১৫ আগস্ট, ১৯৭৫, জাতির জীবনে একটি মর্মান্তিক ট্র্যাজেডির দিন। এই দিনে আমরা শ্রদ্ধা জানাই ইতিহাসের মহানায়ক, জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির প্রতি। ১৫ আগস্টের এই মর্মস্পর্শী দিনটির আমরাও সাক্ষী। আমরাও মেনে নিতে পারি না নিষ্পাপ শিশু শেখ রাসেলের এরূপ বেদনাদায়ক মৃত্যুকে। তাই আমরাও এই দিনটিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ছিলাম অনুভবে আর সমবেদনায়। ছিলাম না আনুষ্ঠানিকতার আতিশয্যে আর বিলবোর্ডের ভিড়ে যেখানে হৃদয়ের স্পর্শ নেই, আগস্ট মাস ধরেই শোক পালিত হচ্ছে দেশজুড়ে। কিন্তু রাজধানী ঢাকায় দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি ইতিহাসের অসাধারণ মহানায়কের হিমালয় সমান আকৃতিটি বিলবোর্ডের একটি কোণে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে এসেছে। একই সঙ্গে বিলবোর্ডদাতার চেহারাটি বিলবোর্ডজুড়ে বিশাল আকার ধারণ করেছে। বুঝতে কষ্ট হয় কার জন্য এই শোক- কিইবা এর উদ্দেশ্য। আমাদের মতো এ দেশের লক্ষ্য কোটি মানুষ হৃদয়ের অনুভূতি দিয়ে এই দিনটিতে জাতির পিতাকে শ্রদ্ধা ভালোবাসায় স্মরণ করেছে। রাজকুমারী ডায়ানার মৃত্যুর পর দেখেছিলাম কীভাবে বিলেতের নর-নারীরা ফুল হাতে বাকিংহাম প্যালেসের সামনে উপস্থিত হয়ে সেই চত্বরটিকে ফুলে ফুলে ভরে দিয়েছিল। তাদের চোখ দুটি ছিল অশ্রুসিক্ত আর শ্রদ্ধা। আমরা কেন পারি না শুধু একটি ফুল দিয়ে হৃদয়ের আকুতি প্রকাশ করতে- বুঝি না। পাশের দেশ ভারতেরও জাতির পিতার প্রাণহানি হয়েছিল অাঁততায়ীর হাতে। প্রতি বছর তার মৃত্যুদিবসটি পালিত হয় ভাবগম্ভীর শ্রদ্ধা ভালোবাসায়।
এ ঘটনাটি যখন ঘটে তখন আমি রাজশাহী বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত কাস্টমস কর্মকর্তা ছিলাম। ঘটনার পরপরই আমাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল খন্দকার মোশতাকের একটি ছবি, অফিসের দেয়ালে টাঙানোর জন্য। সেই সঙ্গে একই হেলিকপ্টারযোগে পাঠানো হয়েছিল একটি টুপির নকশা। বাকি সবটুকুই অন্ধকারে থেকে যায়। এরপর দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে আমরা প্রশ্ন করেছি- কেন এই দুর্বোধ্য হত্যাকাণ্ড, কেন এত রক্তপাত? এর উত্তর আজও খুঁজে পাইনি। জানি রাজনীতিতে হত্যা আছে। কিন্তু সেই হত্যা শুধু রাজনীতিবিদের জন্যই নির্ধারিত থাকতে পারে। ১০ বছরের শিশুটি অথবা গৃহিণী অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী এই হত্যার শিকার হলো কেন? এ প্রশ্নটির কে উত্তর দেবে? জন এফ কেনেডির হত্যারহস্য আজও উদ্ঘাটিত হয়নি। মহাত্দা গান্ধীর হত্যার জন্য শুধু নাথুরাম গডশেঠই কি দায়ী? আব্রাহাম লিংকনকে কি একটি পাগলই হত্যা করেছিল? কেনেডির হত্যার পর স্ত্রী জ্যাকুলিন কেনেডি তার পুত্র-কন্যাকে শপথ করিয়েছিলেন তারা কোনো দিন রাজনীতি করবে না। কখনো বিমান চালাবে না। তার পুত্র সে কথা রাখেনি। ছোট একটি বিমান চালিয়ে মহাসাগরের বুকে একটি দ্বীপে পাড়ি দিয়ে বিমানসহ সাগরের অতল গহ্বরে তলিয়ে গিয়েছিলেন এই বুদ্ধিদীপ্ত তরুণ। যিনি বেঁচে থাকলে হয়তোবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতেন। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হয়ে জন কেনেডির ভাই রবার্ট কেনেডিও অাঁততায়ীর হাতে প্রাণ দিয়েছিলেন। জ্যাকি কেনেডি হয়তো জানতেন তার স্বামীর হত্যার রহস্য। কিন্তু মুখ খুলতে পারেননি। তাই তিনি নিভৃত একটি দ্বীপে একাকী জীবন বেছে নিয়েছিলেন।
