিন ধানমন্ডির ওই বাড়িতে শেখ পরিবারের কাউকে রেহাই দেয়নি। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধু বা তার পরিবারের সদস্য ও ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, এ দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষীগত করে হত্যাকারীদের নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করেছিল, পুরস্কৃত করেছিল। খুনিদের রক্ষা করার জন্য দেশের সংবিধানেও হাত দেওয়া হয়েছিল। এই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের বিচার রহিত করা হয়েছিল ইনডেমনিটি আইন পাস করার মাধ্যমে। কাজেই এটা স্পষ্ট যে, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ঘটনা শুধু ব্যক্তি মুজিবকে হত্যার প্রয়াস ছিল না, ছিল জাতির স্বাধীনতার শক্তিকে হত্যার অপচেষ্টা। ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে খুন করে তারা একটি আদর্শকে খুন করতে চেয়েছিল। কিন্তু আজকের দিনে বঙ্গবন্ধু অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন পরীক্ষিত বাঙালি। বাঙালি জাতির মঙ্গল কামনায় উৎসর্গ করেছেন তিনি তার সারাটি জীবন। আজ ১৫ আগস্ট পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করি সেই মহান বাঙালিকে, যার পরিচয়ে বাঙালি পরিচিত।

আজকের দিনে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে সামনে রেখে এগিয়ে যেতে হবে। দেশ ও জাতিকে নিয়ে নতুন এক ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। জ্বালাও-পোড়াও রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে দেশ এখন নতুন এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে দেশ আজ সারা বিশ্বে উদীয়মান শক্তি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এই ধারায় দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখে অগ্রসর হতে হবে সামনের দিকে।

লেখক: অস্ট্রিয়া প্রবাসী লেখক, মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক।

SUMMARY

1439-1.jpg