শাহানা হুদা রঞ্জনা
সেদিন ছিলাম মাত্র ৯ বছরের শিশু। কিন্তু ওই দিনের প্রতিটি স্মৃতি মনে একেবারে স্পষ্ট হয়ে গেঁথে আছে। চাইল্ড সাইকোলজিস্টরা বলেন, শিশুদের মনে কোন কোন বড় ঘটনা এমনভাবে প্রভাব ফেলে যে সারাজীবন শিশু তা মনে রাখে। শুধু মনেই রাখে না, তার চিন্তা চেতনার অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় ওই ঘটনার দ্বারা। ঠিক সেরকমই একটি দিন ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট।
১৫ আগস্ট ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেলো প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দে। দৌড়ে আব্বা আম্মার ঘরে গেলাম। সবাই হতচকিত। আমি ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম। আব্বা এখানে-ওখানে টেলিফোন করার চেষ্টা করছেন খবর জানার জন্য । শব্দটা এত কাছ থেকে আসছিল যে কান পাতা যাচ্ছিল না। আমরা থাকতাম আসাদগেট নিউকলোনিতে। ৩২ নম্বর এর খুব কাছে। এরমধ্যে আম্মা ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠেই বললেন, ‘আচ্ছা শব্দটা কি বঙ্গবন্ধুর বাসা থেকে আসছে? ওনাকে কি মেরে ফেললো? তুমি রেডিও ধর।’ আম্মার এই কথার পর আব্বা সম্বিত ফিরে পেয়ে রেডিও অন করলেন।
মেজর ডালিমের কণ্ঠস্বর
ভেসে এলো মেজর ডালিম এর কণ্ঠস্বর। তাদের অপকর্মের কথা জোর গলায় ঘোষণা করছেন। আব্বা কান্নায় ভেঙে পড়লেন। এর আগে আমি কখনও আব্বাকে কাঁদতে দেখিনি। আম্মাও কাঁদছেন। আমিও বুঝে, না বুঝে কাঁদতে থাকলাম। আমার তখন রাজনীতি বোঝার বয়স নয়, বুঝতামও না। কিন্তু পারিবারিক কারণে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি অসম্ভব টান বা ভালবাসা তৈরি হয়েছিল, যা এখনও অটুট।
বেজে উঠল লাল টেলিফোন
আব্বা সেসময় ছিলেন প্রিন্সিপাল ইনফরমেশন অফিসার। তিনি পাগলের মত কাঁদছেন, আর বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে খবর জানার চেষ্টা করছেন। আমাদের বাসায় তখন একটা ‘লাল ফোন’ ছিল, যেটা দিয়ে শুধু হাই প্রোফাইল ব্যক্তিদের সাথে কথা বলা যেত। সেটার নম্বর ছিল তিন অংকের। সকাল ১১ টার দিকে সেই ফোনটা বেজে উঠল। অপর পাশ থেকে একজন আব্বাকে বললেন তৈরি হয়ে নিতে, কারণ তাকে নিতে গাড়ি পাঠানো হয়েছে।
এই কথা শুনে আম্মার অবস্থা হলো আরও শোচনীয়। ততক্ষণে আমরা জেনে গেছি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। তার আশেপাশে যারা ছিলেন তাদেরও এক এক করে হত্যা করা হয়েছে। আম্মা চিৎকার করে আব্বাকে বলতে থাকলেন, ‘ওরা তোমাকেও মেরে ফেলবে। ওরা জানে তুমি বঙ্গবন্ধুর লোক। তুমি যেও না রঞ্জনার আব্বা।’
আব্বাকে নিয়ে গেল ওরা
কিন্তু না গিয়ে তো উপায় নেই। আব্বা তৈরি হয়ে নিলেন। বেলা ১২টার দিকে সেনাবাহিনীর একটি জিপ এসে আব্বাকে নিয়ে গেল। সারা কলোনির মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ল সেই দৃশ্য দেখার জন্য। চরম একটা অনিশ্চিত ও ভীতিকর অবস্থা। এরপর প্রায় দেড়দিন গেল, আব্বার কোনো খবর পেলাম না। আম্মা কাঁদতে কাঁদতে পাগল হওয়ার অবস্থা। ছোট ভাই বাবেলের বয়স এক বছর – ওর দিকেও আম্মার চোখ নেই। বাসায় রান্নাবান্না বন্ধ। ভয়ে অনেক আত্মীয়–স্বজন খোঁজ খবরও নিচ্ছে না।
যে দৃশ্য আমি কোনদিনও ভুলব না
