বঙ্গবন্ধুর আত্মীয়-স্বজন

     
মোতাহার হোসেন মাহবুব ||
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আপন ছয় ভাইবোনদের মধ্যে তৃতীয় ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বড় বোন ফাতেমা বেগম, আসিয়া বেগম, ছোটবোন আমেনা বেগম, ছোট ভাই শেখ আবু নাসের ও ছোট বোন খোদেজা বেগম। ছোটবেলায় বঙ্গবন্ধু টুঙ্গিপাড়ায় এঁদের সাথেই থাকতেন। বড় দুবোন ফাতেমা বেগম ও আসিয়া বেগমের অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। আপন ভাইবোন ছাড়াও বাড়িতে আশ্রিত আত্মীয় স্বজনের পরিবারের ছেলেমেয়ের সঙ্গেও বঙ্গবন্ধুর শৈশব কাটে। সর্বোপরি ছোটবেলা মা সায়েরা খাতুনের পরিচর্যায় বঙ্গবন্ধুর শৈশব জীবন অতিবাহিত হয়। চাচাতো বোন ফজিলাতুন নেছার বয়স যখন মাত্র তিন বছর তখন বঙ্গবন্ধুর সাথে বিয়ে হয়। বঙ্গবন্ধুর বয়স তখন মাত্র বারো বছর। পরে আনুষ্ঠানিক বিয়ে সম্পন্ন হয় বঙ্গবন্ধুর বয়স যখন আঠারো বছর। ফজিলাতুন নেছার সৌভাগ্য হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর মা সায়েরা খাতুন ও বাবা শেখ লুৎফর রহমানের অপত্য ¯েœহের আশ্রয়ে বড় হয়ে ওঠার। সে-সময় একান্নবর্তী পরিবারের প্রচলন ছিল। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আশ্রিত হিসেবে নিকট আত্মীয়-স্বজনদের অবস্থান ছিল। তাদের জন্য ধর্মশিক্ষা ও স্কুলের শিক্ষার জন্য বাড়িতে গৃহশিক্ষক থাকতেন, আবার মেয়েদের সেলাই, রান্নাসহ গৃহস্থালির কাজকর্ম শিক্ষাও হতো বাড়ির দাদি-নানি, মা-শাশুড়ির কাছে। 
শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪২ সালে যখন কলকাতায় যান, তখন মাত্র বারো বছর বয়স ফজিলাতুন নেছার। গ্রামের বাড়িতে শাশুড়ি সায়েরা থাতুনের সাথে থাকতেন। স্বামীর লেখাপড়ার জীবন ছাড়াও রাজনীতি ও দেশসেবার কথা শুনেন। স্বামীর জীবনাদর্শও উপলব্ধি করতে শিখেন ধীরে ধীরে। মাত্র ষোল বছর বয়সে মা হলেন, তাঁর প্রথম পুত্র সন্তানটি জন্মের পরই মারা যায়। এরপর কন্যা সন্তান শেখ হাসিনার জন্ম হলে তিনি যেন সময় কাটানোর সঙ্গী পান। যদতিন বেঁচেছিলেন এ কন্যা সন্তানই সকল সুখ-দুঃখ, আনন্দ বেদনা ও আলাপ-আলোচনার সাথী ছিলেন। 
দুই.
