ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম তালুকদার
অবিংবাদিত নেতাদের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড আগেও ঘটেছে। আব্রাহাম লিংকন (১৫ এপ্রিল ১৮৬৫), মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী (৩০ জানুয়ারী ১৯৪৮), জন এফ. কেনেডি (২২ নভেম্বর ১৯৬৩), মার্টিন লুথার কিং (৪ঠা এপ্রিল, ১৯৬৮) ও ইন্দিরা গান্ধী (৩১ অক্টোবর ১৯৮৪) আততায়ীর হামলায় নিহত হন।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে অবিসংবাদিত ও কালজয়ী নেতা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিজ গৃহে সপরিবারে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়। শিশুপুত্র শেখ রাসেলও এই নির্মমতা থেকে রক্ষা পায়নি। প্রকাশ্য রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যাবহার করে এরূপ নৃশংস রাজনৈতিক হত্যাকা- বিশ্ব ইতিহাসে নেই।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার সাথে জড়িত দণ্ডপ্রাপ্ত সবাই তৎকালীন মধ্যম সারির সেনাকর্মকর্তা, যারা সরাসরি হত্যাকা- এবং পরিকল্পনায় অংশ নিয়েছিল। কিন্তু এই বিচার কি যথেষ্ট? সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের অনেকে এখনো দেশের বাইরে পলাতক বা রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছে।
অধিকন্তু এই বিচার থেকে আমরা হত্যাকাণ্ডের সামরিক মোটিভ পুরোপুরিভাবে জানতে পারিনি। জানতে পারিনি এই হত্যার রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক উদ্দেশ্য কি ছিল? তৎকালীন রাজনীতিকদের সাথে সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি এবং তার গভীরতা অস্পষ্ট রয়ে গেছে।
হত্যাকাণ্ডের পর খন্দকার মোশতাকের নেতৃতে ¡সেনা নিয়ন্ত্রিত যে সরকার গঠিত হয় সে সরকার ক্ষমতায় ছিল মাত্র আড়াই মাস। সেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রীসভার এবং বাকশালের অনেকে যোগ দিয়েছিলেন। সেনা নিয়ন্ত্রণের ছত্রছায়ায় এই সময়ের মধ্যেই তারা হত্যাকারীদের রক্ষায় ইনডেমনিটি বা দায়মুক্তির অধ্যাদেশ জারি করে।
তবে তাদের সুস্পষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কী ছিল তা জানা যায়নি। উল্লেখ্য যে সে সময় দীর্ঘদিন যাবত সরকার পতনের আন্দোলন করে আসছিল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। তবে এই হত্যা ষড়যন্ত্রে তাদের সম্পৃক্ততা ছিল কিনা তা স্পষ্ট নয়।
গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের মতে, “আপনি যদি পরের দিনের পত্রিকার সম্পাদকীয় দেখেন, দেখবেন সবাই সেটাকে স্বাগত জানিয়ে ছিল। সুতরাং এটা হুট করে কয়েকজন মেজর এবং কিছু সোলজার মিলে এটা করেছে সেটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। বঙ্গবন্ধুর পজিশন বিবেচনা করলে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ছাড়া গুটি কয়েক বিপথগামী সামরিক সদস্য এবং তার দলের একজন বেঈমান এই ঘটনা ঘটিয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় না।“
এসময় সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ, আর উপ সেনাপ্রধান ছিলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। তথ্য-উপাত্ত ও প্রকাশিত লেখনি বিশ্লেষণে এটা প্রতীয়মান হয় যে হত্যা ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তৎকালীন সেনা প্রধান অবগত ছিলেন না। এতে তার মেধা-যোগ্যতা ও সামর্থের প্রশ্ন আসে। হত্যাপরবর্তী কোন প্রতিকার নিতেও তাকে দেখা যায় না। এতে তার প্রফেশনাল নৈতিকতার প্রশ্ন আসে।
আর উপ সেনাপ্রধান অনেক আগে থেকেই অবগত ছিলেন ও ঘটনাপ্রবাহে তার মৌন সম্মতি ছিল বলে তথ্য-উপাত্ত থেকে প্রতীয়মান হয়।। অধিকন্তু তিনি ঘটনা পরবর্তী সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী। তার নীতি-নৈতিকতার প্রশ্ন এখানে অবান্তর। শুধু উল্লেখ করতে হয় যে বঙ্গবন্ধু তাকে কতটা স্নেহ করলে চার বছরে একজনকে মেজর থেকে মেজর জেনারেল করলেন এবং উপ সেনাপ্রধান পদটি শুধু তার জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছিল।