ঠিক এরকম একটি অবস্থায় প্রথম দিনটি চলে গেল । ১৬ আগস্ট সকাল বেলা দেখলাম আমাদের বিল্ডিং এর নীচতলায় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের একজন নেতা থাকতেন, তিনি মিষ্টি বিতরণ করছেন। অনেকেই হাসি মুখে সেই মিষ্টি খাচ্ছেন। সেসময় জাসদের পত্রিকা ‘গণকণ্ঠ’র একজন সাংবাদিক আনোয়ার সাহেব থাকতেন কলোনিতে। তিনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে মুজিবকে বংশসহ হত্যা করার কাজটি কত ভালো হয়েছে, সেবিষয়ে উঁচু গলায় বক্তৃতা দিচ্ছেন। আর অন্যরা এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে নানারকম টিপ্পনী কাটছেন।
আমি অবাক হয়ে সেই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছিলাম। যে আনোয়ার সাহেব প্রতিদিন সকালে এসে আমাদের বাসায় চা-নাস্তা খেয়ে খবরের কাগজ পড়তেন (তখন সব খবরের কাগজ আমাদের বাসায় আসত) আর আব্বার সাথে গল্প করতেন, সেই আনোয়ার সাহেব একবার আমাদের খোঁজও নিলেন না। বরং বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড নিয়ে হাসিঠাট্টা করছেন। সেদিন বুঝিনি, পরে বুঝেছি এই জাসদ সেময় আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের কারণ ছিল, আর এখনও জাসদের যারা আওয়ামী লীগার হিসেবে বিচরণ করছেন, তারাও আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য বিপদই বয়ে আনছেন।
তখনও ভেবেছি, এখনও ভাবি, যে মানুষটি এই দেশকে স্বাধীন করলেন, তাকে পরিবারসহ এভাবে কেন হত্যা করা হলো? হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে আবার মিষ্টিও খাচ্ছে কেউ কেউ। এরকম একটি নির্মম হত্যাযজ্ঞকে কেন এবং কারা সমর্থন করছে? আমার সেই সময়ের শিশুমনে যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল, এর উত্তর আজও পাইনি। যতবার ১৫ আগস্ট আসে, ততবার সবকিছু ছাপিয়ে শুধু ওই দৃশ্যটিই আমার চোখে ভেসে ওঠে। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উপলব্ধি করেছি, হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ কখনও ভালো ফল বয়ে আনতে পারে না। মাত্র কয়েক বছর পর একইভাবে নিহত হলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। আরও কত হত্যাকাণ্ড কালিমালিপ্ত করল বাংলাদেশের ইতিহাসকে।
অতঃপর আব্বার ফিরে আসা
১৭ আগস্ট দুপুরে সেই লাল টেলিফোন আবার বেজে উঠল। ওই পাশে আব্বার কণ্ঠস্বর। যাক তাহলে ওরা আব্বাকে মেরে ফেলেনি। আম্মার যে চোখের পানি শুকিয়ে গিয়েছিল, তা আবার ধারার মতো নামতে শুরু করল। শুধু বলতে থাকলেন, ‘তুমি কি খাইছো? ওরা তোমাকে মারে নাইতো? তুমি কখন আসবা?’ আব্বা জানালেন তিনি বঙ্গভবনে আছেন। ভাত খেয়েছেন। আব্বা আমাদের চিন্তা করতে মানা করলেন। বললেন, কাজ শেষ হলে ওরাই বাসায় দিয়ে যাবে। সেদিনই রাত ১২ টার দিকে আব্বা বাসায় ফিরে এলেন। কিন্তু আব্বাকে অসম্ভব ক্লান্ত, অসহায় আর বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল। আব্বার ওই চেহারাটা আমি কোনদিন ভুলব না।
ইতিহাসের কালো অধ্যায়
সেই ১০ বছর বয়সে যা বুঝিনি, পরবর্তী সময়ে এর অনেকটাই বুঝেছি। বুঝেছি ইতিহাসে কালো অধ্যায় একবার যোগ হলে, তা বারবার ফিরে আসে। সেদিন সামরিক বাহিনীর একাংশের সেই কুৎসিত কাজকে যারা সমর্থন করেছিলেন, তারা নিজেরাই একদিন সেই কুৎসিত কাজের বলি হলেন। বারবার সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষতবিক্ষত হলো দেশ ও দেশের মানুষ। এখনও বিশ্বাস করি এবং সারাজীবন বিশ্বাস করে যাব -- ১৫ আগস্টের সেই হত্যাযজ্ঞ বাংলাদেশকেই পরাজিত করেছে এবং এর জের আমাদের বয়ে বেড়াতে হবে।