বঙ্গবন্ধুর পিতামাতার চার কন্যা ও দু’পুত্রের মধ্যে শেখ আসিয়া খাতুন দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর দুবছর পর জন্মগ্রহণ করেন। বড়বোন শেখ ফাতেমা খাতুনের বিয়ে হয় ষোল বছর বয়সে। টুঙ্গিপাড়া থেকে বজরা নৌকায় চড়ে একদিনে পথ পাড়ি দিয়ে ভাঙ্গা থানার দত্তপাড়ায় ছিল শ্বশুর বাড়ি। এজন্য মা সায়েরা খাতুন শেখ আসিয়া খাতুনকে বিয়ে দেন পাশের বাড়ির শেখ নুরুল হকের সাথে- যাতে মেয়েকে চোখের সামনে সবসময় দেখতে পান। শেখ নুরুল হক সরকারি চাকরি করতেন। তিনি কলকাতায় চাকরি করতেন। ভারতবর্ষ বিভক্তির পর তিনি ওখান থেকে ঢাকায় চলে আসেন। বঙ্গবন্ধু কলকাতার ছাত্রজীবনে বেকার হোস্টেলে থাকলেও এই মেজোবোন আসিয়া খাতুন ও দুলাভাই শেখ নুরুল হক তাঁর অভিভাবক ছিলেন। পরীক্ষার সময় তিনি তাঁদের বাসায় থেকে লেখাপড়া করতেন। বড়বোন শেখ ফাতেমা খাতুন মাত্র বিশ বছর বয়সে দুটি সন্তানসহ বিধবা হয়ে যান। বোনের দুর্ভাগ্যের এ বেদনা বঙ্গবন্ধুকে সারাজীবন কষ্ট দিয়েছে। ভাইবোনদের মধ্যকার ভালোবাসার বন্ধনের সর্ম্পকটা আসিয়া খাতুন ধরে রেখেছিলেন। 
আসিয়া খাতুনের বড় ছেলে শেখ ফজলুল হক মণি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হলে তিনি তাঁকে কখনও বাধা দেন নি। ছেলেদের প্রতি তাঁর একটি মাত্র প্রত্যাশা ছিল লেখাপড়া করতে হবে। মানুষের কল্যাণে কাজ করতে হবে। ভাই শেখ মুজিবের শুধু ভক্তই ছিলেন না তাঁর রাজনৈতিক আদর্শের একজন যোগ্য অনুসারী ছিলেন শেখ মণি। ছেলের লেখাপড়া, কাজকর্ম এবং রাজনীতিতে অংশগ্রহণ সবকিছুর পেছনে ছিল মা আসিয়া খাতুনের সযতœ দৃষ্টি ও নিবিড় পরিচর্যা। শেখ মণি বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন ও ছেষট্টির ছাত্র আন্দোলনে একজন সংগ্রামী নেতা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। 
১৯৬৬ সালের ৭ জুন ৬ দফার দাবিতে হরতালের ডাক দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু তখন জেলে ছিলেন। পুলিশের গুলিতে তেজগাঁর শ্রমিক নেতা মনু মিয়াসহ অনেকে নিহত হন। রাজনৈতিক নেতারা বন্দি ছিলেন। ছাত্র নেতারাই তখন আন্দোলন-সংগঠনের দায়িত্ব নেন। শেখ মণির সঙ্গে তখন প্রায় সব ছাত্র নেতারাই একাত্ম ছিলেন। তিনি সকলকে সংগঠিত করেছিলেন। আইয়ুব সরকার ছাত্রলীগের সব প্রাক্তণ ও তৎকালীন ছাত্রদের গ্রেফতার করলে শেখ মণিও বন্দি হন। পরবর্তী সময়ে রাশেদ খান মেনন, মতিয়া চৌধুরী, আব্দুর রাজ্জাকও বন্দি হন। শেখ মণির সংগঠিত পথ ধরেই পরবর্তী সময়ে উনসত্তরের গণআন্দোলনে ছাত্র ঐক্য গড়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের সময় শেখ মণি ও শেখ সেলিম- দুপুত্রকে যুদ্ধে পাঠিয়ে মা আসিয়া খাতুন তখন বড় বোনের কাছে ঢাকায় বসবাস করেন। 
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকদল বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে ও বোন আসিয়া খাতুনের পুত্র শেখ ফজলুল হক মণির ধানমন্ডির বাড়িতে আক্রমণ করে শেখ ফজলুল হক মণি ও তাঁর স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা আরজু মণিকে হত্যা করে। শেখ মণির দুছেলে পরশ ও তাপস বেঁচে যান। শেখ ফজলুল করিম সেলিম স্ত্রীসহ এবং শেখ মারুফও তখন এ বাড়িতে থাকতেন। শেখ মারুফ গুলিবিদ্ধদের নিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যান। 
পরকে আপন করার- অনাত্মীয়কে আত্মীয় করার আকর্ষণীয় শক্তি ছিল আসিয়া খাতুনের। ভাই ও ভাইয়ের মেয়ে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন এটাই ছিল তাঁর আনন্দ। কখনও তাঁদের কাছে কোনো চাওয়া-পাওয়ার দাবি করেন নি। নিজের সন্তানদের কাছেও না। ১৯৮৭ সালে স্বামী শেখ নুরুল হক মৃত্যুবরণ করলে তিনি গ্রামের বাড়ি ছেড়ে শেখ সেলিমের কাছে এসে থাকেন। ২০০৭ সালের ২৮ জুন বঙ্গবন্ধুর মেজোবোন শেখ আসিয়া খাতুন মৃত্যুবরণ করেন। 
তিন.
বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসের। তাঁর ছেলে দৈনিক বাংলার বরিশাল প্রতিনিধি সাংবাদিক শহীদ সেরনিয়াবাত। উভয়কে ১৫ আগস্ট ঘাতকরা হত্যা করে। শেখ আবু নাসেরকে হত্যা করে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাসায় ও শহীদ সেরনিয়াবাতকে হত্যা করে মিন্টু রোডের বাসায়। 
বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি ছিলেন তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত। তাঁর দুসন্তান বেবী ও আরিফ। নাতি সুকান্ত আব্দুল্লাহ। এঁদের সবাইকে ঘাতক সেনারা মিন্টুরোডের বাসায় হত্যা করে। সেদিন বঙ্গবন্ধুর মেজোবোন সেরনিয়াবাতের স্ত্রী আমেনা খাতুনও গুলিবিদ্ধ হন। গুলি নিয়েই তিনি ৩০ বছর বেঁচেছিলেন। ২০০৫ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ঘাতকরা এ বাড়িতে সর্বপ্রথম  আক্রমণ করে গুলিবর্ষণ শুরু করলে বঙ্গবন্ধুকে বেবী ফোন করে জানায়। গুলিবিদ্ধদের হাসপাতালে নিয়ে যান আবদুর রব সেরনিয়াবাতের পুত্রবধূ সাহানারা আবদুল্লাহ। 
ড. ওয়াজেদ মিয়া জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় জামাতা ছিলেন। ১৯৬৭ সালে বঙ্গবন্ধু যখন আগরতলা মামলার রাষ্ট্রদ্রোহী আসামি হিসেবে কারাবন্দি সে-সময় ১৭ নভেম্বর শবে বরাতের রাতে শেখ হাসিনার সাথে ড. ওয়াজেদের আকদ সম্পন্ন হয়। পারিবারিকভাবে আত্মীয়-স্বজনরাই এ অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। এ বিয়ের উদ্যোক্তা ছিলেন রংপুরের আওয়ামীলীগ নেতা মতিউর রহমান। তিনি ফজিলাতুন নেছা মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎকরে এ বিয়ের প্রস্তাব দেন। শেখ হাসিনা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের (অনার্স) প্রথম বর্ষের ছাত্রী ও ড. ওয়াজেদ মিয়া ঢাকার আনবিক শক্তি কমিশনের সাইন্টিফিক অফিসার। ঢাকা বিশ্বদ্যিালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে অনার্স ও এমএসসি পাশ করে ইটালি থেকে পিএইচ-ডি ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে আনবিক কমিশনে যোগদান করেন। মেধাবী, উচ্চ শিক্ষিত ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ধারক এ পাত্রকে ফজিলাতুন নেছা দ্রুতই পছন্দ করেন, কিন্তু কারাবন্দি স্বামী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পরামর্শ করে তাঁর অনুমতি নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শুধু বলেছিলেন, ‘হাসুকে একবার জিজ্ঞেস করে নিও।’ পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু কারামুক্তি লাভ করলে চট্টগ্রামের আওয়ামীলীগ নেতা এম এ আজিজ চট্টগ্রামে বিবাহোত্তর সংবর্ধনার আয়োজন করেছিলেন। 
ড. ওয়াজেদ মিয়া রংপুর জেলার পীরগঞ্জ থানার প্রত্যন্ত গ্রাম ফতেহপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বন্ধু বান্ধব ও সহকর্মীরা তাঁকে একজন নিভৃতচারী ও জ্ঞানী মানুষ হিসেবে সম্মান করতেন। তিনি জ্ঞানের সাধনা ও নিজের পেশা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও রাজনীতিকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রহরায় বঙ্গবন্ধু পরিবারের সঙ্গে ছিলেন। তাঁর প্রথম সন্তান জয়ের তখন জন্ম হয়। বঙ্গবন্ধু কন্যা তাঁর স্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কর্মকা-ে যখন মানুষের ভিড় লেগে থাকত তিনি নীরবে তা দেখতেন। উপভোগ করতেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী ছিলেন বলেই তা সম্ভব হয়েছে। মানুষের ভালবাসা শ্রদ্ধায় আমাদের দেশের একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ড. ওয়াজেদ মিয়া তাঁর প্রিয় জন্মভূমিতেই মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর শেষ দাবি অনুযায়ী ফতেহপুর মায়ের কবরের পাশে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। ২০০৯ সালের ৯ মে নানা জটিল রোগে চিকিৎসারত অবস্থায় ঢাকার স্কয়ার হাতপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। 
চার.