এসব মৃত্যুর কারণ কী? এ প্রশ্নের কোনো সুরাহা হয়নি, হবেও না কোনো দিন। এদের মৃত্যুর কারণ একটিই রাজনীতি। রাজনীতিতে মৃত্যু আছে। আরও একটি কারণ আছে- তা হলো বিভক্ত জাতিসত্তা। এরা সবাই বিভক্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। এ দেশে বঙ্গবন্ধু যেদিন '৭০-৭১-এর নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সঠিক সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন সেদিনই তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি হয়েছিলেন। এ দেশের গণমানুষের একচ্ছত্র নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। সমগ্র জাতি হয়েছিল ঐক্যবদ্ধ। নির্বাচনে তিনি জয়ী হয়ে পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সাংবিধানিক অধিকার অর্জন করেছিলেন। এই একটি সিদ্ধান্তের কারণেই ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। ২৬ মার্চ বন্দরনগরী চট্টগ্রামে অষ্টম বেঙ্গলের বিদ্রোহের পর স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর লাল-সবুজের পতাকা প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশে। কিন্তু এত কিছুর পরও এ কথা সত্য যে '৭০-৭১ এর নির্বাচনের সময় থেকেই জাতিগত বিভক্তি ঘটেছিল। যারা এই নির্বাচনে অংশ নেয়নি তারা স্লোগান দিয়েছিল- 'ভোটের বাঙ্ েলাথি মার, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।' যারা এই ধ্বনি তুলেছিল তারা প্রায় সবাই ছিল বামপন্থি। কেউ কট্টর, কেউ নরম, কেউ ছিল কমিউনিস্ট। ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ২১ আগস্ট, ২০১৫ বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত 'ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার' শীর্ষক একটি লেখায় এ তথ্যটি উঠে এসেছে। তিনি লিখেছেন- 'যুদ্ধ শুরুর আগেই শেখ মুজিবুর রহমান পুঁজিবাদী বিশ্বকে এই মর্মে সতর্ক করে দিয়েছিলেন, তারা যেন বুঝতে ভুল না করে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে তিনিই শেষ রক্ষাপ্রাচীর। তার পতন ঘটলে বিপদ আছে। পুঁজিবাদী বিশ্ব যে তা জানত না তা নয়, কিন্তু তাদের ধারণা হয়েছিল যে, বামভাবাপন্ন তরুণরা মুজিবকে এমনভাবে ঘিরে ফেলেছে যে, শেষ পর্যন্ত তাদের তিনি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন না। সে জন্য শেষ মুহূর্তে তার প্রতি সমর্থন তারা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। আপসকামীদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে বাংলাদেশ যখন কোনোমতে প্রতিষ্ঠিত হলো নতুন রাষ্ট্রের জন্য তখন শত্রু কারা? শত্রু হওয়ার কথা হানাদারদের চিহ্নিত দোসর আলবদর-রাজাকাররাই। কিন্তু তারা শত্রু বলে বিবেচিত হলো না। বরঞ্চ কিছুটা ধীরে ধীরে হলেও সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত হয়ে গেল। শত্রু হয়ে দাঁড়াল সমাজবিপ্লব বিশ্বাসীরা। অর্থাৎ কমিউনিস্ট তবে এখন এরা দুই ভাগে বিভক্ত, নরমপন্থি ও চরমপন্থি। নরমপন্থিরা ভারতে গেছে, তারা যুদ্ধ তৎপরতায় শামিল হতে চেয়েছে, কিন্তু ভারত সরকার কমিউনিস্টদের বিশ্বাসযোগ্য মনে করেনি। এমনকি তাদেরও নয় যারা নরমপন্থি। যুদ্ধ থেকে তাদের দূরে রাখার ব্যাপারে তাই ভারত সরকারের সুস্পষ্ট নির্দেশ ছিল। ওদিকে আওয়ামী জাতীয়তাবাদীরা নরম-গরম নির্বিশেষে সব সমাজতন্ত্রীকেই সব সময় অবিশ্বাস করে এসেছে। কারণ নরমপন্থিদের পেছনেও তো মুরবি্ব ছিল রাশিয়াই, আর উগ্র হোক চাই নরম হোক সব জাতীয়তাবাদীরই শেষ ভরসা তো রাশিয়া নয়, আমেরিকাই।
