বঙ্গবন্ধু: এক সিংহপুরুষ

গৌতম কুমার রায়

১৯৭৫ থেকে ২০১৭। মাঝে ব্যবধান ৪২ বছর। ১৯৭৫ সালের কালো অধ্যায় থেকে ২০২১ সালের রূপকল্পের অভিযাত্রা। মুজিব ছিলেন, মুজিব আছেন এবং মুজিব থাকবেন। বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের এক অবিসংবাদিত সংগঠক ও নেতা শেখ মুজিবুর রহমান আজো ইতিহাসখ্যাত হয়ে আমাদের মাঝে রয়েছেন।

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। বাংলাদেশের অজপাড়া গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম হলো বাংলার এই অবিসংবাদিত নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। মধুমতি নদীর তীরঘেঁষা এ গ্রাম্য বালকের সাহস, দৃঢ়তা, সাংগঠনিক শক্তি ও অবিচল মনোভাবের জন্য অল্প সময়ের মধ্যে তাঁর পরিচয় ছড়িয়ে গেল গ্রাম থেকে শহর, শহর থেকে রাজধানী এবং দেশ ছেড়ে বিদেশের কোনায় কোনায়।

বঙ্গীয় অঞ্চলে নদীর দুই তীরবর্তী দ্রাবিড়ীয় সভ্যতায় প্রথম বসবাসকারী ও স্থায়ীভাবে বসবাসকারী মানবগোষ্ঠী হলো বাঙালি, যা জাতির আদি সূত্র। ‘বং’ থেকে বঙ্গ। এটা চীনা শব্দ। দীর্ঘ পাঁচ হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে চীনা এ ভাষার শব্দটির অর্থ হলো, জলাশয়, জলাধার বা নদী এলাকা। তার পরে বহু ঘাত ও ঘাট পেরিয়ে, ঐতিহাসিকতা নিয়ে বঙ্গদেশ, বঙ্গীয় এলাকা, বঙ্গ প্রদেশ, পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব বাংলা, পূর্ব পাকিস্তান অতঃপর স্বাধীন এক বাংলাদেশ সৃষ্টি হলো; যার মহানায়ক ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৩৮ সাল। বঙ্গবন্ধু ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে প্রথম পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন এবং কারাগারে যান। তখন বঙ্গবন্ধুর বয়স মাত্র ১৮ বছর। তিনি এরপর বহুবার জেলে কাটিয়েছেন কিন্তু প্রথম সাতদিনের জেলের কথা ভুলতে পারেননি। তাই তো শেখ মুজিব বলতেন, ‘যেদিন আমার প্রথম জেল হয়, সেদিন থেকে আমার নাবালকত্ব ঘুচে গেছে।’ 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন ৩৫ বছরের, এর পুরোটা কেটেছে প্রতিবাদ, প্রতিরোধে। ১৯৪৭ সালের পর যে সময়টা, তা জিন্নাহ-লিয়াকতের আদর্শ ও বিশ্বাসভঙ্গের ইতিহাস। পাকিস্তানি উপনিবেশে জিন্নাহ-লিয়াকতের রক্তচক্ষু, নূরুল আমিনের ভয়াবহ নির্যাতন, ইস্কান্দার-মির্জার ৯২-ক ধারার নির্লজ্জ কাহিনী উপস্থাপন, তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ইয়াহিয়া খানের গণহত্যা ও রাষ্ট্রবিরোধী মামলা উপেক্ষা করে বাঙালির অকুতোভয় সৈনিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অবিচল ছিলেন। তাঁর উদাত্ত আহ্বানের সঙ্গে ডান হাতের অঙ্গুলি নির্দেশনা ছিল অন্যায় শাসন, শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নির্দেশনা।