অধ্যাপক আবু সাইয়িদের বর্ণনায় আমরা ঘটনা পরবর্তী মিলিটারি হেডকোয়ার্টারকে দেখি এভাবে। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সকাল ৭:১৫। ডেপুটি চীফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান অফিসে এলেন স্বাভাবিক, যেন কিছুই হয়নি । এতটুকুও পরিবর্তন বা প্রতিক্রিয়া নেই। এর পরপরই সেনাবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল শফিল্লাহ এলেন। তার সামনে পেছনে ল্যান্সার এবং আর্টিলারী গার্ড। হেড কোয়ার্টার অফিসে তখন কৌতুহলের আর উৎসুকের দৃষ্টি।
এর পনের মিনিট পর মেজর ডালিম ও মেজর রশিদ এলেন দুটো এম.জি জীপ স্কট নিয়ে। সোজা ঢুকে গেলেন শফিউল্লার রুমে। পাঁচ মিনিট পরে শফিউল্লার রুম থেকে তারা বের হলেন। শফিউল্লাহ বের হলেন, পিছনে জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমান একটু এগিয়ে এসে ডালিমকে বললেন – কাম হিয়ার, ইউ হ্যাভ ডান সাস্ -এ গ্রেট জব!……অতঃপর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান স্টাফ কারে উঠলেন। আর মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে মেজর রশিদ ও মেজর ডালিম গার্ড করে রেডিও স্টেশনে নিয়ে গেলেন (ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ১৩৬-১৩৭)।
পরের দিন ১৬ আগস্ট সকালে আর্মি হেড কোয়ার্টারে মিটিং। প্রধান, উপ প্রধান সহ সকল সিনিয়ররা উপস্থিত। আলোচনা শুরু হল। কর্নেল শাফায়াত জামিল সরাসরি ক্ষোভের কণ্ঠে বললেন, এটা আর্মি ক্যু হলে আমরা জানি না কেন ? আর একটা টোটাল আর্মি ক্যু না হয়ে থাকলে আমি মনে করি যারা এ জঘন্য কাজ করেছেন তারা খুনি এবং দে শুড বি পানিশড। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ এবং কর্নেল হুদা এ বক্তব্য সমর্থন করে তাদের মতামত দিলেন (পূর্ব সূত্র)।
শাফায়াত জামিল বলে চললেন, এজ ইউ আর দি আর্মি চীফ, আই ওয়ান্ট অর্ডার ফ্রম ইউ- আই উইল ওয়াশ আউট অফ অল মার্ডারার্ স উইথ ইন হাফ অ্যান আওয়ার। শফিউল্লাহ নীরব। মাই ব্রিগেড ইজ রেডি, এন্ড ইফ ইউ আর আনএবল টু পাস দ্যা অর্ডার দেন লিভ দ্যা চেয়ার এন্ড আসক ডালিম টু সীট ইন ইওর চেয়ার এজ আর্মি চীফ (পূর্ব সূত্র)।
হত্যাকাণ্ডের ৯ দিনের মাথায় উপ সেনা প্রধান সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান থেকে রাষ্ট্রপতি হন। জাতীয় সংসদ নির্বাচন এগিয়ে আসলে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করেন।
১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি মাসে সামরিক আইনের অধীনে দেশে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে নতুন দল বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী হয়। এই সংসদে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল তারিখে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি বৈধতা দেওয়া হয়।
উল্লেখ্য হত্যাকাণ্ডের সময় ঢাকা সেনানিবাসে একজন লেফট্যানেন্ট কর্নেল হিসেবে কর্মরত ছিলেন আমিন আহমেদ চৌধুরী। ২০১০ সালে বিবিসি বাংলাকে দেয়া তার সাক্ষাতকার থেকে আমরা জানতে পারি, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর পাঁচটার দিকে হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত একজন সেনা কর্মকর্তা মেজর রশিদের নেতৃত্বে একদল সেনা তার বাড়িতে আসে। সৈন্যরা তাকে এবং তৎকালীন কর্নেল শাফায়াত জামিলকে নিয়ে যায় সেনা উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাড়িতে।
আমিন আহমেদ বলেন “জেনারেল জিয়া একদিকে শেভ করছেন একদিকে শেভ করে নাই। স্লিপিং স্যুটে দৌড়ে আসলেন। শাফায়াতকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘শাফায়াত কী হয়েছে?’ শাফায়াত বললেন, ‘এপারেন্টলি দুই ব্যাটালিয়ন স্টেজ এ ক্যু। বাইরে কী হয়েছে এখনো আমরা কিছু জানি না। রেডিওতে এনাউন্সমেন্ট শুনতেছি প্রেসিডেন্ট মারা গেছেন।’ তখন জেনারেল জিয়া বললেন, সো হোয়াট? লেট ভাইস প্রেসিডেন্ট টেক ওভার। উই হ্যাভ নাথিং টু ডু উইথ পলিটিক্স।“
হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন রক্ষী বাহিনীর কোন প্রতিক্রিয়া না হওয়ায় অনেকে অবাক হয়েছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর উল্টো রক্ষী বাহিনীই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল বলে জানান আমিন আহমেদ চৌধুরী।
আর ভাগ্যক্রমে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা সে দিন দেশে ছিলেন না। সম্ভবত বিপথগামি অফিসাররা সেটা জানত না। ধারণা করা যায় যে সপরিবারে হত্যার মূল বিষয়টি ছিল জাতিকে হতভম্ব ও নার্ভাস করে দেয়া এবং যাতে ভবিষ্যতে এর বিরুদ্ধে জাতিকে কেউ সংগঠিত করতে না পারে।
জীবন নাটকের নাট্যকারের খেলা বুঝা বড় কঠিন। যে রক্ষী বাহিনী তৈরি করা হল এত যতেœ তা কোন কাজেই আসল না। যে মোস্তাক কে এত একান্ত ভাবা হল সেই করল চরম বিশ্বাসঘাতকতা। যার জন্য সেনা উপপ্রধান পদ তৈরি করা হল তিনি ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে গেলেন।
নাট্যকারের নাটক কেমন। মোস্তাক তিন মাসও ক্ষমতায় টিকল না। তাকে আর কে বিশ্বাস করে। উপ প্রধান প্রধান হলেন, রাষ্ট্রপতিও হলেন, দল গঠন করলেন, নির্বাচনী ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় আসলেন, জাতির পিতাকে হত্যার বিচারের পথ সাংবিধানিক ভাবে রোধ করলেন। কিন্তু খুবই স্বল্প সময় টিকলেন। ১৯৮১ সালের ৩০মে চট্টগ্রাম সার্কিট-হাউসে প্রতি বিপ্লবীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হলেন। তার দল আজ পর্যন্ত তার হত্যার বিচারই চায় নাই।
অন্যদিকে ১৯৮১ সালের ১৭ই মে বিধাতার আশীর্বাদ নিয়ে আসলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে বিমানবন্দর থেকে পুরো ঢাকা জুড়ে বৈরী-আবহাওয়া ও সকল বাধা উপেক্ষা করে লাখ লাখ লোকের ভিড় জমল। অনেকে ধারণা করেন ঐদিন তাকে সম্বর্ধনা দিতে প্রায় ১০ লাখ লোক কোন না কোনভাবে রাস্তায় নেমেছিলেন।
বিশ্ব মানবতার প্রতীক এই নেত্রীর উপর কমপক্ষে ১৯ বার সাংঘাতিকভাবে হামলা হয়। সর্বশেষ, সবচেয়ে ভয়াবহ ও বর্বরোচিত হামলাটি ছিল ২১ আগস্ট ২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলা। একটি নির্বাচিত সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশ্যে দিবালোকে বিরোধী দলের জনসভায় এভাবে হামলা বিশ্ব ইতিহাসে নেই। কিন্তু বিধাতার রহমতেই তিনি বেঁচে যান। তিনি বেঁচে যান একটি দারিদ্রমুক্ত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য।
যা হোক এই প্রবন্ধের শেষে এসে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ও ২০০৪ সালের ২১ আগস্টে নিহত সকল শহীদদের প্রতি বিনম্রশ্রদ্ধা জানাই। আর ১৫ই আগস্টের হত্যাকা- নিয়ে কয়েকটি কোয়ালিটেটিভ ইনডেপথ একাডেমিক গবেষণা উদ্যোগ গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা ব্যক্ত করি। তাৎপর্যপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা ছাড়া এইরূপ উচচমাত্রার সংবেদনশীল বিষয়ে গবেষণা পরিচালনা কঠিন। তাছাড়া এটি জরুরি ভিত্তিতেও করা প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধুর সময়কার এবং ১৯৭৫ সমসাময়িক ঘটনা অবলোকনকারি লোকগুলো হারিয়ে গেলে এই ধরনের গবেষণা প্রকল্প পরিচালনা কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে।
মামলার রায়ে ষড়যন্ত্রের কথা বলা হলেও এর পেছনে ঠিক কি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল এবং রাজনীতিকরা ঠিক কিভাবে এই ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত ছিল এবং আন্তর্জাতিক কি ধরণের ও কতটুকু সম্পৃক্ততা ছিল সে বিষয়টি মামলায় উঠে আসেনি। কিন্তু নতুন ও আগামী প্রজন্ম যাতে এই বিষয়গুলো সম্পর্কে বস্তুুনিষ্ঠ ভাবে জানতে পারে সেজন্য পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত ও গবেষণা লব্ধ জ্ঞানভান্ডার থাকা জরুরি।
লেখক : গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, এবং আহ্বায়ক বঙ্গবন্ধু পরিষদ, সুনামগঞ্জ জেলা।