ভারত সরকার ও আওয়ামী লীগ, বামবিরোধী এই দুই পক্ষের নজরদারিত্বের কারণে গায়ে বামপন্থি গন্ধ আছে, এমন তরুণরা মুক্তিবাহিনীতে ঢুকতে ব্যর্থ হয়েছে। শুধু তাই নয়, তাদের হত্যা পর্যন্ত করা হয়েছে, কেউ কেউ পালিয়ে বেঁচেছে, অন্যরা সেবাকেন্দ্রে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ নিয়েছে, অথবা হতাশায় আক্রান্ত অবস্থায় দেশে ফিরে এসেছে। আপসবিমুখ বামপন্থি দল-উপদলগুলো ভারতে যায়নি, তারা দেশের ভিতর থেকেই লড়াই করেছে।
কিন্তু তাদের লড়তে হয়েছে দুই ফ্রন্টে : একদিকে ছিল হানাদার সশস্ত্র পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকাররা, অপরদিকে ছিল ভারত থেকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র নিয়ে আসা মুজিব বাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা, যাদের চোখে পাকিস্তানি ঘাতকদের চেয়েও বড় শত্রু ছিল বাঙালি বামপন্থি মুক্তিযোদ্ধারা। আপসবিরোধী বামপন্থিদের লড়াইটা তাই ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক। তবুও তারা লড়েছে এবং প্রাণ দিয়েছে। এখানে স্মরণীয় যে, ঢাকা শহরে যে তরুণটা গেরিলা তৎপরতায় যোগ দিয়েছে এবং অন্যত্র একই ধরনের কাজ করেছে, তারা কেউ ছাত্রলীগের সদস্য ছিল না। প্রায় সবাই ছিল ছাত্র ইউনিয়নের সমর্থক এবং সত্তর-একাত্তরে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন আদর্শিকভাবে পরস্পরের মিত্র নয়।
বামপন্থিদের শত্রু হিসেবে দেখার ঐতিহ্যে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর বিন্দুমাত্র ছেদ ঘটেনি। বরঞ্চ সেটি ফুলে ফলে আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। ফলে বিপদ যা ঘটার ঘটল বামপন্থিদের। তারা ধরা পড়ল, মারা পড়ল ও পালিয়ে প্রাণ বাঁচাল। যারা স্বতন্ত্রভাবে দাঁড়াতে চাইল সেই বামপন্থিরা পরিণত হলো নবগঠিত রক্ষীবাহিনীর স্থির লক্ষ্যে। রক্ষীবাহিনীর নেতৃত্বে ছিল মুজিব বাহিনীর তরুণরাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণসংযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, খোলা কলামে 'আদিবাসীদের ভূমি অধিকার' শীর্ষক ১১ আগস্টের একটি নিবন্ধে তিনি বলেছেন- 'বাংলাদেশে বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠী ছাড়াও প্রায় ৩০ লাখ জনসংখ্যার ৫০টিরও অধিক আদিবাসী মানুষ স্মরণাতীতকাল থেকে বসবাস করে আসছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে তাদের জীবন, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও আশা-আকাঙ্ক্ষা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আদিবাসী জনগণের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। এ জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩০ লাখ মানুষ দেশের ৩৫টিরও অধিক জেলায় বাস করেন। এর মধ্যে তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে ১৪ জাতির মানুষ সামাজিক-সাংস্কৃতিক স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে বসবাস করছেন। আয়তনে তিন জেলা দেশের প্রায় এক-দশমাংশ এলাকাজুড়ে বিস্তৃত; এর বাইরে সমতলের ৩০টিরও বেশি জেলায় আদিবাসী জাতির মানুষ বাস করেন। বাংলাদেশে একটি বহুত্ববাদী রাষ্ট্র, যদিও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে একে ঠিক স্পষ্ট করে গ্রহণ করা হয়নি।'