বঙ্গবন্ধুর ফুফাতো ভাই মমিনুল খোকা- একান্ত প্রিয় অনুজ বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক পরিম-লের প্রায় অবিচ্ছেদ্য সদস্য, পরিবারের সুখ-দুঃখের সার্বক্ষণিক সাথী- যার আরমানিটোলার ৮/৩ রজনী বোস লেনের বাসাতে বঙ্গবন্ধুর প্রথম উঠে আসা। হঠাৎ করে সবাইকে অবাক করে দিয়ে একদিন টুঙ্গিপাড়া থেকে বঙ্গবন্ধুর পতœীকে এ বাসায় নিয়ে আসা। এটি ১৯৫৩ সালের কথা। আরমানিটোলার এ বাসার একটি কক্ষে প্রাক্তণ মুখ্য ও প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খানসহ ওই সময়ের আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের ঘনঘন বৈঠকে নূরুল আমীন বিরোধী রাজনৈতিক রণকৌশল নির্ধারণের লক্ষ্যে বিভিন্ন আলোচনা হয়েছে। 
১৯৫৪ সালে বঙ্গবন্ধুকে যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রিত্ব গ্রহণের পর তিনি এ বাসা ছেড়ে মিন্টো রোডের সরকারি বাসায় উঠেন। মমিনুল হক খোকার অনুপস্থিতিতে মালামাল নিয়ে মিন্টো রোডের বাসায় উঠাতে অভিমান ক্ষুব্ধ মমিনুল হক খোকার জিজ্ঞাসার জবাবে বঙ্গবন্ধু শান্ত মনে বলেছেন, ‘তোর আবার আলাদা ঠিকানা কিরে? ফজিলাতুন নেছা মুজিব বলেছেন, ‘ভাডি, মনে থাকে যেন আজ থেকে তোর কোনো আলাদা ঠিকানা নেই।’ 
মমিনুল হক খোকা বলেছেন, “এখনও অনুভব করি মিঞা ভাইর (বঙ্গবন্ধু) সেই সরল হাতের স্পর্শ ও তাঁর সেই দরদমাখা উক্তি- ‘খোকা তোর উপর আমি নির্ভর করি। তুইতো জানিস যে জীবন আমি বেছে নিয়েছি তার কোনো নিশ্চিত স্থিতি নেই, কখন কোথায় থাকি। জানি আমার বহু আত্মীয় আছে, আছে অসংখ্য সুহৃদ, অগণিত ভক্ত কিন্তু তোকেই আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ মনে হয়। তোর ওপরই দিয়েছি তোর ভাবী আর আমার দেখাশুনার ভার।” 
বঙ্গবন্ধুর ফুফাতো ভাই মমিনুল হক খোকা ছিলেন তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে অত্যন্ত বিশ্বস্থ। বঙ্গবন্ধু সেই ১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত যেখানেই গিয়েছেন মমিনুল হক খোকাকে সাথে নিয়ে গেছেন। 
বঙ্গবন্ধু যখন ৭ মার্চ রেসকোর্সে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন তখনও মমিনুল হক খোকা তাঁর পাশে ছিলেন। এ প্রসঙ্গে মমিনুল হক খোকা তাঁর রচিত ‘অস্তরাগে স্মৃতি সমুজ্জ্বল/বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার ও আমি’ গ্রন্থে লিখেছেন, “ঐতিহাসিক ৭ মার্চ, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার পূর্বদিনের ভাষণে বিক্ষুদ্ধ সারা দেশ ও জাতি তাকিয়ে আছে তাদের ভাগ্যনিয়ন্তা, অবিসংবাদিত জননেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দিকে। সকাল থেকেই মানুষ ছুটছে রেসকোর্সের দিকে নেতার নির্দেশ শুনতে- এ যেন ইতিহাসের এক মহাক্রান্তিকাল। বেলা সাড়ে ৪টা। মিঞাভাই দোতলা থেকে নেমে এসে উঠলেন আমার গাড়িতে, আমি চালক। পিছনে ট্রাকভর্তি আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দ। ধীরে ধীরে চলছি রেসকের্সের পথে। চিন্তামগ্ন মিঞা ভাই মাঝে মাঝেই আমার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করছেন। হঠাৎ বলে উঠলেন- ‘খোকা, খায়ের ও সালাউদ্দিনকে বলিস আমার আজকের বক্তৃতার রেকর্ড করতে (আবুল খায়ের এমএনএ এবং সালাউদ্দিন আহমেদ তখন ইস্ট পাকিস্তান গ্রামোফোন কোম্পানি নামে এক রেকর্ড কোম্পানির মালিক বা প্রতিষ্ঠাতা), আর ‘অভাইগা’ (নাট্যশিল্পী আবুল খায়ের- তৎকালীন সরকারের ফিল্মস ডিভিসনের চিফ) কে বলিস মুভি ক্যামেরায় ধরে রাখা ছবি যেন সে রেখে দেয়।’ (পৃ. ১৯)
