বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ


একজন সন্তানের জন্মের সাথে তার পিতার সম্পর্ক যেমন থাকে, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের সাথে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। “সর্বকালের সর্ব শ্রেষ্ঠ বাঙালি” হিসেবে বিশ্বব্যাপী নন্দিত এক চরিত্র আমাদের বঙ্গবন্ধু। ডেভিড ফ্রস্টের সাথে এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “They have given everything for me because I was ready to give everything for them. I want to make them free. I have no objection to die. I want to see them happy. I become emotional when I feel the love and affection my people gave me.”

অর্থাৎ তারা তাদের সর্বস্ব দিয়েছিল কেননা তারা জানত আমি তাদের জন্য সর্বস্ব উজাড় করে দিতে প্রস্তুত ছিলাম। আমি তাদের মুক্ত করতে চেয়েছিলাম। আমি মৃত্যুর পরোয়া করিনি। আমি তাদের সুখী দেখতে চেয়েছিলাম। আমার মানুষের ভালোবাসা ও আন্তরিকতার কথা ভাবলে আমি আবেগতাড়িত হয়ে যাই।

রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্রষ্টা। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম শেখ লৎফুর রহমান ও মাতা সায়েরা খাতুন। ১৯৩৮ সালে গোপালগঞ্জ মহকুমা পরিদর্শনে আসা বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক ও খাদ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর উপস্থিতিতে কিশোর মুজিব স্কুলের ভাঙা ছাদ দিয়ে পানি পড়া বন্ধে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেই জনান দিয়েছিলেন যে, বাংলার ভাগ্যাকাশে আবির্ভূত হতে চলেছে এক নতুন সত্তার, এক নতুন ধূমকেতুর। এরপর থেকে রাজনীতির মঞ্চে তার উত্থান এবং সাফল্য সবই ইতিহাস। ভারতভাগের পর যুবনেতা শেখ মুজিব ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। ছাত্রলীগের পরিণতির সাথে-সাথে নিজের মেধা ও মানুষের জন্য কাজ করার প্রেরণা থেকেই উদ্বুদ্ধ বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে নিয়ে গেছেন স্বাধীনতার চূড়ান্ত রূপে।

পাকিস্তান পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে তিনি যখন ভাষণ দিতেন, তখন কখনোই পূর্ব-পাকিস্তান বলতেন না- বলতেন পূর্ব বাংলা। বাংলার বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের দাবিতেই তিনি তার জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন জেলের প্রকোষ্ঠে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ছাত্র শেখ মুজিব অনবদ্য ভূমিকা রাখেন। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা দিয়ে তিনি বাংলার মুক্তি সংগ্রামকে আরও বেগবান করেছিলেন। পাকিস্তানের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বাংলার জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করতে-করতে তিনি হয়ে ওঠেন বাংলার নয়নের মণি-সাধনার ধন।

মুকুটহীন সম্রাট বঙ্গবন্ধু
মার্কিন কূটনৈতিক অ্যার্চার ব্ল্যাড তার গ্রন্থে লিখেছেন, শেখ মুজিব ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের “মুকুটহীন সম্রাট।” তবে এই মুকুটহীন সম্রাট হয়ে ওঠার পেছনের ইতিহাসটা সবাই গভীরভাবে লক্ষ্য করে থাকবে। মানুষের দুঃখ-কষ্ট তাকে খুবই ভাবাতো। তিনি দুঃখী গরিবের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য কঠিন পণ নিলেন। তিনি ভাবলেন কীভাবে এ জাতির ভাগ্য রচনায় তিনি নতুন ব্যবস্থাপনা সৃষ্টি করবেন।

১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে ১২ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে দক্ষিণাঞ্চলে লাখ-লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। সপ্তাহব্যাপী ঘূর্ণিদুর্গত অঞ্চল ঘুরে ২৬ নভেম্বর ঢাকায় এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন, “বাংলাদেশ আজ জেগেছে। বানচাল করা না হলে বাংলার মানুষ নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের রায় ঘোষণা করবে। আর যদি নির্বাচন বানচাল করা হয়, ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে নিহত দশ লাখ লোক আমাদের ওপর যে দায়িত্ব অর্পণ করে গেছে তা সম্পাদনের জন্য স্বাধীন দেশের নাগরিকের মতো বাঁচার জন্য এবং আমারা যাতে নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য নিয়ন্তা হতে পারি, এর জন্য প্রয়োজনবোধে আরো দশ লাখ বাঙালি প্রাণ বিসর্জন দেবে।”

নির্বাচনে পূর্ব বাংলার ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন পেয়ে বঙ্গবন্ধুর দল পাকিস্তান পার্লামেন্টে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। তাছাড়া প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮ আসন লাভ করে বঙ্গবন্ধুর দল। এভাবে আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিব পূর্ববাংলার জনগণের একমাত্র মুখপাত্রে পরিণত হলেন।

একটি মানচিত্র আঁকলেন বঙ্গবন্ধু
বিশ্ব মানচিত্রে হাত দিলেন বঙ্গবন্ধু। পরিবর্তন করলেন মানচিত্রের। সংযুক্ত হলো বাংলাদেশের। পাকিস্তানি জনতা যখন ক্ষমতা হস্তান্তর করলো না, বাঙালির আত্ম-অধিকার নিয়ন্ত্রণের ভার যখন বাঙালি পেল না- জাতীয় পরিষদের অধিবেশন যখন মুলতবি হয়ে গেল, রাস্তায় নেমে এলো জনতা । বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় চলতে লাগলো বাংলাদেশ। ১০ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে ৭ মার্চ ১৯৭১ সালে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন স্বাধীনতা ‘অমর কাব্যখানি’।
কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায়-
“শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে 
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল’
হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাহার বজ্রকন্ঠ বাণী ? 
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি।

‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ 
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।”

১৫ মার্চ স্বাধীন দেশের সরকার প্রধানের মতো বঙ্গবন্ধু ৩৫টি নির্দেশ জারি করেন। ২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন। ২৫ মার্চ রাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তারই নামে দীর্ঘ নয়মাস যুদ্ধ করে ৩০ লক্ষ শহীদ ও দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবস। আবুল ফজল বলেন, “অনুপস্থিত সেনাপতির এমন সেনাপতিত্ব সত্যিই অভিনব, ইতিহাসে এমন নজির বিরল।”
বঙ্গবন্ধুর অপরিসীম আত্মত্যাগের ফসলই হচ্ছে আমাদের আজকের বাংলাদেশ। 

স্বাধীনতার পর
স্বাধীনতা লাভ করলেও পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে নানা ছলা-কলা করতে থাকে। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পরপরই সংবিধান প্রণয়নের কাজ শেষ করেন। তিনি বিশ্বের স্বীকৃতি আদায়সহ যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশের উন্নয়ন কাজে দিনরাত নিয়োজিত করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে স্ব-পরিবারে হত্যা করা হয়।

শেষের কথা
ইতিহাসের এক হিরণ্ময় নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ছিলেন- তিনি আছেন, তিনি থাকবেন। ভাবনায়-চেতনায়-বিশ্বাসে তিনি আমাদের প্রতিটি অণু-পরমাণুর অংশীদার। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ তাই এক ও অভিন্ন। আমাদের জাতিসত্তার চেতনার উন্মেষ হয়েছিল তারই অতি-মানবীয় নেতৃত্বে।
“যতদিন রবে পদ্মা-মেঘনা-গৌরি-যমুনা বহমান
 ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।”

SUMMARY

1432-1.jpg