১৫ আগস্ট কর্নেল (অব.) জাফর ইমাম বীরবিক্রমের কিছু বক্তব্য বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত হয়েছে, যা সবার কাছে সমান গ্রহণযোগ্য না হলেও প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, 'দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেজর জেনারেল সফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান করেছিলেন। কিন্তু সফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান না করে তখন যদি তিনি মেজর জিয়াকে সেনাপ্রধান করতেন তবে ১৫ আগস্টের মতো দুঃখজনক ঘটনা নাও ঘটতে পারত। ১৫ আগস্টে যারা এ দুঃখজনক ঘটনা ঘটিয়েছিল তারা ছিল সেনাবাহিনীর একটি ক্ষুদ্র অংশ এবং দুটো ইউনিট। এর সঙ্গে জড়িত ছিল সেনাবাহিনী থেকে সদ্য বহিষ্কৃত মেজর ডালিম, নূরসহ কিছু অফিসার যারা পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছিল, তারা মুক্তিযুদ্ধ করেনি। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, যারা পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছে তারাও মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু এই দুই ইউনিটে ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘাতকরা।'
তিনি বলেন, 'ঘটনার আগ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহসহ অন্যদের সঙ্গে আলাপও করেছিলেন। কিন্তু জেনারেল সফিউল্লাহ সময়মতো ঢাকা সেনানিবাস তথা ৪৬ ব্রিগেডকে নির্দেশ দিতে ব্যর্থ হন। তিনি যদি সময়মতো নির্দেশ দিতেন এবং বঙ্গবন্ধুকে বাড়ির দ্বিতীয়তলায় বেরিয়ে না আসতে পরামর্শ দিতেন তাহলে এদের অপারেশন আরও বিলম্বিত হতো।... ইতিহাস ভিন্ন হয়ে যেত।' কর্নেল জাফর ইমামের শেষ বক্তব্যটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, 'যুদ্ধকালে বঙ্গবন্ধু হত্যার নীলনকশা তৈরি করা হয়। ওই সময় কলকাতায় বাংলাদেশ দূতাবাসে মাহবুব আলম চাষী ও তৎকালীন দূতাবাসের হাইকমিশনার হোসেন আলী ও অন্যদের যোগসাজশে এ ষড়যন্ত্র করা হয়, পরে বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করে।' তিনি বলেন, 'স্বাধীনতা-উত্তর মুজিব বাহিনীর একটা বিরাট অংশ জাসদের নেতৃত্বে বের হয়ে গিয়ে গণবাহিনী তৈরি করে। এটা আওয়ামী লীগকে অনেকটা দুর্বল করে। এ ছাড়া তখন আওয়ামী লীগের মধ্যে সাংগঠনিক দুর্বলতাও ছিল। এ পরিস্থিতিতে মোশতাকরা বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্র চালিয়ে যায়। ফলে ১৫ আগস্ট আরও ত্বরান্বিত হয়। আমি মনে করি, ঘাতকদের বিচারের পাশাপাশি যারা ওইদিন মুজিব বাহিনী থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল এবং বঙ্গবন্ধুকে প্রটেকশন দিতে ব্যর্থ হয়েছে তাদেরও বিচারের মুখোমুখি করা উচিত।