রেসকোর্স ময়দানে তখন লাখো জনতার সমাবেশ- ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ শ্লোগানে আকাশ-বাতাশ মুখরিত ও প্রকম্পিত। মঞ্চে উঠলেন বঙ্গবন্ধু, ভাষণ শুরু করলেন আর সারা বাংলাদেশ যেন নেতার কণ্ঠে কণ্ঠ মিলালো- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ২২ মিনিটের বক্তৃতা, সামগ্রিক পরিস্থিতির কী অপূর্ব বিশ্লেষণ, সঙ্গে তাঁর প্রিয় দেশবাসীর আগামী দিনের নির্দেশ, কিছুইতো অস্পষ্ট রলো না।
কী নিপুণ ভঙ্গিমায় তিনি বল ছুঁড়ে দিলেন প্রতিপক্ষ সামরিক নেতৃবৃন্দের অঙ্গনে, বাঁচালেন জনসমুদ্রকে সেই মুহূর্তের এক নিশ্চিত মরণযজ্ঞের হাত থেকে।
এরপর শাসকগোষ্ঠীর নানা ষড়যন্ত্রের চক্রজালে ২৫ মার্চ সারাদিনের অস্থির অনিশ্চিত মুহূর্তগুলো যেন এক একটি দিনে পরিণত হয়। সবার মুখে একই প্রশ্ন কী হতে যাচ্ছে? ওরা কি আমাদের দাবি মেনে নিচ্ছে? দিনের শেষে আসে অমনি সংকেত- ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করেছেন। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের চোখে মুখে গভীর উৎকণ্ঠা। সবার অনুরোধের মুখেও বঙ্গবন্ধুর অটল সিদ্ধান্ত- ‘না, আমি বাসা ছাড়বো না, আমাকে না পেলে ওরা কাউকেই জীবিত রাখবে না।’
২৫ মার্চ কালোরাতেই বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গ্রেফতার করে। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে সেই বাড়িতে ২৬ মার্চ পর্যন্ত আটকে থাকে বঙ্গবন্ধুর পরিবার। ২৭ মার্চ ভোর না হতেই এবাড়ি ওবাড়ির দেয়াল টপকিয়ে মমিনুল হক খোকা পৌছে যান ৩২ নম্বরের পাশের বাড়ি। এরপর উদ্ধার করেন বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী ফজিলাতুন নেছা, বাকরুদ্ধ জামাল ও রাসেলকে। এরপর ওখান থেকে এবাসা ওবাসা করে শেষে সবাই মিলে ওঠেন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান শিপিং কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন এম রহমানের বাসাতে। এরপর আবারো এবাসা ওবাসা করে শহরের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে জীবন বাঁচাতে ছুটাছুটি। বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী ফজিলাতুন নেছা স্বাধীনতা উত্তরকালে মমিনুল হক খোকা সম্পর্কে বলেছেন, ‘বিড়াল যেমন তার বাচ্চাদের কাঁধ কামড়ে ধরে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় নিয়ে যায়, আমার এই ভাই তেমনি আমাদের সবাইকে নিয়ে এক বাসা থেকে আর এক বাসাতে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছিল- এ ভাইয়ের ঋণ আমরা কোনোদিন শোধ করতে পারবো না।’ শুধু একাত্তর নয় পচাঁত্তর পরবর্তীতেও মমিনুল হক খোকা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে সার্বিক সহযোগিতা  করেছেন। প্রকৃতঅর্থে বঙ্গবন্ধুর আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে যে আত্মত্যাগের নজির তা খুব কম পরিবারেই দেখা যায়।

SUMMARY

1426-1.jpg