টুঙ্গিপাড়ার এ ছেলেটি বাঙালিকে মুক্তির গান শুনিয়ে শুনিয়ে জাগ্রত করেছিলেন। একটি স্বাধীন মানচিত্রে স্বাধীন দেশ গড়লেন। এবার তিনি হলেন সবার মুজিব। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫— এ সাড়ে তিন বছরের ব্যবধানে মুজিব শত্রুদের ছোড়া গুলিতে হয়ে গেলেন লাশ নামে নিথর অবয়ব। আবার তিনি সেই নিথর হয়েই ফিরলেন আপন মাটি টুঙ্গিপাড়ায়। মুজিব আর কখনো কি বলবেন, আমি শোষকের পক্ষে নই, আমি শোষিত মানুষের পক্ষে? শামসুর রাহমান, দেশের বর্ষীয়ান কবির ‘আমাকে বলতে দিন’ নামের প্রবন্ধ থেকে জানা গেল, শ্রদ্ধেয় আবুল ফজল, তাকে বঙ্গবন্ধুবিরোধী বলা হলেও তিনি ছিলেন বাংলাদেশ নামের স্বাধীন এ রাষ্ট্রের স্থপতির বিশেষ অনুরাগী। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তিনি লিখলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরের নির্মমতা কারবালার নির্মমতাকেও যেন ছাড়িয়ে গেছে। কেননা কারবালার নির্মমতায় দুই পক্ষের হাতে অস্ত্র ছিল। তারা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। সে হত্যা কোনো অর্থেই ঠাণ্ডা রক্তে ছিল না। সৈনিকের পেশা শত্রু নিধন। তার হাতের অস্ত্র উত্তোলিত হয় শত্রুর বিরুদ্ধে, ন্যায়ের পক্ষে সৈনিকের অস্ত্র নিরপরাধ, নিরস্ত্র মানুষের ওপর উদ্যত হয় না। শিশু আর নারী হত্যা তো মুসলমান সৈনিক ভাবতেই পারেন না। অথচ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রনায়কের বাড়িতে তা-ই হয়েছে। বিশ্বে নতুন ইতিহাস সৃষ্টিকারী ক্ষণজন্মা যে মানুষটি টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নিলেন, তিনি সেই টুঙ্গিপাড়ার মাটিতেই নিজের দেহ সঁপে দিয়ে শুয়ে থেকে বিমূর্ত ইতিহাসের জন্ম দিলেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নির্মম ঘটনা প্রসঙ্গে সন্ধ্যায় বিবিসির ভাষ্যকার বললেন, ‘বাংলাদেশে যা-ই ঘটুক না কেন, শেখ মুজিবুর রহমান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন সেই মানুষটি হিসেবে, যিনি না হলে বাংলাদেশের জন্মই হতো না।’ ১৯৭৫ সালের পর ইতিহাস অনেকটা নিস্তব্ধ ছিল। এখন সেই নিস্তব্ধতা কেটে কেন যেন কোলাহল সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষ জাগ্রত হচ্ছে। মাটির বিমূঢ়তাকে অবলম্বন করে মানুষ শ্রদ্ধা জানাতে আসছে বাঙালির এই মহান নেতাকে চিরশায়িত মাটির ঘরে। বিশ্বচক্রান্তের নীরব সাক্ষ্যে চক্রান্তকারীরা পিতৃঘাতী হয়েছে। তারা শিশু বা সন্তানঘাতী হয়েছে। বর্বরতার আঁস্তাকুড়ের ইতিহাসে তারা নারীঘাতক হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ নেই। তবে তিনি আছেন আমাদের স্বাধীনতায়, চেতনায়, শৌর্যে ও বীর্যে।

বলা হয়, বঙ্গবন্ধু আমলে অত্যাচার, অনাচার, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতিতে দেশ সয়লাব ছিল। অথচ ’৭৫-এর পরে দেশে সে তুলনায় ঢের বেশি এমন ঘটনা ঘটেছে। দুর্নীতিতে দেশ ছেয়েছে। সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতি কোথায় পৌঁছেছে! সমাজ নৈতিকতা হারিয়েছে। আইন না মানার প্রবণতা বেড়েছে। কই, তাতে তো রক্ত ঝরেনি? এ দেশে কি নীতি আর নৈতিকতার দায়ে যত রক্ত দেবে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার? ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মাত্র ১৯ বছর পর বঙ্গবন্ধু দেশের স্বাধীনতা দিলেন। তিনি হতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা। দেশের রাষ্ট্রপতি। তিনি ছিলেন একজন নির্ভেজাল বাঙালি। তিনি হাজার বছরের মধ্যে একজন, যিনি বাঙালিকে অসাম্প্রদায়িক মনোভাবে একতাবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। সৃষ্টিশীল কাজের জন্য শেখ মুজিব এ দেশে, এ জাতির মধ্যে অবিনশ্বর জীবনের মহিমায় একাকার হয়ে থাকবেন দেশ, মাটি ও জাতির মাঝে।

’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ১৯৮৬ সালে ‘বিখ্যাত এক বৃক্ষের জীবনবৃত্তান্ত’ শিরোনামের প্রবন্ধে বলেছেন, ‘আমি জানি পিতৃশোকে যুবরাজ হ্যামলেট উন্মাদ। কিন্তু তার পিতার হত্যাকারী রাজা কি ঐ নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার করবেন? করবেন না, করতে পারেন না। যেমন ফিলিপিন্সে হয় নাই জাতির পিতা হত্যার বিচার। যেমন পিনোচেট করতে পারেননি আলেন্দে-নিরুদা হত্যার বিচার।’ তবে সে ভাবনা আজ মিথ্যে হয়েছে। আমরা জাতির পিতার হত্যার উপযুক্ত বিচার করতে সক্ষম হয়েছি। কেননা এটা জাতির পিতার দেশ। এটা বঙ্গবন্ধুর দেশ। এটা শেখ মুজিবুরের দেশ। জাতির পিতা, তোমার মৃত্যু যতই নির্মম হোক না কেন, আমরা তার উপযুক্ত বিচার করেছি। এখন তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও। তোমার কবরে কোনো কান্নার শব্দ নেই, সেখানে আমাদের প্রতিশোধের ফুলেল শ্রদ্ধা রয়েছে। তোমার চোখে আমরা বাঙালি এবং আমাদের চোখে তুমি বঙ্গবন্ধু। তোমাকে আমাদের লাল সালাম।

 

লেখক: গবেষক ও পরিবেশ ব্যক্তিত্ব

SUMMARY

1427-1.png