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর একটি বক্তব্য ১৮ আগস্ট খোলা কলামে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, 'এক সময় বঙ্গবন্ধুকে সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থ করতে মতিয়া চৌধুরী, হাসানুল হক ইনু, শাজাহান খান, মইন উদ্দীন খান বাদল, কর্নেল তাহের বীরোত্তমের ভাই ওয়ারেসাত হাসান বেলাল যারা ভারতীয় হাইকমিশনে আক্রমণ করেছিল, কতজনের নাম বলব, আরও যারা আদাজল খেয়ে লেগেছিল, তাদের আজকাল সে কী প্রতাপ!' জাসদই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ক্ষেত্র তৈরি করেছিল বলে ২৩ আগস্ট রবিবার এক অনুষ্ঠানে অভিযোগ করেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম। তিনি বলেন, 'স্বাধীনতাবিরোধীরা কখনো বঙ্গবন্ধুর ওপর আঘাত হানতে পারত না, যদি এই গণবাহিনী, জাসদ বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করে বিভিন্ন জায়গায় ডাকাতি, মানুষ হত্যা ও এমপি মেরে পরিবেশ সৃষ্টি না করত। সুতরাং বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল রহস্য বের করতে হবে, কারা কারা জড়িত ছিল।'
বামরাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল দাবি করে শেখ সেলিমের সঙ্গে সুর মিলিয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ ২৫ আগস্ট আজিমপুর গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ ছাত্রলীগ আয়োজিত শোকসভায় বলেছেন, 'জাসদ ন্যাপসহ যারা বাম রাজনীতি করত '৭২-৭৫-এ তারা বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরোধিতা করেছিল। কেন করেছিল, তারাই ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। তাদের ঔদ্ধত্য এমন পর্যায়ে ছিল, একটা সরকারকে অস্থিতিশীল করার জন্য যা যা করণীয়, তারা তাই-ই করেছিল। জাতির পিতার হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল ওই সময়ের বাম সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা। দেরিতে হলেও উপরোক্ত বক্তব্যগুলো বঙ্গবন্ধু হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে পারে। প্রকৃতপক্ষে এ হত্যার তদন্ত কখনোই সঠিকভাবে, সঠিকপথে পরিচালিত হয়নি। হত্যা তদন্তের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল সফিউল্লাহকে তিনি কী বলেছিলেন, সেই ডাইং স্টেটমেন্ট'-এর সূত্র ধরেই এই হত্যারহস্যের তদন্ত শুরু হওয়া উচিত ছিল। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য সেনাপ্রধানকেই বিশ্বাস করতে চেয়েছিলেন। এটা তার শেষ কথাগুলোতেই স্পষ্ট : 'সফিউল্লাহ তোমার আর্মি আমার বাড়ি আক্রমণ করেছে।' অর্থাৎ এই হত্যার দায় সেনাপ্রধান প্রাথমিকভাবে মে. জে. সফিউল্লাহকেই নিতে হবে। যেহেতু বঙ্গবন্ধুর ভাষায় তারই আর্মি তার বাড়ি আক্রমণ করেছিল এবং তাকে হত্যা করেছিল। এ দায় থেকে মুক্ত হতে হলে তাকে আদালতে প্রমাণ করতে হবে তিনি একজন ব্যর্থ, অযোগ্য সেনাপ্রধান ছিলেন। এ ছাড়া জাসদসহ বামপন্থিদের বিরোধিতা বঙ্গবন্ধু সরকারকে কার্যত প্রচণ্ডভাবে দুর্বল করে ফেলেছিল। এমনকি রক্ষীবাহিনী দায়িত্ব পালন করেনি। দেশের অবস্থা বঙ্গবন্ধুর অজানা ছিল না। তাই তিনি বাকশাল সৃষ্টি করে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার শেষ চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। কলকাতার সেই ষড়যন্ত্র অবশেষে বাস্তবায়িত হয়েছিল। মোশতাক হয়েছিল সামরিক শাসক ও রাষ্ট্রপতি।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।